দক্ষিণ কোরিয়ায় বেলা নামের তিমিকে বাঁচানোর লড়াই
২০১৩ সালের একদিন, মনের আনন্দে সমুদ্রে সাঁতরে বেড়াচ্ছিল একটি বেলুগা তিমি। কিন্তু হঠাৎ মানুষের তৈরি ফাঁদে আটকা পড়ে যায় সে। তখন তার বয়স মাত্র দুই বছর। তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় দক্ষিণ কোরিয়ার একটি মেগা মলের অ্যাকুয়ারিয়ামে প্রদর্শনীর জন্য। সমুদ্রে জন্ম নেওয়া প্রাণীটির নাম অ্যাকুয়ারিয়ামে এসে হয়ে যায় ‘বেলা’। বিশাল সমুদ্রে চড়ে বেড়ানো বেলার জন্য অ্যাকুয়ারিয়াম যেন এক জেলখানা।
দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের এক বিশাল শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলায় লোটে ওয়ার্ল্ড অ্যাকুয়ারিয়াম। একসময় এখানে ছিল তিনটি বেলুগা তিমি। বেলি আর বেলু নামের দুই ছেলে তিমির সঙ্গে ছিল বেলা নামের এক মেয়ে তিমি। প্রতিদিন অনেক মানুষ জড়ো হতো তিমিগুলো দেখতে। কেউ কেউ সেগুলোর সঙ্গে ছবি তুলত। কেউ কেউ আটকে পড়া তিমিদের দেখে আবার কষ্ট পেত। এভাবে বন্দিদশায় বেলির ২০১৬ সালে অকালমৃত্যু হয়। ২০১৯ সালে মারা যায় বেলু। মূলত অ্যাকুয়ারিয়ামে বন্দী থাকার ধকল নিতে না পেরেই মৃত্যু হয়েছিল তাদের।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাণী অধিকারকর্মীদের চাপে পড়ে ২০১৯ সালে লোটে ওয়ার্ল্ড অ্যাকুয়ারিয়াম বেলা নামের তিমিটিকে অভয়ারণ্যে ছেড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০২৩ সাল শেষ হলেও বেলা অবমুক্ত হয়নি। নিরুপায় প্রাণীটি অ্যাকুয়ারিয়ামের ট্যাংকে অবিরাম চক্কর দিচ্ছে। যেন পালানোর পথ খুঁজছে! কষ্টের ব্যাপার হলো, এভাবে চলতে থাকলে তাকেও বাঁচানো যাবে না। তার এই দুর্দশা একটি বড় বিতর্ক সামনে এনেছে। মানুষের বিনোদনের জন্য ডলফিন কিংবা তিমিদের মতো বিপন্নপ্রায় প্রাণীদের ব্যবহার করা ঠিক কতটা যৌক্তিক? অনেকেই প্রাণীদের মুক্ত জীবনের পক্ষে আওয়াজ তুলছেন। প্রাণী অধিকারের পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন হেলেন ও’বেরি।
বেলুগা তিমি দেখতে অনেকটা সাদা ডলফিনের মতো। দেখতে হাসিখুশি এই প্রাণীর মাথায় তরমুজের মতো ফোলা একটি বিশেষ অংশ থাকে, একে মেলন বলে। মূলত ফ্যাট দিয়ে গঠিত মেলনের সাহায্যে শব্দ তৈরি করে এই তিমি। এভাবে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বেলুগা তিমিরা বেশ সামাজিক আচরণ করে। প্রাণী হিসেবে এগুলো বেশ বুদ্ধিমানও।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০০টি বেলুগা তিমিকে ব্যবসার জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছে। এগুলো কখনোই অ্যাকুয়ারিয়ামে মানিয়ে নিতে পারে না। স্বাভাবিক আচরণ দেখা যায় না অ্যাকুয়ারিয়ামে। মানুষ যেমন চিন্তায় পায়চারি করে, ঠিক তেমনি কোনো কূলকিনারা না পেয়ে অ্যাকুয়ারিয়ামের ট্যাংকে বারবার চক্কর দিতে থাকে বেলুগা তিমি। ফলে খুব কম বয়সে অসুস্থ হয়ে মারা যায় এগুলো।
লোটে ওয়ার্ল্ড অ্যাকুয়ারিয়াম বিভিন্ন অজুহাতে বেলা নামের তিমিটিকে মুক্ত করে দিতে দেরি করছে। প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, আইসল্যান্ডের অভয়ারণ্যে অবমুক্ত করার জন্য। সেখানে পরিবেশগত সমস্যা আছে দাবি করে এই প্রস্তাব নাকচ করেছে লোটের কর্তৃপক্ষ। এরপর নরওয়েজিয়ান হোয়েল রিজার্ভ নামের একটি অভয়ারণ্যে বেলাকে রাখার প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবটিতে বেলার দেখাশোনার জন্য প্রয়োজনীয় টাকার অনুদানসহ একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা ছিল। তবু নরওয়েতে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব আছে বলে প্রস্তাবটি থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বেলার মুক্তির দাবিতে কাজ করছে। কিন্তু লোটে ওয়ার্ল্ড অ্যাকুয়ারিয়ামের কর্তৃপক্ষ যেন নিজেদের অঙ্গীকার ভুলে গেছে। ২০১৯ সালে বেলাকে মুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো পূরণ করেনি।
অ্যাকুয়ারিয়াম কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এখনো বেলাকে টাকার বিনিময়ে মানুষের জন্য প্রদর্শন করা হচ্ছে কেন? এর জবাব তারা দিতে পারেনি। প্রাণী অধিকারকর্মীরা বেলার সুস্থতার জন্য অতি দ্রুত একটি অভয়ারণ্যে অবমুক্ত করার ওপর জোর দিচ্ছেন। এর জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এই খবর ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। নানা প্রান্তের মানুষ বেলার মুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে। আশা করা যায়, শিগগিরই অ্যাকুয়ারিয়ামের বদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবে সে। আর তার মুক্তিতে শুধু একটি প্রাণীর জীবন বাঁচবে, এমন না, অ্যাকুয়ারিয়ামে সামুদ্রিক প্রাণীদের কষ্টকর বন্দিজীবনের বিষয়টিও সবার সামনে আসবে।