কিশোর গোয়েন্দাদের বিচিত্র জগৎ
গোয়েন্দাকাহিনি কে না ভালোবাসে? রহস্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তো চিরন্তন, যা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায় না, আপাতদৃষ্টে যার কার্যকারণ স্পষ্ট নয়, সেই আলো-আঁধারি ধোঁয়াশা ভাব আমাদের মনকে বিস্মিত করে, রোমাঞ্চ জাগায়, অনেক সময় আতঙ্কেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু কিছু ঘটনা মনে হয় অলৌকিক, কিছু ঘটনা থাকে ব্যাখ্যাহীন। এসব ঘটনার আড়ালের রহস্য উদ্ঘাটন করেন গোয়েন্দারা, শাস্তি নিশ্চিত করেন কুটিল মানুষদের। পূরণ করেন আমাদের অন্তরের গভীরে লুকিয়ে থাকা ন্যায় ও সত্যের বিজয় দেখার বাসনা। তাই নানা ভাষার সাহিত্যে গোয়েন্দাদের নিয়ে লেখা গল্প-উপন্যাসের জয়জয়কার চলছে দীর্ঘকাল থেকে। এরকুল পোয়ারো, শার্লক হোমস বা ফেলুদার মতো গোয়েন্দারা হয়ে উঠেছে কালজয়ী ও অমর। তবে এরা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক গোয়েন্দা। আরেক ধরনের গোয়েন্দা আছে সাহিত্যজগতে—তারা বয়সে কিশোর বা কিশোরী। হার্ডি বয়েজ, ন্যান্সি ড্রু বা আমাদের তিন গোয়েন্দার মতো। বড়দের তুলনায় ওরা কোনো অংশেই কম নয়—না বুদ্ধিতে, না সাহসে, না জয়প্রিয়তায়। ইংরেজিতে এদেরকে বলা হয় জুভেনাইল ডিটেকটিভস; বাংলায় কিশোর গোয়েন্দা।
বড় গোয়েন্দাদের সঙ্গে কিশোর গোয়েন্দাদের পার্থক্য শুধু বয়সের দিক থেকে নয়। কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কারণে কিশোর গোয়েন্দাকাহিনি সম্পূর্ণ আলাদা ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের বয়স অবশ্যই প্রথম বিবেচ্য বিষয়। বলে রাখা ভালো, শিশু-কিশোরদের উপযোগী গোয়েন্দাকাহিনি মানেই কিন্তু কিশোর গোয়েন্দাদের কাহিনি নয়; বয়স্ক গোয়েন্দাদের নিয়েও ছোটদের কাহিনি হতে পারে। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা বা ফরিদুর রেজা সাগরের ছোটকাকু তো পুরোপুরিভাবেই ছোটদের গোয়েন্দা। শার্লক হোমস ও এরকুল পোয়ারোর বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসও ছোটদের উপযোগী। এসব কাহিনির নায়ক গোয়েন্দাটি বয়সে বড় হলেও গল্পগুলো লেখা হয়েছে ছোটদের কথা ভেবে। কিন্তু কিশোর গোয়েন্দাদের কাহিনিগুলো শুধু ছোটদের জন্যই লেখা হয় না, তারা নিজেরাও বয়সে ছোট। টিনএজের চেয়ে বেশি বয়স হয় না কোনো কিশোর গোয়েন্দার।
কিশোর গোয়েন্দাকাহিনির শেষ বৈশিষ্ট্যটি হলো এর একাত্মতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। গল্পের কিশোর গোয়েন্দারা বাস্তবের আর দশটি কিশোর-কিশোরীর মতোই। রয়েছে একই ধরনের সীমাবদ্ধতাও।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি কাহিনির বিষয়বস্তু নিয়ে। বড়দের গোয়েন্দাকাহিনির প্রধান বিষয় যেখানে খুন বা নৃশংসতা, সেখানে কিশোরদের উপযোগী গোয়েন্দাকাহিনিতে সচেতনভাবেই লেখকেরা ওসব অনেকটা এড়িয়ে গিয়ে থাকেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে কিশোর গোয়েন্দারা সাধারণত কিছুটা ছোট পরিসরে ও নৃশংসতাবিহীন রহস্যের সমাধান করে থাকে। সেটাই বাস্তবতা। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা খুনের রহস্য ভেদ করছে, তা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর তাই ওদের জন্য রহস্য খুঁজতে গিয়ে উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে হয় লেখকদের, অবতারণা করতে হয় নিত্যনতুন বিষয়, পরিবেশ ও পরিস্থিতির। বড়দের গোয়েন্দাকাহিনির চেয়ে এ কারণেই কিশোর গোয়েন্দাকাহিনি অনেক বেশি বৈচিত্র্যময়। মোটাদাগে, তিন রকম হতে পারে এসব কাহিনি। প্রথমটি সাধারণ অপরাধ, যেমন চুরি-ডাকাতি-জালিয়াতির রহস্য ভেদ কিংবা কোনো ষড়যন্ত্র ভেস্তে দেওয়ার কাহিনি। দ্বিতীয়টি হতে পারে কোনো ভুতুড়ে ঘটনার তদন্ত। আর সর্বশেষ লুকানো গুপ্তধন উদ্ধারের কাহিনি। তবে এই তিন থিমের ওপরই যে কত চমত্কার সব কাহিনি তৈরি হতে পারে, তার লেখাজোখা নেই।
কিশোর গোয়েন্দাকাহিনির শেষ বৈশিষ্ট্যটি হলো এর একাত্মতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। গল্পের কিশোর গোয়েন্দারা বাস্তবের আর দশটি কিশোর-কিশোরীর মতোই। রয়েছে একই ধরনের সীমাবদ্ধতাও। তাদের গায়ের জোর নেই, পুলিশ তাদের গুরুত্ব দেয় না, বড়রা কথা শোনে না, চাইলেই তারা যেখানে-সেখানে যেতে পারে না, অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এত সব বাধাবিপত্তি তারা অতিক্রম করে স্রেফ মনের জোরে, সেই সঙ্গে সাহস ও বুদ্ধি খাটিয়ে। এ ছাড়া এসব গল্পে থাকে কিশোর বয়সের দুরন্তপনা, বন্ধুত্ব ও পারিবারিক বন্ধনের প্রতিফলন। বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে এই যে বিশ্বাসযোগ্য মিল, এটাই এসব কাহিনির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। এর জন্যই পাঠকেরা একাত্ম হয়ে যায় গল্পের গোয়েন্দার সঙ্গে, কল্পনায় নিজেদের দেখতে পায় গল্পের চরিত্রগুলোর ভূমিকায়।
গত শতাব্দীর ষাট, সত্তর ও আশির দশক ছিল কিশোর গোয়েন্দা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। বিভিন্ন ভাষায় একক কাহিনি যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে নিত্যনতুন সিরিজ।
মজার ব্যাপার হলো, রহস্য–সাহিত্যের ইতিহাসে বয়স্ক গোয়েন্দাদের আগেই আবির্ভাব ঘটেছিল কিশোর গোয়েন্দার। বিজ্ঞজনদের মতে, ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস, উইকি কলিন্সের দ্য মুনস্টোন-এর দুই বছর আগেই ব্রিটেনে এক পেনি মূল্যের সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিল ‘আর্নেস্ট কিন, বয় ডিটেকটিভ’ নামে এক কিশোর গোয়েন্দার কাহিনি। বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটি। ফলে ১৮৮০-এর দশকে আমেরিকাতেও দেখা দেয় ‘নিউইয়র্ক নেল, বয়-গার্ল ডিটেকটিভ’ নামে আরেক কিশোর গোয়েন্দা। নেল আসলে একজন কিশোরী, যে ছেলে সেজে রহস্য সমাধান করত!
এই ছিল শুরু। পরবর্তী সময়ে কিশোর গোয়েন্দাদের জনপ্রিয়তা লক্ষ করে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও তাঁর শার্লক হোমস সিরিজে বেকার স্ট্রিট ইরেগুলারস নামে একদল কিশোর গোয়েন্দাকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তারা অবশ্য হোমসকে শুধু সাহায্যই করত, তাদের নিয়ে আলাদা কোনো কাহিনি লেখেননি ডয়েল। অন্য লেখকেরাও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিশোর গোয়েন্দাকাহিনি লিখেছিলেন, যাঁদের মধ্যে অ্যানা ক্যাথারিন গ্রিন ও ফ্র্যাঙ্ক বম উল্লেখযোগ্য। বলা বাহুল্য, সেগুলোর কোনোটাই খুব সাড়া ফেলতে পারেনি।
এ তো গেল অতীতের কথা। চোখ ফেরানো যাক আধুনিক কিশোর গোয়েন্দাদের দিকে। ১৯২৯ সালে জার্মানিতে প্রকাশিত, এরিখ কাস্টনারের লেখা এমিল অ্যান্ড দ্য ডিটেকটিভসকে প্রথম সার্থক কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাস বলে মনে করা হয়। নামটা চেনা চেনা লাগছে? লাগারই কথা, কারণ এই উপন্যাস অবলম্বনেই আশির দশকে আমাদের দেশে নির্মিত হয়েছিল এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী নামে চমত্কার একটি চলচ্চিত্র। ইউটিউবে রয়েছে ছবিটি, দেখে নিতে পারো। যাহোক, কাস্টনারের বইটি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শুধু মূল জার্মান ভাষায় নয়, বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত সংস্করণগুলোও পাঠকদের মন কেড়ে নেয়। বাংলাতেও বেশ কয়েকটি অনুবাদ আছে বইটির। কিশোর গোয়েন্দা এমিলের এই জনপ্রিয়তা দেখে একই ধরনের বই লেখায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন ইংল্যান্ড ও আমেরিকার লেখকেরা। ন্যান্সি ড্রু, হার্ডি বয়েজ বা ফেমাস ফাইভ-এর মতো বিশ্ববিখ্যাত কিশোর গোয়েন্দা সিরিজগুলো শুরু হয় তখনই।
নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়ে কিশোর গোয়েন্দা সাহিত্যে, বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে জে কে রাউলিংয়ের হ্যারি পটার বের হওয়ার পর থেকে। তত দিনে অসংখ্য বই বেরিয়ে গেছে কিশোর গোয়েন্দাদের নিয়ে
গত শতাব্দীর ষাট, সত্তর ও আশির দশক ছিল কিশোর গোয়েন্দা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। বিভিন্ন ভাষায় একক কাহিনি যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি প্রকাশিত হয়েছে নিত্যনতুন সিরিজ। এসব বইয়ের চাহিদা এতই বেশি ছিল যে বিদেশে রীতিমতো টিম বানিয়ে লেখানো হতো বিভিন্ন জনপ্রিয় সিরিজের বই, যেগুলোর প্রচ্ছদে সিরিজের লেখক হিসেবে ব্যবহার করা হতো প্রকাশনী থেকে নির্ধারিত একটি কাল্পনিক ছদ্মনাম, ইংরেজিতে যাকে বলে হাউস-নেম। ন্যান্সি ড্রু সিরিজের ক্যারোলিন কিন বা হার্ডি বয়েজ–এর ফ্র্যাঙ্কলিন ডব্লিউ ডিক্সন এর উজ্জ্বল উদাহরণ। এ দুটি নামে আসলে কোনো লেখক নেই, কিন্তু গত ৮০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন লেখকেরা এই নামগুলোর আড়ালে পাঠকদের উপহার দিয়ে চলেছেন নতুন নতুন সব বই।
কিশোর গোয়েন্দা সাহিত্যের স্বর্ণযুগে বাংলা ভাষাতেও লেখা হয়েছে এ ধরনের প্রচুর বই। সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন গোয়েন্দা সিরিজের শুরুটা লেখক রকিব হাসান করেছিলেন ১৯৮৫ সালে। এ ছাড়া সিরিজ আকারে সমরেশ বসুর গোয়েন্দা গোগোল, চারজন কিশোরীর যৌথ গোয়েন্দাগিরি নিয়ে নলিনী দাশের গোয়েন্দা গণ্ডালু, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাঁচজন কিশোর-কিশোরীর গোয়েন্দা দল পাণ্ডব গোয়েন্দা, আমার লেখা অয়ন-জিমি—সবই লেখা হয়েছে সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে। এসব সিরিজের কিছু বন্ধ হয়ে গেছে, কিছু এখনো সগৌরব চলছে। বিচ্ছিন্নভাবে একক কাহিনি হিসেবে সে সময় যেসব বই লেখা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো শাহরিয়ার কবিরের নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, পাথারিয়ার খনি রহস্য, আবুদের অ্যাডভেঞ্চার; মুহম্মদ জাফর ইকবালের দীপু নাম্বার টু, দুষ্টু ছেলের দল, হাতকাটা রবিন; আলী ইমামের রক্তমাখা পুঁথি, বনকুসুমপুর রহস্য, নীল শয়তান ইত্যাদি।
নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগে জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়ে কিশোর গোয়েন্দা সাহিত্যে, বিশেষ করে ১৯৯৭ সালে জে কে রাউলিংয়ের হ্যারি পটার বের হওয়ার পর থেকে। তত দিনে অসংখ্য বই বেরিয়ে গেছে কিশোর গোয়েন্দাদের নিয়ে, পাঠকেরা হয়তো একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হয়েছিল, তাই তারা লুফে নেয় হ্যারি পটারকে। তার ধারাবাহিকতায় জুভেনাইল ফ্যান্টাসি বা কিশোর ফ্যান্টাসি নামে আরেকটি ধারার সূচনা হয়। বর্তমানে বিদেশে এ ধরনের বই-ই বেশি লেখা হচ্ছে। তাই বলে পাঠকেরা কি ভুলে গেছে কিশোর গোয়েন্দাদের? মোটেই নয়। আমেরিকায় এখনো প্রকাশিত হচ্ছে ন্যান্সি ড্রু ও হার্ডি বয়েজ–এর নতুন বই, আমাদের দেশেও পাঠকেরা পাগলের মতো পড়ছে তিন গোয়েন্দা বা অয়ন-জিমির কাহিনি। পুরোনো বই তো নিয়মিত পুনর্মুদ্রিত হচ্ছেই। তৈরি করা হচ্ছে টিভি সিরিজ ও চলচ্চিত্র। আসলে কিশোর গোয়েন্দাদের যে আকর্ষণ, তা মিলিয়ে যাবে না কোনোকালেই।
এসো, এবার তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই বিখ্যাত কয়েকজন কিশোর গোয়েন্দার সঙ্গে।
হার্ডি বয়েজ
লেখক: ফ্র্যাঙ্কলিন ডব্লিউ ডিক্সন
ফ্র্যাঙ্ক হার্ডি ও জো হার্ডি নামে দুই ভাইয়ের কাহিনি। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় সিরিজের প্রথম বই দ্য টাওয়ার ট্রেজার, তবে শুরুর দিকে ঠিক কিশোর গোয়েন্দাদের সিরিজ ছিল না সেটি। তবে এ ধারার জনপ্রিয়তা লক্ষ করে পরের দিকে সিরিজটির কাহিনির ধাঁচ পরিবর্তন করা হয়, এমনকি পরবর্তী সময়ে প্রথম বইগুলো পরিমার্জন করে কিশোর উপযোগী করে নতুনভাবে প্রকাশ করা হয়। এখন পর্যন্ত চার শতাধিক বই বেরিয়েছে এদের নিয়ে, চলছে আজও। ফ্র্যাঙ্কলিন ডব্লিউ ডিক্সনের নামে প্রকাশিত হলেও আসলে বইগুলো লিখেছেন অর্ধশতাধিক ভিন্ন ভিন্ন লেখক। উল্লেখযোগ্য বই দ্য সিক্রেট অব দ্য ওল্ড মিল, হান্টিং ফর হিডেন গোল্ড, দ্য মিসিং চামস ইত্যাদি।
ফেমাস ফাইভ
লেখক: এনিড ব্লাইটন ও ক্লদ ভলিয়ের
ব্রিটিশ লেখক এনিড ব্লাইটনের তৈরি করা চারজন কিশোর-কিশোরী ও একটি পোষা কুকুরকে নিয়ে সিরিজ। প্রথম বই ফাইভ অন আ ট্রেজার আইল্যান্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। জীবদ্দশায় এদের নিয়ে ২১টি বই লেখেন ব্লাইটন, তাঁর মৃত্যুর পর সিরিজের দায়িত্ব নেন ফরাসি লেখক ক্লদ ভলিয়ের, তিনি আরও ২৪টি বই লেখেন। উল্লেখযোগ্য বই ফাইভ গোজ টু স্মাগলার্স টপ, ফাইভ অন আ হাইক টুগেদার, ফেমাস ফাইভ ভার্সাস ব্ল্যাক মাস্ক ইত্যাদি। উল্লেখ্য, ফেমাস ফাইভ ছাড়াও সিক্রেট সেভেন, ফাইভ ফাইন্ড-আউটার্স, বার্নি জুনিয়র নামে আরও কয়েকটি কিশোর গোয়েন্দা সিরিজের স্রষ্টা এনিড ব্লাইটন।
ন্যান্সি ড্রু
লেখক: ক্যারোলিন কিন
মার্কিন কিশোরী গোয়েন্দা ন্যান্সি ড্রু। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত হয় সিরিজের প্রথম বই দ্য সিক্রেট অব দ্য ওল্ড ক্লক। সেই সময়ের পটভূমিতে নারী গোয়েন্দা, তা–ও বয়সে কিশোরী কাউকে নিয়ে সিরিজ লেখার বিষয়টি সত্যিই অবাক করার মতো। তবে এই দুঃসাহসী প্রচেষ্টার কারণে ন্যান্সি ড্রু হয়ে ওঠে পৃথিবীজুড়ে হাজারো কিশোরীর স্বপ্নের নায়িকা, তাদের আদর্শ। এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক বই বেরিয়েছে এই সিরিজের, এখনো চলমান সিরিজটি। ঠিক হার্ডি বয়েজ সিরিজের মতো এই সিরিজের বইগুলোও ক্যারোলিন কিনের নামে প্রকাশিত হলেও আসলে আড়ালে রয়েছেন অগণিত ছায়া লেখক। উল্লেখযোগ্য বই দ্য হিডেন স্টেয়ারকেস, দ্য ক্রুকেড ব্যানিস্টার, দ্য মুনস্টোন ক্যাসল মিস্ট্রি ইত্যাদি।
দ্য বক্সকার চিলড্রেন
লেখক: গারট্রুড চ্যান্ডলার ওয়ার্নার
চার ভাই–বোনের কাহিনি। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তাদের আশ্রয় হয় রেলগাড়ির এক পরিত্যক্ত বগি বা বক্সকারে। পরে তাদেরকে খুঁজে বের করেন তাদের দাদু, নিয়ে যান নিজের কাছে। তবে বক্সকার চিলড্রেন পরিচয়টা রয়ে যায় তাদের সঙ্গে। এরাই দাদুর সঙ্গে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে নিত্যনতুন রহস্য ভেদ করে বেড়ায়। প্রথম বই দ্য বক্সকার চিলড্রেন প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত গারট্রুড চ্যান্ডলার ওয়ার্নার লেখেন মাত্র ১৯টি বই। তাঁর মৃত্যুর পর অন্য লেখকেরা লিখতে শুরু করেন, তবে বই প্রকাশিত হতে থাকে ওয়ার্নারের নামেই। এখন পর্যন্ত ১৬২টি বই বেরিয়েছে এই সিরিজে। উল্লেখযোগ্য বই দ্য ইয়েলো হাউস মিস্ট্রি, মিস্ট্রি অব দ্য স্টোলেন স্নোবোর্ড, দ্য ফায়ারহাউস মিস্ট্রি ইত্যাদি।
অয়ন-জিমি
লেখক: ইসমাইল আরমান
আমেরিকার পটভূমিতে রচিত আরেকটি কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ, তবে এটি কোনো বিদেশি সিরিজের অনুকরণ নয়। প্রবাসী বাংলাদেশি কিশোর অয়ন হোসেন ও তার আমেরিকান বন্ধু জিমি পারকারের বিভিন্ন রহস্য সমাধানের কাহিনি এই সিরিজের মূল উপজীব্য। সিরিজের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো ভিক্টোরিয়া ওয়েস্টমোর ওরফে রিয়া নামে একটি দুঃসাহসী মেয়ে। প্রথম বই কালকুক্ষি বেরিয়েছিল ১৯৯২ সালে, সেবা প্রকাশনী থেকে। এখন বের হচ্ছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৫। কিআতেও মোটামুটি নিয়মিতভাবেই প্রকাশিত হয় এদের কাহিনি। উল্লেখযোগ্য বই বিপদের ছয়টি আঙুল, কালো মেঘ, নিশিপতঙ্গ, আজব কারিগর ইত্যাদি।
তিন গোয়েন্দা
লেখক: রকিব হাসান ও শামসুদ্দীন নওয়াব
তর্কাতীতভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। কিশোর পাশা, মুসা আমান ও রবিন মিলফোর্ড নামে আমেরিকায় বসবাসরত তিন কিশোরকে নিয়ে কাহিনি, এ দেশে কয়েকটি প্রজন্মের স্বপ্নের নায়ক এরা। আমেরিকার দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটর্স-এর ছায়া অবলম্বনে শুরু হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করে নিয়েছে, সিরিজে স্থান পেয়েছে গোয়েন্দাগিরির পাশাপাশি অ্যাডভেঞ্চার, হরর—এমনকি ফ্যান্টাসি ধারার কাহিনি। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রকিব হাসানের লেখা প্রথম বই তিন গোয়েন্দা, প্রায় দেড় শ বই লিখে তিনি সাময়িক বিরতি নেন। তারপর শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে বিভিন্ন লেখককে দেওয়া হয় সিরিজটি চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব, যা এখনো চলছে। রকিব হাসানও একপর্যায়ে আবার ফিরে আসেন লেখায়, গোয়েন্দা কিশোর-মুসা-রবিন নামে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করতে থাকেন নতুন বই। এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক বই বেরিয়ে গেছে এই সিরিজে। উল্লেখযোগ্য বই কাকাতুয়া রহস্য, ঘড়ির গোলমাল, জলদস্যুর দ্বীপ ইত্যাদি।
দ্য থ্রি ইনভেস্টিগেটর্স
লেখক: রবার্ট আর্থার ও অন্যান্য
আমেরিকার রকি বিচে বসবাসকারী তিনজন কিশোর গোয়েন্দাকে নিয়ে সিরিজ। তাদের হেডকোয়ার্টার একটি স্যালভেজ ইয়ার্ডের পরিত্যক্ত মোবাইল হোমে। কী, পরিচিত লাগছে? হ্যাঁ, আমাদের দেশের তিন গোয়েন্দা যেখান থেকে অ্যাডাপ্ট করা হয়েছে, এটা সেই সিরিজ। ১৯৬৪ সালে দ্য সিক্রেট অব টেরর ক্যাসল দিয়ে সিরিজটি শুরু করেন রবার্ট আর্থার। ১০টি বই প্রকাশের পর তিনি মারা গেলে অন্য লেখকেরা আরও প্রায় ৫০টি বই লেখেন। তারপর সিরিজটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে অনুমতি নিয়ে এই সিরিজের নতুন বই প্রকাশ পাচ্ছে জার্মান ভাষায়, জার্মানিতে। সেখানে প্রায় ২০০ বই বেরিয়েছে, এখনো বের হচ্ছে। সিরিজের কিছু উল্লেখযোগ্য বই দ্য মিস্ট্রি অব দ্য স্টাটারিং প্যারট, দ্য মিস্ট্রি অব দ্য হুইস্পারিং মামি, দ্য সিক্রেট অব স্কেলেটন আইল্যান্ড ইত্যাদি।
পাণ্ডব গোয়েন্দা
লেখক: ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত পাঁচজন স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে সিরিজ। দলে একটি কুকুরও রয়েছে। কখনো তারা নিজেরাই জড়িয়ে যায়, আবার কখনো অন্যকে সাহায্য করার জন্য তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিযানে। পাণ্ডব গোয়েন্দা প্রথম বেরিয়েছিল সত্তরের দশকে মাসিক শুকতারায়। পরে আনন্দমেলা পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে এদের অনেক কাহিনি। মজার ব্যাপার হলো, লেখক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় কাহিনিগুলোতে আলাদা কোনো নাম দিতেন না, সব কটিই শুধু পাণ্ডব গোয়েন্দা নামে ছাপা হতো। বই হিসেবে প্রকাশের সময় সংখ্যা দিয়ে আলাদা করা হতো কাহিনিগুলোকে। ৩০টির মতো কাহিনি রয়েছে এই সিরিজে, ২০২৩ সালে লেখক মারা যাওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে পাণ্ডবদের অভিযান।
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রাউন
লেখক: ডোনাল্ড জে সোবোল
সবজান্তা এক জিনিয়াস কিশোরকে নিয়ে কাহিনি। তার আসল নাম লিরয় ব্রাউন হলেও জ্ঞানের পরিধির জন্য সবাই তাকে ডাকে এনসাইক্লোপিডিয়া বা বিশ্বকোষ বলে। প্রথম বই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রাউন, বয় ডিটেকটিভ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এই সিরিজে ছায়ালেখকদের অনুপ্রবেশ ঘটেনি, তাই বই বেরিয়েছে মাত্র ২৯টি—সব কটিই লিখেছেন ডোনাল্ড জে সোবোল। অন্যান্য সিরিজের সঙ্গে এই সিরিজের একটি প্রধান পার্থক্য হলো, এতে কোনো উপন্যাস নেই, সবই ছোটগল্প। ফলে ২৯টি বইয়ের এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রাউনের কাহিনি রয়েছে দুই শতাধিক! আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রতিটি কাহিনিতেই কিছু সূত্র দিয়ে প্রথমে পাঠকদেরকে রহস্য সমাধানের সুযোগ দেওয়া হয়, অনেকটা কুইজের মতো; পরে সমাধানটা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রাউনের মাধ্যমে উন্মোচন করা হয়। সিরিজের কিছু জনপ্রিয় বই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রাউন লেন্ডস আ হ্যান্ড, দ্য কেস অব দ্য ট্রেজার হান্ট, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রাউন গেটস হিজ ম্যান ইত্যাদি।