অনিন্দ্য সুন্দর যে গ্রামে গাড়ি নেই, রাস্তা নেই, তবু বেড়াতে আসে লাখো পর্যটক

ইতালির ভেনিস শহর পর্যটকদের জন্য স্বর্গরাজ্য। ভেনিসজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য খাল। এসব খালের পানিতে গন্ডোলায় (নৌকা) চড়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখে অনেকেই। তবে ভেনিসের কথা আমরা যতটা জানি, ডাচ গ্রাম খিতুর্নের কথা আমরা সেভাবে জানি না। জানলে অনিন্দ্য সুন্দর এই গ্রামটি জীবনে অন্তত একবার ঘুরে দেখার স্বপ্ন মনে মনে উঁকি দিতে বাধ্যই বলা চলে। এসো, ‘ভেনিস অব দ্য নর্থ’ হিসেবে পরিচিত নেদারল্যান্ডসের এই গ্রাম সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

খিতুর্নে মানুষের বসবাস

১২৩০ সালের দিকে ফ্ল্যাগেলান্ট নামের একটি বিদ্রোহী ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষেরা সুনসান এক অঞ্চলে গিয়ে নিরাপদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর আগে খাল দিয়ে ঘেরা ওই অঞ্চলে কোনো মানুষের বাসস্থান ছিল না। বর্তমানে সেই জায়গার নাম খিতুর্ন। ইংরেজিতে এর বানান Giethoorn। ফলে এর প্রচলিত উচ্চারণ গিথোর্ন। তবে ডাচ ভাষায় G-এর উচ্চারণ অনেকটা বাংলা 'খ' বা ইংরেজি 'ch'-এর মতো। এই ভাষায় 'th'টাও আসলে 'ত' বা 'দ'-এর মতো, 'থ'-এর মতো নয়। ফলে Giethoorn-এর উচ্চারণ হিসেবে 'গিথোর্ন' বেশ প্রচলিত হলেও এর উচ্চারণ আসলে অনেকটা 'খিতুর্ন'-এর মতো শোনায়। Giethoorn শব্দটা এসেছে ইংরেজি গোট হর্ন (Goat Horn) বা ডাচ Geytenhoren, অর্থাৎ ছাগলের শিং থেকে। ফ্ল্যাগেলান্টরা যখন এখানে গিয়েছিল, তখন তারা দেখেছিল মাটিতে অনেক ছাগলের শিং গেঁথে আছে। ধারণা করা হয়, ১১৭০ সালের বন্যায় এসব ছাগল মারা গিয়েছিল।

একসময় জলপথ ছাড়া খিতুর্নে চলাফেরা করার তেমন কোনো উপায় ছিল না। সময়ের সঙ্গে সেখানে খালের ওপর তৈরি করা ১৮০টি পদচারী-সেতু হয়েছে। এখন খিতুর্নে যাতায়াত করার দুটি উপায় আছে। গ্রামটি ঘুরে দেখার সময় চাইলে তুমি নৌকায় চড়তে পারো। তা না হলে পায়ে হেঁটে ঘোরাফেরা করতে হবে।

ভেনিস অব দ্য নর্থ

খিতুর্ন নেদারল্যান্ডসের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ডাচ প্রদেশ ওফেরাইসেলে (Overijssel) অবস্থিত। গ্রামটি ‘ভেনিস অব দ্য নর্থ’ উপাধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এটি ইতালির ভেনিসের আদলে গড়া হয়েছে, এমন ধারণা ভুল। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে ঘুরতে গেলে বোঝা যায়, এই দেশে খালের কোনো অভাব নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে খিতুর্ন ইতালির ভেনিসের চেয়েও মনোরম বলে অনেকে মনে করেন।

বছরজুড়ে খিতুর্নে সুন্দর আর নিরিবিলি পরিবেশ থাকে। কিন্তু এই গ্রামে ঘুরতে যাওয়ার আগে তোমার সেখানকার আবহাওয়া মাথায় রাখতে হবে। খিতুর্ন ঘুরে দেখার শ্রেষ্ঠ সময় গ্রীষ্ম আর বসন্তকাল। কারণ, মিষ্টি রোদ আর ফুলের সৌরভের মধ্যে একটি গ্রাম ঘুরে দেখার আনন্দ অন্য রকম। স্বাভাবিকভাবেই এই সময় পর্যটকের ভিড় বেশি থাকে। পর্যটকদের চাপ সবচেয়ে বেশি থাকে আগস্ট মাসে।

যা যা করা যায় খিতুর্নে

নৌকায় একচক্কর

খিতু্র্ন গেলে নৌকায় তোমাকে চড়তেই হবে

এই গ্রামের মোহনীয় রূপ উপভোগ করার জন্য নৌকায় তোমাকে চড়তেই হবে! খুব সহজেই নৌকা ভাড়া করা যায়। আর সঙ্গে একজন ট্রাভেল গাইড থাকলে তো কোনো চিন্তাই নেই। নৌকায় চেপে খিতুর্নে ঘুরে বেড়ানোর সময় ছোট্ট গ্রামটির আসল সৌন্দর্য চোখে ধরা পড়বে।

পায়ে হেঁটে ঘুরে আসা

অদ্ভুত সুন্দর গ্রাম খিতুর্নে বাস বা গাড়ি চলার কোনো রাস্তা নেই। রাস্তা থাকবে কি, সেখানে গাড়ি চলারই কোনো অনুমোদন নেই। কিন্তু এখানে মানুষের চলাফেরা করার যথেষ্ট জায়গা আছে। তাই তুমি চাইলে এই গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে পারবে। বিনেনপাত নামে একটি রাস্তা আছে, যার চারপাশে অনেক রঙিন বাসাবাড়ি আর বাগান দেখতে পাবে। খিতুর্ন গ্রামটি ঘুরে দেখার সময় ক্যামেরাবন্দী করে রাখার মতো অপূর্ব দৃশ্যের দেখা মিলবে সবসময়ই।

মিউজিয়াম দে আউডে আরডে

এলিফ্যান্ট বার্ড নামের একটি বিলুপ্ত প্রজাতির পাখির এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বড় ডিম দেখা যায় খিতুর্ন গ্রামের একটি জাদুঘরে। মিউজিয়াম দে আউডে আরডে নামে পরিচিত এই জাদুঘরে তুমি পরিবারসহ ঘুরতে যেতে পারবে। একটি দোকান আছে জাদুঘরটির সঙ্গে। সেই দোকান থেকে মূলত স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ছোটখাটো জিনিসপত্র কেনা যায়। এর পাশাপাশি জাদুঘরে ছোটদের জন্য ‘ট্রেজার হান্ট’ ধরনের মজার খেলার আয়োজন করা হয় নিয়মিতই।

মিউজিয়াম খিতুর্ন দে ওলদে মাত উস

পুরোনো একটি খামার সংস্কার করে বানানো একটি লিভিং মিউজিয়াম আছে খিতুর্নে। লিভিং মিউজিয়াম হলো একধরনের জাদুঘর, সেখানে চোখের সামনে দেখা যায় ১৯০০ সালে খিতুর্নে মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিল। মজার বিষয় হলো, এই জাদুঘরে তৎকালীন সমাজের জীবনযাপনের ধরন অভিনয় করে দেখানোর জন্য মানুষও নিয়োজিত রয়েছে। মিউজিয়াম খিতুর্ন দে ওলদে মাত উস নামের এই অভিনব জাদুঘরে গেলে তুমি এই গ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবে।

গ্লোরিয়া মারিস শেল গ্যালারি

গ্লোরিয়ামারিস পৃথিবীর সবচেয়ে দামি সি-শেল বা খোলস হিসেবে পরিচিত। এই শেল পাওয়া যায় একধরনের সামুদ্রিক শামুক থেকে। এই শামুক কেবল প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারতীয় মহাসাগরে দেখা যায়। অনেক মূল্যবান একটি গ্লোরিয়ামারিস শেল আছে খিতুর্ন গ্রামে। আর যে জাদুঘরে এই শেল রাখা আছে, তার নাম গ্লোরিয়া মারিস শেল গ্যালারি। ভেব না এই জাদুঘরে গেলে তুমি গ্লোরিয়ামারিস ছাড়া আর কিছু দেখতে পাবে না। এখানে সমুদ্রের তলদেশ থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন জিনিসপত্র আছে। অপরূপ সুন্দর এই গ্যালারি যেন পানির নিচের অচেনা জগৎ তোমার চোখের সামনে তুলে আনবে।

বুঝতেই পারছ, খিতুর্নে হরেকরকম জাদুঘরের সমারোহ আছে। নেদারল্যান্ডসের পানিতে ঘেরা এই গ্রামটিতে দর্শনীয় স্থানের কোনো কমতি নেই। খিতুর্ন ভ্রমণ তাই তোমার বাকেট লিস্টে যোগ করে ফেলতেই পারো!