দুষ্টু নন্টে

আমি আর আমার ছোট বোন অনেক দিন ধরে বাবার কাছে আবদার করছিলাম একটা গোল্ডেন রিট্রাইভার জাতের কুকুরের বাচ্চা কারও কাছ থেকে এনে দেওয়ার জন্য (আমরা পশুপাখি ক্রয়–বিক্রয়ের বিপক্ষে)। হঠাৎ একদিন দেখি, বাবা অফিস থেকে একটা খাঁচা নিয়ে বাসায় ঢুকেছে। প্রথম দেখায় খাঁচার ভেতর পায়চারি করে বেড়ানো ধূসর জন্তুটাকে আমরা কাঠবিড়ালি ভাবলাম। আব্বু সেটা শুনে হো হো করে হেসে বলল, ‘আরে বোকা, এটা একটা বিড়াল। পার্সিয়ান ক্যাট। তোমাদের সালাউদ্দিন আঙ্কেল (বাবার বন্ধু) তোমাদের জন্য দিয়েছে।’ এরপর বেশ কিছু সময় আমাদের কাটল খাঁচার ভেতরের জন্তুটার পিছে ঘুরে ঘুরে। গায়ের ধূসর রঙের কারণে ভাবলাম, নাম রাখব ‘অ্যাশ’। তবে কিছুক্ষণেই আমরা বুঝে গেলাম, এই বিড়ালটা হয় অন্তর্মুখী, নয়তো সে লাজুক, অথবা তার অহংকার অনেক। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে আমি নাম দিতে চাইলাম ‘সম্রাট’। এই রাশভারী নাম নিয়ে কিছুদিন আমার আর আমার বোনের বন্ধুমহলে বেশ হাসাহাসি হলো। তবে আমরা টের পেলাম, এই বিড়াল আসলেই সম্রাটের মতো। দেশি মাছ আর মুরগি দিলে চেখেও দেখে না, তার জন্য বিশেষ ক্যাটফুড আনাতে হয়, মানুষের কোলে থাকতে পছন্দ করে না, হেলেদুলে হেঁটে চলে। প্রায় সারা দিন হাই তোলে আর ঘুমায়। ঘুমানোর জায়গাগুলোও উদ্ভট। আমার পড়ার টেবিলে বইয়ের ওপর, বিভিন্ন আসবাবের ড্রয়ার খুলে তার ভেতর, পুরোনো শীতের কাপড়ের ওপর—আরও কত কী!

আমরা ওর নাম পাল্টে ‘লিও’ রাখলাম। লিও আমাদের বাসায় শুধু আমার বাবা, মা আর নাইমকেই (গৃহকর্মে সহায়তাকারী) পছন্দ করে। কারণ, ওরা লিওকে খাবার দেয়। আমি লিওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখি আর বোন মৌনতা ঘষেমেজে গোসল করিয়ে দেয়, এ জন্য আমাদের দুই বোনকে দেখতেই পারে না লিও। আমরা আশপাশে থাকলেই আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়। অথচ বাবা অফিস থেকে আসার আধা ঘণ্টা আগে থেকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে তার প্রতীক্ষায়। এদিকে আমার বোন ওর এক বন্ধু মোহরের কাছ থেকে দুটি দেশি বিড়াল নিয়ে আসে, যারা ভাই–বোন। ভাইটার রং সাদা-কমলা আর বোনটার রং সাদা-কালো-কমলা। এই তিন রঙের বিড়ালদের ক্যালিকো ক্যাট বলে। আমাদের মা ভাইটার নাম দিল নন্টে আর বোনটার নাম দিল ফন্টে। নন্টে–ফন্টের স্বভাবচরিত্র লিওর একদম বিপরীত। ওরা সারা দিন দুষ্টুমিতে মশগুল থাকে। নখ দিয়ে বেয়ে বেয়ে দেয়াল দিয়ে উঠে প্রায় সিলিং ছুঁয়ে ফেলে, খামচে বালিশের তুলা বের করে ফেলে। একটি আরেকটির পেছনে ধাওয়া করে, খাবার দিলে কাড়াকাড়ি করে খায়। ওদের কারণে লিওর ভাগ্যে কম খাবার জোটে। নন্টে-ফন্টের মধ্যে এক অটুট বন্ধন, একসঙ্গে সারা দিন সারা বাড়ি দৌড়ে–দাপিয়ে বেড়ায়, ঠিক যেন পার্টনার ইন ক্রাইম। লিও দুই থাবার মাঝখানে মুখ রেখে এমন হতাশভাবে তাকায়, যেন ওরা গ্রামের চাচাতো ভাইবোন। একদিন নন্টে কয়েক দিন বাসার বাইরে থাকায় ফন্টে অনেক অসহায় হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। নন্টে ফিরে আসার পর দুজনের আনন্দে যা লাফালাফি!

একদিন নন্টে কোথা থেকে জানি একটা পাখি শিকার করে আনল। বাবা একদম খেপে গিয়ে বলল, ‘এমন দুষ্টু বিড়াল বাসায় রাখা যাবে না। বেচারা পাখিটা বাঁচবে কি না, কে জানে!’ বকা খাওয়ার পর দুধভাত খেয়ে ফন্টের গায়ে গা এলিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নন্টে। আব্বু বলল, ‘দুষ্টামি করে, তা–ও আবার দুই ভাই–বোন কিউট করে ঘুমায়। যতই অতিষ্ঠ করুক, এদের তো বাসা থেকে বের করে দিতেও খারাপ লাগবে!’

বিড়াল প্রজাতিটাই খুব কৌতূহলোদ্দীপক, একেক বিড়ালের স্বভাব–চরিত্র একেক রকম আর এটা পর্যবেক্ষণের মজাই আলাদা। আমার বাসায় তিন–তিনটা বিড়াল থাকায় আমি এই মজা থেকে বঞ্চিত হই না!