অন্য রকম এক জাম্বুরির গল্প

আমার স্কাউট-জীবনের শুরু ২০১৮ সাল থেকে। তখন থেকেই শুনে আসছি ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরির কথা। প্রতি চার বছর পর অনুষ্ঠিত হয় স্কাউটের সবচেয়ে বড় আয়োজন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয় ২৪তম ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরি। আমাদের ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ স্কাউট গ্রুপের অনেকেই সেখানে অংশ নিয়েছিল। সেই থেকে মনে ইচ্ছা জাগে পরবর্তী ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরিতে অংশে নেওয়ার। আর এভাবেই গল্পের শুরু। দুই বছর পর ২০২১-এ এসে জানতে পারি পরবর্তী ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরি ২০২৩ অনুষ্ঠিত হবে দক্ষিণ কোরিয়ায়। এটাও জানলাম, আমি সেখানে অংশগ্রহণের জন্য উপযুক্ত। এই তো শুরু! এরপর বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে নিজেকে। অবশেষে চূড়ান্ত ইন্টারভিউর পর জানতে পারলাম, আমার এত দিনের ইচ্ছা এবার পূরণ হতে চলেছে। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭৫০ জন স্কাউট এবার অংশ নিতে যাচ্ছে ২৫তম ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরিতে। আর তাদের মাঝে আমিও একজন!

এ বছরের জুন মাস থেকে শুরু হলো আসল প্রস্তুতি। ১৪ দিনের সফর ঘিরে চলল নানা দৌড়ঝাঁপ। কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিশ্বের সামনে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে দলগত নাচের প্রস্তুতি চলল প্রায় এক সপ্তাহ।

এরপর ৩১ জুলাই রাতে চড়ে বসলাম প্লেনে। ৬ ঘণ্টার সফরের পর সিঙ্গাপুরে প্রায় ১১ ঘণ্টার দীর্ঘ বিরতি। তারপর আবার যাত্রা শুরু। আর এরপরই আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আট ঘণ্টা যাত্রার পর ১ আগস্ট বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটায় পৌঁছে গেলাম দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে অবস্থিত ইন-চিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখানে নেমে সঙ্গে সঙ্গেই আবার উঠে পড়ি বাসে। স্যামানগামের স্কাউট ক্যাম্পের উদ্দেশে। এটাই ছিল আমাদের মূল গন্তব্য। ১৫৮টি দেশ থেকে আসা প্রায় ৪৩ হাজার ছোট–বড় স্কাউটের জন্য তৈরি করা হয় সেই ক্যাম্প। পাঁচ ঘণ্টা বাসযাত্রা শেষে অবশেষে পৌঁছে গেলাম ২৫তম স্কাউট জাম্বুরির ‘ওয়েলকাম সেন্টারে’। সেখানে নামতেই চোখে পড়ল এবারের জাম্বুরির স্লোগান ‘ড্র ইয়োর ড্রিম’-এর দিকে। সেন্টার থেকে এবার হেঁটে নিজ নিজ সাব ক্যাম্পে যাওয়ার পালা। বেশ কিছু দূর পাড়ি দিতেই পৌঁছে গেলাম নিজ দেশের সাব ক্যাম্পে।

আর এখান থেকেই শুরু অন্য রকম এক অভিজ্ঞতার। সাব ক্যাম্পে গিয়েই নিজেরা নিজেদের তাঁবু লাগিয়ে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলাম। কোরিয়ান কন্টিনজেন্ট থেকে দেওয়া ‘ওয়েলকাম কিট’ পেলাম, যাতে ছিল জাম্বুরির আইডি কার্ড এবং অন্যান্য উপহারসামগ্রী।

ক্যাম্পে পৌঁছানোর পর সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ছিল সেখানকার আবহাওয়া। মাথার ওপর ৩৮° ডিগ্রি শুষ্ক গরম। এই গরমে বরফ ঠান্ডা পানি ব্যবহার করাটা ছিল বেশ কঠিন। এই কারণে জাম্বুরির ক্যাম্পে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখেছি অনেককেই। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না।

সেদিন রাতে রওনা দিলাম জাম্বুরির হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশে। যেখানে অনুষ্ঠিত হয় ২৫তম ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরির বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সত্যি বলতে, এটি ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তের মধ্যে একটি। অনুষ্ঠানে মূল স্পিকার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল এবং তাঁর স্ত্রী কিম কিওন-হি। জাম্বুরির উদ্বোধন ঘোষণার পর একে একে ১৫৮টি দেশের প্রতিনিধিরা নিজ দেশের পতাকা হাতে মঞ্চে উঠে নিজের দেশকে পরিচিত করান। আরেক স্পিকার হিসেবে ছিলেন বিখ্যাত অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী বিয়ার গ্রিলস। এরপরই আসে সাংস্কৃতিক পর্ব। একের পর এক দল এসে পরিবেশন করে তাদের আকর্ষণীয় গান ও নাচ। জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটিএসের ‘ডিনামাইট’ গানটি পরিবেশন করে একটি দল। এরপর আসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অন্যতম মূল আকর্ষণ। মুহূর্তের মধ্যে আতশবাজির ঝলকানিতে ছেয়ে যায় পুরো জাম্বুরির আকাশ। সেই সঙ্গে চলে ড্রোন লাইট শো।

তবে এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার পরই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। অনুষ্ঠান চলাকালে জাম্বুরির মাঠেই প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হই। অবস্থার অবনতি হলে মাঠেই শুয়ে পড়ি আমি। তবে কষ্ট হলেও ধৈর্য ধরে অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত থাকার চেষ্টা করছিলাম। ধীরে ধীরে শরীর আরও খারাপ হতে থাকে। আয়োজন শেষে বের হওয়ার সময় বাংলাদেশি একজন চেনা আইএসটি এবং অন্যান্য দেশের কিছু সিনিয়র স্কাউটের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। আমার এই অবস্থা দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন তাঁরা। অনেক চেষ্টার পর একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করা হয়, যেটি আমাকে আমার সাব ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। তবে ঝামেলা যেন শেষ হলো না এখানেও। অসুস্থতার কারণে হাজার হাজার তাঁবুর মধ্যে নিজের তাঁবু হারিয়ে ফেলি আমি। শেষে ভিনদেশি একজন স্কাউট আমাকে সাব ক্যাম্প অফিসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কোনোমতে আমি ক্যাম্পে ফিরতে পারি।

সেই রাতে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয় আমার। সকালে জাম্বুরি অ্যাকটিভিটিতে যাওয়া আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সেদিন আমার সঙ্গে আমার বন্ধুও একইভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। জাম্বুরির প্রথম দিন এভাবে কাটবে, সেটা যেন ভাবতেই কষ্ট হচ্ছিল। শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে একজন স্যার আমাকে মেডিকেল সেন্টারে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে আমাকে জ্বর মেপে কোভিড টেস্ট করাতে বলে। সত্যি বলতে, তখন কিছুটা ভয় পাই। তবে টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ এলে কিছুটা স্বস্তি পাই। পরে সেখানকার চিকিৎসকেরা আমার মাঝে পানিশূন্যতার লক্ষণ খুঁজে পান এবং সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন দেন। সারা দিন জাম্বুরির মেডিকেল সেন্টারেই কাটে আমার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আমার অবস্থার অবনতি দেখে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমি সকাল পর্যন্ত সময় নিয়ে রাতে সাব ক্যাম্পে ফিরে আসি। সৌভাগ্যক্রমে পরের দিন স্বাস্থ্যের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। আমার দলের অন্যান্য সদস্য আমার বেশ যত্ন নেয় তখন। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে সেদিন থেকে আমি সত্যিকারের জাম্বুরির আনন্দ পেতে শুরু করি। এরপর বোট রাইডিং, জাম্পিং ইত্যাদির মতো বিভিন্ন অ্যাকটিভিটিতে অংশ নেওয়া শুরু করি এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আসা স্কাউটদের সঙ্গে পরিচিত হই। অনেক নতুন বন্ধু হয় আমার।

পরের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ডে’। সেখানে জাম্বুরিতে উপস্থিত সব বাংলাদেশি একসঙ্গে জড়ো হয়। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বিশ্বের বেশ কিছু দেশের প্রতিনিধিরাও সেখানে আসেন৷ তাঁদের সামনে দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে দেশীয় বিভিন্ন নাচ ও গানের আয়োজন করা হয়। এমনকি তাঁরা আমাদের দেশীয় পোশাক শাড়ির বেশ প্রশংসাও করেন। ৫ আগস্ট ছিল ‘কালচার ডে’, যেখানে জাম্বুরিতে উপস্থিত সবাই নিজের দেশের সংস্কৃতি অন্যান্য সব দেশের স্কাউট বন্ধুদের কাছে তুলে ধরে। সেদিন আমি দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত খাবার তোকবক্কি ও রামেন উপভোগ করেছিলাম। সেদিনই একটি কে-পপ কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবহাওয়াজনিত কারণে তা তৎক্ষণাৎ স্থগিত করা হয়। এমনকি অসহ্য গরম থেকে বাঁচতে সেদিন স্কাউটদের মাঝে টুপি, ছাতা, ফ্যান, সানক্রিন ও রুমাল, স্যালাইনের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করে কোরিয়ান কন্টিনজেন্ট।

এত বাধাবিপত্তির পর যখন সবে আনন্দের শুরু, তখনই ঘটে আরেক কাণ্ড। হঠাৎ আমরা শুনতে পাই আমাদের নাকি ক্যাম্পসাইট থেকে সরে আসতে হচ্ছে। কেননা, ভয়ংকর এক ঘূর্ণিঝড় ‘খানুন’ হানা দিতে পারে এই অঞ্চলে। সেই রাতেই সব প্রস্তুতি নিয়ে ভারী মনকে সঙ্গে করে পরদিন সকালে রওনা হই জিওনজুর উদ্দেশে। সেখানে স্থানীয় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে আমাদের ঠাঁই হয় পরের কিছুদিনের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সবাই এবং জাম্বুরির ব্যবস্থাপনা দল সম্মিলিতভাবে আমাদের থাকা–খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন। এত দিনের সব ঝড়ঝাপটা এবং কষ্টের যেন অবশেষে অবসান ঘটে, সবার মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। সেই থেকে শুরু হলো জাম্বুরির আসল আনন্দ। পরের বেশ কিছুদিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় আশপাশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক জাদুঘর এবং দর্শনীয় স্থানে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল বুয়ান গ্রামটি, যেখানে আমাদের ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান পোশাক হানবোক পরার সুযোগ হয়।

১১ আগস্ট ২৫তম ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরির শেষ দিন। সিউল ওয়ার্ল্ড কাপ স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য সমাপনী অনুষ্ঠানের প্রথমেই ২৬তম স্কাউট জাম্বুরির আয়োজক দেশ হিসেবে পোল্যান্ডকে স্কাউট পতাকা হস্তান্তর করে দক্ষিণ কোরিয়ার স্কাউট দল। সমাপনী অনুষ্ঠানে মূল আকর্ষণ ছিল কে-পপ কনসার্ট। মামামো, ইটজি, নিউ জিন্স, এনসিটি ড্রিমস, আইভের মতো বিখ্যাত কে-পপ ব্যান্ডগুলো সবার সামনে উপস্থাপন করে নিজেদের মনমাতানো পরিবেশনা। তাদের অসাধারণ নাচ-গান আমাদের মুগ্ধ করে রাখে পুরোটা সময়। আর এভাবেই পর্দা নামে ২৫তম ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরির। সবশেষে এবার বাড়ি ফেরার পালা। সত্যি বলতে, এই সবকিছুর মাঝে দেশে ফেরার উৎসাহ আর আনন্দটা যেন ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৩ আগস্ট এবার প্লেন ধরি বাংলাদেশের উদ্দেশে। আবার দীর্ঘ যাত্রা শেষে অবশেষে ১৪ আগস্ট রাত ১১টায় পা রাখি নিজ দেশে। আর এভাবেই শেষ হয় ২৫তম জাম্বুরি ঘিরে আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় গল্প।

সব মিলিয়ে ২৫তম ওয়ার্ল্ড স্কাউট জাম্বুরির অভিজ্ঞতা ছিল প্রত্যাশার বাইরে। পুরোটা সময় খুব সুখকর না হলেও এই জাম্বুরি থেকে শেখার ছিল অনেক কিছু। জীবনে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে শক্ত রেখে কীভাবে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হয়, তা নিজেই অনুভব করতে পেরেছি এখানে। তাই তো ১৪ দিনের এই সফরে একটি বড়সড় ‘রোলার কোস্টার’ রাইড বললে যেন ভুল হবে না।