ভয়ানক এক স্কিইংয়ের গল্প

পাকিস্তান ও চীনের সীমান্তজুড়ে বিস্তৃত পর্বতমালাটির নাম কারাকোরাম। যেন আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুক্ষ দুর্গের মতো। কারাকোরামেরই একটি শৃঙ্গ কেটু, যার উচ্চতা প্রায় ২৮ হাজার ২৫১ ফুট। এভারেস্টের পর কেটুই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। তবে এভারেস্টের চেয়ে এটি বেশি দুর্গম, বিপজ্জনক আর খাড়া। পরিসংখ্যান বলে, কেটু জয় করতে আসা প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজন মারা যান। বরফে মোড়া পাথুরে পথ, ঝুলন্ত হিমবাহ, হুট করে নামা ধস, অক্সিজেনের ঘাটতি, মেরে ফেলার মতো তীব্র ঠান্ডা আর অনবরত হতে থাকা হারিকেনের মতো তীব্র ঝড়। বোঝাই যাচ্ছে, কী ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদ পাতা আছে সেখানে! এমন একটা শৃঙ্গে আরোহণ রীতিমতো দুঃসাহসী ব্যাপার। আর সেখানে স্কি করার কথা মাথায় আনাটা স্রেফ পাগলামি! সত্যি যদি কেউ স্কি করতে নামেন ওখানে, তাহলে তার কথা রেকর্ডবুকে থাকা উচিত। আন্দ্রে বারগেল সেই রেকর্ডবুকের এক দুর্লভ নাম।

এত দুর্গম বলে কেউ যে কেটুতে স্কি করার সাহস দেখাননি, তা নয়। প্রায় ২৫ বছর ধরে নামকরা স্কিইয়াররা চেষ্টা করে গেছেন সেখানে একক নৈপুণ্যে সম্পূর্ণ স্কি করার। প্রতিবারই পুরস্কার হিসেবে বরণ করে নিতে হয়েছে মৃত্যুকে। হ্যান্স কামারল্যান্ডার ছিলেন মাউন্ট এভারেস্টে সম্পূর্ণ স্কি করা প্রথম মানুষ, তিনি পর্যন্ত এখানে এসে স্কি করতে গিয়ে পিছিয়ে গেছেন সহযাত্রীকে গিরিখাদে পড়ে যেতে দেখে। ২০০৯ সালে মিখেল ফেইটকে জীবন দিতে হয়েছিল ঘুরতে গিয়ে পিছলে যাওয়ার কারণে। সঙ্গে থাকা সহযাত্রী ফ্রেডরিক এরিকসন স্বচক্ষে দেখেছিলেন ফেইটের পড়ে যাওয়া, হাজার হাজার ফুট নিচের বরফের পাথুরে দেয়ালে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন ফেইট। জেদ চেপে গিয়েছিল এরিকসনের। সাহস জুগিয়ে জুগিয়ে পরের বছর আবার ফিরেছিলেন কেটুর পুরোটা স্কি করতে, পারেননি। ৪০০ মিটার দূরে থাকতে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁরও।

দুবারের ওয়ার্ল্ড স্কিইং চ্যাম্পিয়ন ক্রিস ড্যাভেনপোর্ট অকপটে বলেছেন, ‘কয়েকজন শ্রেষ্ঠ মাউন্টেইন স্কিইয়ার পর্যন্ত কেটুতে মারা গেছেন, সে কারণেই ওখানে পুরোপুরি স্কিইং করতে পারেননি কেউ।’

৩০ বছর বয়সী পোলিশ স্কিইয়ার আন্দ্রে বারগেলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৪তম সর্বোচ্চ পর্বত শিশাপাংমার ৮ হাজার মিটার উচ্চতায় এবং অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত মানাসলুতে স্কিইং করে। তারপর থেকে সুবিশাল কারাকোরাম কেটু পর্বতের দুঃসাধ্য স্কিইং সম্পূর্ণ করাটা তাঁর স্বপ্ন।

২০১৭ সালে কেটুতে স্কি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন বারগেল। ২০০০ সালে এভারেস্টের চূড়া থেকে নিচ পর্যন্ত স্কি করা প্রথম মানব স্লোভেনীয় দাভো কারনিয়ারও একই ইচ্ছা পোষণ করেন। পোড় খাওয়া এই স্কিইয়ার অবশ্য কেটুতে স্কির চেষ্টা করা প্রথম মানুষ ছিলেন, ১৯৯৩ সালের সেই অভিযান সম্পূর্ণ করা যায়নি বাতাসের কারণে। ভাগ্য ভালো ছিল বলে খারাপ কিছুর মুখোমুখি হননি সেবার। খারাপ পরিস্থিতির কারণে ২০১৭–তেও কোনো স্কিইয়ার লক্ষ্য পূরণ করতে পারলেন না।

বারগেল আশা হারান না। সব সাহস জমা করে আবারও ফেরেন ২০১৮ সালে। কাছের গ্রাম থেকে ৭০ মাইল ট্র্যাক করে আসেন। পর্বতে ওঠার জন্য আবহাওয়াও ভালো। চার দিন বাদে, বারগেল নিজেকে স্কিসহ আবিষ্কার করেন পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতের চূড়ায়।

মৃত্যুর হাতছানি যেখানে সহজাত, সেখানে বুক দুরু দুরু করা স্বাভাবিক। প্রস্তুতি নিতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে পড়লেন বারগেল। তবে চেষ্টা করলেন যথাসাধ্য নিজেকে শান্ত আর নিবিষ্ট রাখার।

শুরু হলো নামা। ৫০-৫৫ ডিগ্রির তীব্র খাড়া বরফের ঢাল বেয়ে নামা শুরু। একটু এদিক–ওদিক হলেই খাদে আছড়ে গিয়ে পড়বে শরীর। লাশটাও খুঁজে পাবে না কেউ! সেসব ভয়কে দূরে সরিয়ে একমনে স্কিইং করে গেলেন। সফলতার সঙ্গে নামলেন ২৫ হাজার ২২৫ ফুট। খানিকটা বিরতি নিলেন নিজেকে ঠিক করার জন্য। অত ওপর থেকে নেমে আসায় অক্সিজেনের ঘনত্ব পরিবর্তনের কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। এখানে এসে পরিকল্পনা করলেন ভিন্ন পথে এগোনোর। সাধারণত সবাই একটা নির্দিষ্ট পথেই স্কি করে যায়। বারগেল চিন্তা করলেন ভিন্ন চারটি পথের মিশেলে তাঁর নিজস্ব যাত্রাপথে এগোনোর।

তবে এবার কঠিন পরীক্ষা। ভারী কুয়াশা আর মেঘ এসে দৃষ্টিসীমা ঘোলা করে দিল। তীব্রগতিতে স্কিইং করার সময় পথ দেখাটা খুব জরুরি। নয়তো খাড়া পাথুরে দেয়াল, বরফের হিমবাহ কিংবা গিরিখাদ কিছুই চোখে পড়বে না। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর কাটল কুয়াশা। অবশেষে কেটুর নো ম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছাতে পারলেন আন্দ্রে বারগেল। রেকর্ডবুকে নাম উঠে গেল তাঁর।

একটানা সাত ঘণ্টা স্কিইং করে এ ইতিহাস লেখা হলো। রুদ্ধশ্বাস আঁকাবাঁকা পথে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে এগিয়ে চলা এ অভিযাত্রা। কত অভিযাত্রী মারা গেছেন এ ইতিহাসে নাম লেখাতে গিয়ে! সেসব অতীত জয় করা প্রথম বিজয়ী পোল্যান্ডের স্কিইয়ার আন্দ্রে বারগেল তখন বরফের মধ্যে শুয়ে পড়ে ছেলেমানুষের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। যে দুঃসাহসের ইতিহাস গড়েছেন তিনি, তারপর এমন প্রতিক্রিয়াই তো স্বাভাবিক।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফি অবলম্বনে

(কিশোর আলোর সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত)