যে বিমান একটানা দুই মাস আকাশে উড়েছিল

বিমানটি একটানা উড়ে চলে ২ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার

১৯৫৮ সালে অদ্ভুত এক বিমানযাত্রা শুরু করেন দুই আমেরিকান। রবার্ট টিম ও জন কুক ঠিক করলেন চার আসনবিশিষ্ট একটি সেসনা ১৭২ বিমান নিয়ে যত দিন সম্ভব, মরুভূমির ওপরে টানা উড়ে চলবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিমান নিয়ে আকাশে উড়াল দিলেন দুজন। আকাশেই কাটিয়েছেন একটানা ৬৪ দিন ২২ ঘণ্টা ১৯ মিনিট। একবারও না নেমে উড়ে চলেছেন দুই মাস। লাস ভেগাসের বাইরে মরুভূমির চারপাশে এই যাত্রায় তাঁরা অতিক্রম করেন ২ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার।

পৃথিবীর চারপাশে প্রায় ছয়বার ঘুরলে এই দূরত্ব পাওয়া যাবে। ১৫ বার অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গেলে এই দূরত্ব অতিক্রম করা যাবে। এই যাত্রায় একবারের জন্যও থামেননি দুই পাইলট। মাটি স্পর্শ করেনি বিমানের চাকা। এটি এমন একটি রেকর্ড, যা আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে, এখনো এটি সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ওড়ার বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে টিকে আছে।

যেভাবে শুরু

যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে হাসিয়েন্ডা নামের একটি হোটেল ছিল। হোটেলের প্রচারণার জন্য ভিন্ন কিছু করতে চেয়েছিলেন হাসিয়েন্ডার মালিক। অদ্ভুত এক আইডিয়া নিয়ে এলেন রবার্ট টিম। হাসিয়েন্ডায় স্লট মেশিনের মেকানিক হিসেবে কাজ করতেন তিনি। টিম বললেন, একটা বিমানের গায়ে হোটেলের নাম লিখে একটি রেকর্ড গড়ার চেষ্টা করা যায়। দীর্ঘ সময় আকাশে আকাশে উড়লে মানুষের নজর কাড়বে বিমানটি। আলোচনা-সমালোচনায় হবে ব্যাপক প্রচারণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমারু বিমানের পাইলট ছিলেন টিম। তাঁর আইডিয়া মনে ধরে হাসিয়েন্ডা হোটেল মালিকের। বিমানযাত্রার জন্য অর্থ খরচ করতে রাজি হন তিনি।

ট্যাংকে পাম্প লাগিয়ে ট্রাক থেকে পাইপ দিয়ে সংগ্রহ করা হতো জ্বালানি
ছবি: সিএনএন

পছন্দমতো একটি সেসনা ১৭২ মডেলের বিমান খুঁজে বের করলেন টিম। বিমানটি মেরামত করার জন্য পেয়ে গেলেন একজন বিশ্বস্ত কারিগর। এক বছর লাগবে বিমানটিকে দীর্ঘ যাত্রার উপযোগী করে তুলতে। মূল ট্যাংকে ৯৫ গ্যালন জ্বালানি রাখা যেত। ট্যাংকে বদল আনলেন টিম। এয়ারবাসের মতো করে সেসনা বিমানের ডানায় যুক্ত করলেন অতিরিক্ত ৪৭ গ্যালনের একটি জ্বালানি ট্যাংক। ডানার ট্যাংক থেকে মূল ট্যাংকে জ্বালানি পাঠানোর জন্য ছিল বৈদ্যুতিক পাম্প। ইঞ্জিন বন্ধ না করেই তেল এবং ফিল্টার পরিবর্তন করার জন্য তেলের লাইনগুলো নতুন করে লাগিয়েছিলেন।

এবার দরকার একজন সহ–পাইলট। কিন্তু মনের মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না টিম। তিনবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর খোঁজ মিলল বিমানচালক জন কুকের। বিমান ঠিকঠাক করার কাজটাও পারেন তিনি। শেষমেশ ১৯৫৮ সালের ৪ ডিসেম্বর ৩টা ৫২ মিনিটে যাত্রা শুরু করেন টিম আর জন। তাঁরা যেন গোপনে কোথাও অবতরণ করার সুযোগ না পান, সে জন্য একটি চাকায় রং করে রাখা হয়েছিল। অবতরণ করলে ঘষা লেগে হালকা হয়ে যাবে চাকার রং।

বেশির ভাগ সময় লাস ভেগাসের চারপাশে মরুভূমির ওপর দিয়ে উড়ে বেড়িয়েছে বিমানটি। টিভির প্রচারণা পাওয়ার আশায় কখনো তাঁরা লস অ্যাঞ্জেলেসের ওপরেও উড়েছেন। জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে জ্বালানি রিফিল করার বুদ্ধিটা ছিল অসাধারণ। প্রতিদিন দুবার বিমানের জ্বালানি ট্যাংক রিফিল করা হতো। ট্যাংকে পাম্প লাগিয়ে ট্রাক থেকে পাইপ দিয়ে সংগ্রহ করা হতো জ্বালানি। জ্বালানি নিতে বন্ধ রাখা হতো একটা মহাসড়ক। বিমান আর জ্বালানি বহনকারী ট্রাক সমগতিতে চলত সেই মহাসড়কে। এই ফাঁকে বিমান থেকে পাইপ নামিয়ে ফুয়েল সংগ্রহ করতেন দুই পাইলট। সময় লাগত প্রায় তিন মিনিট। দুই মাসের এই যাত্রায় তাঁদের ১২৮ বার ফুয়েল নিতে হয়েছে।

টিম আর কুকের জন্য হোটেল থেকে খাবার আসত হোটেল থেকে। থার্মাল জগে খাবারগুলো টুকরা করে রাখা হতো। খাবার গরম রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা।

২৯ দিন ওড়ার পর বিমানটির জেনারেটর নষ্ট হয়ে যায়। কোনো লাইট, হিটার এমনকি জ্বালানি পাম্পও ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। ট্রাক থেকে জ্বালানি নেওয়ার জন্য হাত দিয়ে চালানো পাম্পের ওপর নির্ভর করতে হতো। তাঁরা অন্ধকারে জ্বালানি সংগ্রহ করতেন চাঁদের আলো বা কোনো লাইটের আলো ছাড়াই। তারপরও রেকর্ড গড়ার আশায় যতক্ষণ সম্ভব ওড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে কার্বন দিয়ে অনেকটা ভরে যায় বিমানের স্পার্ক প্লাগ এবং জ্বালানি পোড়ানোর চেম্বার। এতে জ্বালানিসহ সম্পূর্ণ ভার নিয়ে ওড়া কঠিন হয়ে পড়ে।

একটানা দুই মাস ওড়ায় ব্যাপক আলোচিত হয় ঘটনাটি

৭ ফেব্রুয়ারি অবতরণ করার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। অবতরণ করার আগেই বিমানের চাকার রং পরীক্ষা করে দেখা যায়, আগের মতোই আছে রং। বিমানটি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে একবারও অবতরণ করেনি। একটানা দুই মাস ওড়ায় ব্যাপক আলোচিত হয় ঘটনাটি। মানুষের মাথায় স্থান করে নেয় হাসিয়েন্ডা হোটেলের নাম।

১৯৭৬ সালে রবার্ট টিম এবং ১৯৯৫ সালে জন কুক লাস ভেগাসে মারা যান। আর হাসিয়েন্ডা হোটেলটিও ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে ভেঙে ফেলা হয়।

আরও কিছু রেকর্ড

৩০ দিন বা বেশি সময় অবতরণ না করে উড়ে চলার চারটি গল্প রয়েছে। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় এই বিমানগুলো উড়ে চলে। প্রথম চেষ্টা ছিল ওয়েস ক্যারল এবং ক্লাইড স্লিপার নামে দুজন পাইলটের। একটি পাইপার জে থ্রি কাব ফ্লোটপ্লেনে ৩০ দিন বিরতিহীনভাবে উড়েছিলেন তাঁরা।

১৯৪৯ সালে দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথম ঘটনাটি ১৫ মার্চ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। ডিক রিডেল এবং বিল ব্যারিস একটি অ্যারনকা ১৫ এ সি সেডানে উড়েছিলেন ৪২ দিন ধরে। ২৪ আগস্ট থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত, ৪৬ দিন ধরে উড়েছিলেন বব উডহাউস এবং উডি জংওয়ার্ড। অ্যারিজোনা থেকে তাঁরা যাত্রা করেছিলেন। অ্যারঙ্কা ১৫ এ সি সেডান বিমান ব্যবহার করেছিলেন তাঁরা।

১৯৫৮ সালের ২ আগস্ট থেকে ২১ সেপ্টেম্বর উড়েছিলেন জিম হেথ এবং বিল বুরখার্ট। সেসনা ১৭২ ব্যবহার করে ৫০ দিন উড়েছেন তাঁরা।

কখনো যদি দীর্ঘ যাত্রায় তোমার ক্লান্তি আসে, তবে মনে রেখো, দুজন পাগলাটে লোক দুই মাস একটানা আকাশে উড়েছিলেন।