এআইয়ের যুগে চাকরি টিকিয়ে রাখতে কী করব, জানালেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী
ভবিষ্যতে মানুষকে খুব বেশি কাজ করতে হবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বেশির ভাগ কাজ সামলে নেবে—এআইয়ের বিস্তার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের কথারও বিস্তার ঘটেছে। অনেকের ধারণা, এসব বড়লোকি ভাবনা; কেউ কেউ ভাবেন, এই দিন আসতে অনেক দিন বাকি!
কিন্তু এবার নোবেলজয়ী পদার্থবিদ জর্জিও পারিসিও একই ধরনের কথা বলেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশ করে তিনি বলেছেন, এআই ও অটোমেশন এমন শক্তি, যেগুলো শুধু চাকরি হারিয়ে দেবে না; বরং কাজের ধারণাই বদলে দেবে।
জর্জিও পারিসি বলেছেন, আমরা এমন এক পৃথিবীর দিকে যাচ্ছি, যেখানে মানুষের অবসর সময় হবে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি; কিন্তু সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিসে যাওয়ার মতো চাকরি হয়তো আর আগের মতো থাকবে না।
রোবট ও এআই কেন শক্তিশালী হচ্ছে
বছর কয়েক আগে বিল গেটস সতর্ক করে বলেছিলেন, রোবট অনেক চাকরি নিয়ে নেবে। ইলন মাস্ক প্রায়ই বলেন, এআইয়ের যুগে মানুষের কাজ করা ঐচ্ছিক হয়ে যাবে। জর্জিও পারিসি এবার তাঁদের সুরেই সুর মেলালেন। তবে তিনি এসব কথা বলে নোবেল পাননি। নোবেল তিনি পেয়েছেন জটিল ব্যবস্থা—একটা বিশৃঙ্খল, অগোছালো জগৎ যেখানে সবকিছু একে অন্যকে প্রভাবিত করে, তা বোঝার জন্য। এরপর তিনি এই চিন্তাভাবনা অর্থনীতি, কাজ আর এআইয়ের দক্ষতার ওপর প্রয়োগ করলেন।
জর্জিও পারিসির মতে, অর্থনীতি অনেকটা উত্তাল পানির মতো। এক শক্তি যদি খুব বড় হয়ে যায়, সেটি পুরো প্রবাহ বদলে দেয়। এআই ও অটোমেশন সেই শক্তি।
পারিসি বলছেন, এটি আসলে মূল্য সৃষ্টি ও উৎপাদনের একটি নতুন যান্ত্রিক পরিবর্তন। তাঁর একটি হিসাব বলছে, খুব অল্প মানুষ বিশাল এআই সিস্টেম চালিয়ে পুরো সমাজ টিকিয়ে রাখতে পারবে।
একবার ভাবো তো, যদি মাত্র ১০ শতাংশ কর্মী লজিস্টিকস, স্বাস্থ্য, শক্তি, প্রশাসন, মিডিয়া সব চালিয়ে নেয়, বাকিদের কী হবে? যদি মেশিন কাজ করে, তাহলে টাকা পাবে কে? এর উত্তর হলো—যারা মেশিনের মালিক, তারাই হয়তো সব লাভ নিয়ে নেবে। আর অল্পসংখ্যক যারা কাজ করবে, তাদের আয় অনেক বেশি হতে পারে। কিন্তু বাকি ৯০ শতাংশের জন্য প্রচলিত চাকরি কমে যাবে বা হারিয়ে যাবে। তাদের কোনো আয় থাকবে না।
এই জায়গায় এসে ইলন মাস্ক আর বিল গেটসও পারিসির সঙ্গে এক জায়গায় দাঁড়ান। মাস্ক বলেন, ভবিষ্যতে হয়তো সবার জন্য সর্বজনীন উচ্চ আয় থাকা লাগবে। গেটস বলেন, রোবট ট্যাক্স বসিয়ে মানুষকে সুরক্ষা দিতে হবে। আর পারিসি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেন না, কেবল সংখ্যার দিশা দেখান। নিয়ম না বদলালে অস্থিরতা তৈরি হবে।
পারিসির বিশ্লেষণে দেখা যায়, উৎপাদন বাড়ছে; কিন্তু চাকরি কমে যাচ্ছে। বাস্তব জীবনে এই মানচিত্র বসাও: সুপারশপে একজন ম্যানেজার আর পুরো অটোমেশন, হাসপাতালে প্রাথমিক রোগ নির্ণয় করবে এআই, মিডিয়া কোম্পানিতে তিনজন সম্পাদক আর কনটেন্ট ইঞ্জিন। কাজ থাকবে; কিন্তু তা খুব কম মানুষের হাতেই।
এর জন্য যেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে
ভবিষ্যতে যদি চাকরি আর না–ই থাকে, তাহলে কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হবে। সে সময় তো থাকবে শুধু অবসর। তাই নিজের এই অবসর সময়কে প্রধান সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে।
পারিসি বলেন, এখন থেকেই অবসর সময়কে সম্পদ হিসেবে গণ্য করা শিখতে হবে। সপ্তাহে দুই দিন শুধু নিজের জন্য রাখো। এক দিন এমন কিছু শেখো, যা এআই বা রোবট সহজে করতে পারে না। যেমন গল্প বলা, কারুশিল্প, মানুষকে সাহায্য করা। আরেক দিন রাখো মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরির জন্য। যেমন কোনো ক্লাব বা টিম পরিচালনা করা।
ধীরে মনে হলেও এই দক্ষতাই ভবিষ্যতে টিকে থাকার টিকিট হতে পারে। কারণ, মেশিন মানুষের জায়গা নেবে না, মেশিন শুধু কাজ নেবে। এআই যত বেশি কাজ নেবে, তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে মানুষের ‘মানবিক পোর্টফোলিও’।
কারণ, চাকরি হারালে মানুষ শুধু আয় হারায় না, হারায় জীবনের ছন্দও। তাই মূল আয়ের অপেক্ষায় বসে থাকা বিপদ; বরং মাসে এক দিন ‘মাইক্রো-রিটায়ারমেন্ট’ নেওয়া যেতে পারে। মানে, এক দিন এমনভাবে কাটাও যেন তোমার কোনো চাকরি নেই, কিন্তু জীবনে আনন্দ আছে। ঘুম থেকে উঠে কিছু ভালো কাজ করো, নিজের পছন্দের কিছু শেখো—বছরে এক দিন হলেও এই কাজটা করো।
তবে এই তিনটি ভুল করা যাবে না। এগুলো হলো এক, ভাবা যে এসব হবে না। দুই, ভয় পেয়ে কিছুই না করা। তিন, যেহেতু চাকরির ধারণা বদলে যাচ্ছে, তাই শুধু স্বপ্নের চাকরির পেছনে দৌড়ানো যাবে না।
মনে রেখো, ভবিষ্যতে কাজ মানে শুধু অফিস নয়। কাজ মানে হবে যত্ন, শিল্প, সমাজ, মেরামত, উপস্থিতি। এআই কাজ নিয়ে নেবে, কিন্তু মানুষের মনে কেড়ে নিতে পারবে না। তাই আমরা যেন নিজের মানবিক গুণ ভুলে না যাই।
সূত্র: রয়্যালব্লুহিটিং