কমিকসের কারখানা

বই পড়তে ভালো লাগে না এমন মানুষ তুমি হয়তো আশপাশেই খুঁজে পাবে। কিন্তু কমিকস পড়তে পছন্দ করে না, এমন কাউকে খুঁজে পেতে বেশ কষ্টই করতে হবে তোমাকে। অল্প সংলাপ আর রঙিন ছবির দুর্দান্ত কমিকস একবার পেলে বাকি সব ভুলে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। একেবারে ছোট যারা, হয়তো সবে বানান করে পড়া শুরু করেছে, তারাও ডুবে যায় কমিকসে। অনেকের তো বই পড়ার অভ্যাসটাই শুরু হয় কমিকস দিয়ে।

কমিকস মানেই বাচ্চাদের বই—এ ধারণা এখন বদলে গেছে। বিশ্বজুড়ে সব বয়সী পাঠকের কাছেই প্রিয় কমিকস, গ্রাফিকস নভেল। কমিকসের সঙ্গে গ্রাফিকস নভেলের মূল পার্থক্যটা আকারে। গ্রাফিকস নভেলের বিস্তৃতি বেশ লম্বা। অনেকটা উপন্যাস আর ছোটগল্পের যে পার্থক্য, তার মতো। গ্রাফিকস নভেল মূলত একটু সমঝদার পাঠকের জন্য। সারা বিশ্বেই কমিকস, গ্রাফিকস নভেল দারুণ জনপ্রিয়। সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যানের মতো অসংখ্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে কমিকস থেকে।

বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশেও চলছে কমিকস বিপ্লব। ধীরে ধীরে বাংলা কমিকস সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে ঢাকা কমিকস ও মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও। অল্প কিছুদিনে তাদের অর্জনটাও কম নয়।

ঢাকা কমিকসের শুরুটা নিউ এজ-এর সিনিয়র পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট ও উন্মাদের সহকারী সম্পাদক মেহেদী হকের হাত ধরে। শত চেষ্টার পরও যখন কোনো প্রকাশকই কমিকস ছাপাচ্ছিলেন না, তখন বাংলাদেশের কার্টুন গুরু আহসান হাবীবের উপদেশে তিনি নিজেই দুঃসাহসী হয়ে প্রকাশনী খুলে ফেললেন ঢাকা কমিকস নামে। ২০১৩ সালের বইমেলায় ভিন্ন স্বাদের কমিকস এনে সাড়া ফেলে দেয় ঢাকা কমিকস।

সাইফাই, হরর, ছোটদের কমিকস থেকে রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার, রোমাঞ্চ, সায়েন্স কমিকস পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের কমিকসই করেছে ঢাকা কমিকস। ছোট-বড় সব পাঠকের জন্যই আছে নানা স্বাদের কমিকস। নতুন কমিকসের পাশাপাশি মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে সাইফাই কমিকস রুহান রুহান কিংবা কাজী আনোয়ার হোসেনের পঞ্চ রোমাঞ্চ অবলম্বনেও কমিকস প্রকাশ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ঢাকা কমিকস থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন কমিকসের চরিত্র

শুধু বইমেলার জন্যই নয়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য নামমাত্র মূল্যে সচেতনতামূলক কমিকস এঁকেছে ঢাকা কমিকস টিম। বাংলা কমিকসে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পেয়েছে পশ্চিম বাংলার নারায়ণ দেবনাথ কমিকস পুরস্কারও। নন্টে ফন্টের স্রষ্টা কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী স্বয়ং নারায়ণ দেবনাথের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহন করেছেন মেহেদী হক। মেহেদী হক বলেন, ‘আমার ড্রিম প্রজেক্ট ছিল বাংলায় ভালো কমিকস করার। এই কমিকস প্রকাশ করতে গিয়ে অসংখ্য জায়গা থেকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে, কেউ যখন কমিকস ছাপার ঝুঁকি নিতে চাচ্ছিল না, বাধ্য হয়ে নিজেই প্রকাশনা শুরু করেছি। এরপর পাঠকদের সাড়া পেয়েছি অপ্রত্যাশিত রকমের ভালো। আগে আমাদের স্টল দেওয়া হতো না, দুই বছর ধরে ঢাকা কমিকস নিজেরাই স্টল পাচ্ছে। আবার এখন অনেক প্রকাশনীও কমিকস করছে অথবা করতে চাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা বেশ চমৎকার, বাংলাদেশের কমিক বুক শিল্প এখন খুবই সম্ভাবনাময়।’

কমিকসের পাশাপাশি অ্যানিমেশনের কাজও করছে ঢাকা কমিকস। এ বছরের বইমেলায় পাঁচটি নতুন বইয়ের পাশাপাশি একটি ‘মোশন কমিকস’ তৈরির পরিকল্পনাও আছে তাদের।

২০১৭ বইমেলা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে নতুন লেখক ও আঁকিয়েদের আঁকা-লেখায় ‘নবীন সিরিজ’। এখন পর্যন্ত এই সিরিজের দুটি বই বের হয়েছে। নতুন কমিকস লেখক-আঁকিয়েরা চাইলে তাদের কাজ নিয়ে ঢাকা কমিকসের(ফেসবুক পেজে) সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। তাদের জন্য মেহেদী হকের পরামর্শ হলো, কোনো একটা গল্প নিয়ে কাজ শুরু করে যেভাবেই হোক কাজটা শেষ করা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সহজ খ্যাতির জন্য না আঁকা।

বাংলাদেশে কমিকস বিপ্লবের আরেক অংশীদার মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওস। একদম দেশি সুপারহিরো ‘শাবাশ’ দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল মাইটি পাঞ্চের, ইংরেজি ভাষায়। পার্ট টাইম সাংবাদিক আর ফুলটাইম সুপারহিরো শাবাশের বাস আমাদের এই ঢাকা শহরেই, তাই প্রতিবারই বড় বড় ভিলেনের পাশাপাশি যানজট, গরম, মানুষের হইচইসহ নিত্যদিনের মজার সব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তাকে। অ্যাকশন-গ্যাগ-কমেডি ধাঁচের এই কমিকস সিরিজে শাবাশ ছাড়াও আছে স্কুলপড়ুয়া জিনিয়াস কিরণ, পাগলা বিজ্ঞানী প্রফেসর কেরামতি, আরেক রাশভারী সুপারহিরো ক্যাপ্টেন কাঁঠালসহ আরও অনেকে। এ পর্যন্ত শাবাশের নয়টি কমিকস বেরিয়েছে। এর মধ্যে একটি বই আবার প্যারালাল ইউনিভার্সের শাবাশের নারী কাউন্টারপার্ট ‘মিস শাবাশ’কে নিয়ে। এ ছাড়া এই উপমহাদেশের সব রূপকথা, উপকথা আর পুরাণকে এক করে নতুন বিশ্ব নিয়ে কমিকস সিরিজ ‘লাঠিয়াল’, এখানেও শক্তিশালী নারী চরিত্র দিয়ে বাঁধাধরা চিন্তাভাবনা ভাঙতে চেয়েছে মাইটি পাঞ্চ।

মাইটি পাঞ্চ স্টুডিওস থেকে প্রকাশিত কমিকস

মাইটি পাঞ্চ স্টুডিও অ্যানিমেশন, কনসেপ্ট আর্ট নিয়ে কাজ করে। প্রতিষ্ঠাতা ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর সামির আসরান রহমান বলেন, ‘আমি সব সময় চাইতাম আমার প্রিয় মাধ্যমে গল্পটা বলতে, চাইতাম আমাদেরও ভীষণ মজার আর রঙিন সব চরিত্র থাকবে। মাইটি পাঞ্চ থেকে আমরা সেটাই করছি, রঙিন মজার মজার কমিকস হওয়ায় ছোটরাও পছন্দ করে, আবার প্রচুর স্যাটায়ার থাকায় যেকোনো বয়সীরাই পড়ে মজা পায়।’

মাইটি পাঞ্চের সব কটি কমিকস ইংরেজিতে হলেও গত বইমেলায় ইগনাইট প্রকাশনী থেকে বাংলায় শাবাশের ভলিউম ১ ও ভলিউম ২ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে কাজ চলছে শাবাশের নতুন কমিকস নিয়ে। এর সঙ্গে কাজ চলছে ক্যাপ্টেন কাঁঠালের অ্যানিমেটেড শর্টফিল্মের ওপর, আর মিস শাবাশ নিয়েও সামনে অ্যানিমেশনের পরিকল্পনা আছে।

বাংলাদেশি কমিকস নিয়ে এত কিছু পড়ে যদি মনে হয়, বা রে কমিকসটাই তো পড়া হলো না—তাহলে আগামী বইমেলায় ঘুরে এসো ঢাকা কমিকস আর ইগনাইট পাবলিকেশনসের স্টল থেকে। হয়তো লেখক-আঁকিয়েদের সঙ্গে দেখাও হয়ে যেতে পারে। আর কে জানে, এত সব কমিকসের কাণ্ডকারখানা দেখে উৎসাহী হয়ে নিজেই হয়ে যেতে পারো কমিকস আঁকিয়ে, হয়তো সামনের বইমেলায় তোমার কমিকসই পাওয়া যাবে ঢাকা কমিকস বা মাইটি পাঞ্চের স্টলে!