ইতিহাসে আগে কেউ দেখেনি, এমন রং আবিষ্কার করেছে বিজ্ঞানীরা
১৯০০ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল উইজার্ড অব ওজ’-এ লেখক ফ্র্যাঙ্ক বাউম এমন এক লোকের গল্প বলেছিলেন, যে মায়ার সাহায্যে ‘ওজ’ নামের কল্পিত শহরের বাসিন্দাদের বোকা বানাত। সে এমনভাবে নিজেকে প্রকাশ করত, যেন সে এক মহান জাদুকর। গল্পে বলা হয়, এমেরাল্ড সিটি এত উজ্জ্বল ও ঝলমলে যে দর্শকদের বিশেষ চশমা পরতে হয় চোখ বাঁচানোর জন্য। আসলে সেই চশমাই ছিল জাদুকরের চালাকি। এই চশমার কারণেই শহরটিকে আরও সবুজ ও রাজকীয় দেখাত।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন যে তাঁরা একটি নতুন রং আবিষ্কার করেছেন। প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া এই রং মানুষ দেখতে পারে না। এই রং দেখতে লেজার প্রযুক্তির সাহায্য লাগে। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন ‘ওলো’। লেজার রশ্মি চোখে নিক্ষেপ করে রংটি দেখা যায়। যন্ত্রটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘দ্য উইজার্ড অব ওজ’ গল্প থেকে।
এখন পর্যন্ত পাঁচজন মানুষ ওলো রং দেখেছেন। তাঁরা সবাই বলেছেন যে এটি দেখতে টিল রঙের মতো। টিল হলো একটি নীলচে সবুজ রং, যাকে প্রায়ই গাঢ় সায়ান বা নীলাভ সবুজ রং হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, বার্কলে ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপকেরা ১৮ এপ্রিল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে একটি আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করেন। সেখানে তাঁরা ওলো রঙের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এই রং মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে। গবেষকেরা এই প্রযুক্তির নাম দিয়েছেন ‘ওজ’। এই প্রযুক্তি মানুষের চোখকে বিভ্রান্ত করে।
এই ধারণা যাচাইয়ের জন্য ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে স্নায়ুবিজ্ঞান ও এআই গবেষক প্যাট্রিক মাইনো একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছিলেন। যেখানে ব্যবহারকারীরা মজা করে পরীক্ষা দিতে পারেন যে তাঁদের রং বোঝার অভিজ্ঞতা অন্যদের তুলনায় কেমন। রং দেখার ভিন্নতায় তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
মানুষের চোখ রং অনুভব করে রেটিনায় থাকা তিন ধরনের আলোকসংবেদী কোষ বা ‘কোন কোষ’-এর মাধ্যমে। ‘এস’ কোন কোষগুলো ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের নীল আলোর সংকেত শনাক্ত করে। ‘এম’ কোন কোষগুলো মাঝারি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সবুজ আলোর সংকেত শনাক্ত করে। ‘এল’ কোন কোষগুলো বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল আলোর সংকেত শনাক্ত করে।
কোন কোষগুলোর সংকেত রেটিনার ভেতরে সুগঠিত হয় এবং স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে যায়। এই তথ্য মস্তিষ্কের যে অংশে পাঠানো হয়, তাকে বলে ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স। ‘এম’ কোষের প্রভাব পাশের ‘এস’ ও ‘এল’ কোষের সঙ্গে ওভারল্যাপ করে। এমন কোনো আলো নেই যা শুধু ‘এম’ কোষকে উদ্দীপ্ত করে। যখন ‘এম’ কোষ সক্রিয় হয়, তখন এস ও এল কোষও আংশিক সক্রিয় হয়।
ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, বার্কলের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক রেন এনজি এক নিবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন, পৃথিবীতে এমন কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্য নেই, যা শুধু ‘এম’ কোষকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। এই গবেষক দল ভাবতে শুরু করে, যদি কেবল ‘এম’ কোষকে উদ্দীপ্ত করা যেত, তাহলে তা দেখতে কেমন হতো? সম্ভবত এটা হতো সবচেয়ে গভীর সবুজ, যা কখনো দেখা যায়নি।
এ কারণে ‘ওজ’ প্রযুক্তির সহ-উদ্ভাবক এবং বার্কলের অপটোমেট্রি অ্যান্ড ভিশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক অস্টিন রুরডার সঙ্গে এই গবেষক দলের গবেষকেরা কাজ শুরু করেন। রুরডা জানান, ওজ এমন একটি প্রযুক্তি, যা ‘দেখার ক্ষেত্রে রেটিনার জন্য একরকম মাইক্রোস্কোপের মতো’। এটি অতি ক্ষুদ্র মাত্রার লেজার আলো ব্যবহার করে চোখের নির্দিষ্ট আলোকসংবেদী অংশকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। এই যন্ত্র ব্যবহারের সময় অত্যন্ত স্থিতিশীল থাকতে হয়। এটি এরই মধ্যে চোখের রোগের গবেষণায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
ওজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। তখন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি, বার্কলের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কম্পিউটার সায়েন্সের ডক্টরাল ছাত্র জেমস কার্ল ফং এই গবেষণায় যুক্ত হন। বার্কলের আরেক ডক্টরাল ছাত্র হ্যানা ডয়েল পরীক্ষাগুলো পরিচালনা করেন। তাঁদের কাজের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে নতুন রং ওলো দেখা সম্ভব হয়।
তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিজ্ঞানীদের দাবি অনুযায়ী ‘ওলো’ কি সত্যিই নতুন কোনো রং? ওলোর এই শেড আসলে আগে থেকেই ছিল। শুধু মানুষের চোখ সেটা দেখতে পেত না। কারণ, এটি মানুষের দৃশ্যমান আলোকসীমার বাইরে। এমন আরও অনেক শেড বা রং আছে যা আমরা দেখতে পারি না। তাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওলো কোনো নতুনভাবে সৃষ্টি হওয়া রং নয়।
তবে প্রযুক্তির সাহায্যে আগে দেখা যেত না, এমন রং দেখার ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে সেটিকে নতুন রং বলাই যায়। এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচজন এই ‘নতুন’ রংটি দেখেছেন। যাঁদের চারজন পুরুষ এবং একজন নারী। তাঁদের সবার রং দেখার ক্ষমতা ছিল স্বাভাবিক।
এই পাঁচজনের মধ্যে তিনজন গবেষণাপত্রের সহলেখক। বাকি দুজন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির ল্যাবের সদস্য, যাঁরা গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগে জানতেন না এবং গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন। যাঁরা ওলো দেখেছেন, তাঁরা এটিকে টিল (teal) বা সবুজ-নীল রঙের মতো বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এটি এমন এক ধরনের শেড, যা আগে কখনো দেখেননি।
শিগগিরই কোনো স্মার্টফোনের ডিসপ্লে বা টিভিতে ওলো দেখা সম্ভব হবে না। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির (ভিআর) হেডসেট প্রযুক্তির মাধ্যমেও এই রং দেখা সম্ভব হওয়া অনেক দূরের বিষয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বর্ণান্ধদের এই রং সাহায্য করবে কি না, তা নির্ভর করে, ব্যক্তি কেমন ধরনের বর্ণান্ধ তার ওপর। ডিউটারানোম্যালি হলো সবচেয়ে সাধারণ বর্ণান্ধের ধরন, যেখানে মানুষের সবুজ আলো দেখার সংবেদনশীলতা কমে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, মানুষ কীভাবে রং ‘দেখে’? গবেষকেরা বলছেন, রঙের ধারণার তিনটি প্রধান উপাদান আছে। প্রথমত, ভৌত উপাদান যা চোখে পৌঁছানো আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত; দ্বিতীয়ত, স্নায়ুবিজ্ঞানের উপাদান। এটি আলোর সংকেতকে জৈবিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ করে। তৃতীয়ত, ভাষাগত উপাদান। ভাষার মাধ্যমে রঙের নামকরণ করা হয়। একটি রং দেখে কারও কাছে মনে হলো এটি ‘লাল’। অন্য কেউ একে ‘রট’ বা ‘রুজ’ বলতে পারে। আবার কেউ একটু গভীরভাবে দেখে বলতে পারে, না, এটা ‘ক্ল্যারেট’ বা ‘ক্রিমসন’।
এই ধারণা যাচাইয়ের জন্য ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে স্নায়ুবিজ্ঞান ও এআই গবেষক প্যাট্রিক মাইনো একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছিলেন। যেখানে ব্যবহারকারীরা মজা করে পরীক্ষা দিতে পারেন যে তাঁদের রং বোঝার অভিজ্ঞতা অন্যদের তুলনায় কেমন। রং দেখার ভিন্নতায় তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ২০১৫ সালে একটি পোশাকের ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতভেদ তৈরি হয়েছিল। কেউ বলছিল, পোশাকটি সাদা ও সোনালি, আবার কেউ বলছিল এটি নীল ও কালো। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই মতপার্থক্য হওয়ার কারণ, মানুষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ধারণা করেছে, ছবিটি উষ্ণ আলোয় তোলা হয়েছে নাকি ঠান্ডা আলোয়? সেই অনুযায়ী রং ভিন্ন মনে হয়েছে।
জেনে রেখো, মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীও রং দেখে। মানুষ তিনটি তরঙ্গদৈর্ঘ্য (লাল, নীল ও সবুজ আলো) প্রক্রিয়াজাত করে। মানুষের চোখ দুটি রং মিশিয়ে মাঝামাঝি একটি রং অনুভব করতে পারে। যেমন লাল ও নীল মিশিয়ে বেগুনি। অন্যদিকে, কুকুরের চোখে মাত্র দুই ধরনের কোন কোষ থাকে। তাই কুকুর মূলত হলুদ ও নীলের শেডগুলোই দেখতে পায়।
সামনে এমন প্রযুক্তি হয়তো আবিষ্কৃত হবে, মানুষ ওলোর মতো আরও বিচিত্র সব রং দেখার সক্ষমতা অর্জন করবে। এমন সব রং, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি।