পাসপোর্টের কোন রং দিয়ে কী বোঝায়

বিশ্বজুড়ে পাসপোর্টের রং ও নকশা ভিন্ন

পৃথিবীতে পাসপোর্টের ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়। মানুষ মাত্র ১০০ বছর ধরে পাসপোর্ট ব্যবহার করছেন। বর্তমানে পাসপোর্ট ব্যবহার করা ছাড়া বিদেশে ভ্রমণ করা কঠিন। পাসপোর্ট ছাড়া বিদেশে ভ্রমণ সম্ভব, যেমন ট্রাভেল ডকুমেন্ট ব্যবহার করে ভ্রমণ করা যায়। তবে সাধারণত বিদেশে ভ্রমণের প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমেই পাসপোর্টের খোঁজ পড়ে।

বাংলাদেশে তিন ধরনের পাসপোর্ট আছে। সবুজ, নীল ও লাল। সবুজ পাসপোর্ট বা সাধারণ পাসপোর্ট জন্মসূত্রে বা বৈবাহিক সূত্রে যাঁরা বাংলাদেশি, তাঁদের জন্য। বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য এই পাসপোর্ট ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। নীল পাসপোর্ট বা অফিশিয়াল পাসপোর্ট বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা সরকারি কাজে বিদেশে ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করেন। লাল পাসপোর্টকে বলা হয় কূটনৈতিক পাসপোর্ট বা ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য ও তাঁদের স্বামী–স্ত্রী, উচ্চ আদালতের বিচারপতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রধান, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের কর্মকর্তাদের জন্য ইস্যু করা হয়।

বিশ্বজুড়ে পাসপোর্টের রং ও নকশা ভিন্ন। কোনো দেশ যে রঙের পাসপোর্টই ইস্যু করুক না কেন, সেটি অবশ্যই আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও) থেকে অনুমোদিত হতে হয়। বিশ্বজুড়ে পাসপোর্টে সাধারণত লাল, নীল, সবুজ ও কালো—এই চার রঙের ভিন্ন শেড ব্যবহার করা হয়।

পাসপোর্টের রং আসলে একটি দেশের সরকারের পরিচয় বা প্রতীক। একটি দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা বা ভৌগোলিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে সে দেশের পাসপোর্টের রং ঠিক করা হয়।

বেশির ভাগ মুসলিম দেশের পাসপোর্ট সবুজ। কারণ, নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রিয় রং হিসেবে এটি বিবেচিত হয়। মুসলিম জনগোষ্ঠী যে দেশে বেশি, সেখানে পাসপোর্ট সবুজ হয়। যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও সৌদি আরব। পশ্চিম আফ্রিকারও কিছু দেশের পাসপোর্ট সবুজ, যেমন নাইজেরিয়া, আইভরি কোস্ট, বুরকিনা ফাসো, ঘানা ও সেনেগাল।

লাল পাসপোর্ট বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো (ক্রোয়েশিয়া ছাড়া) পাসপোর্টের ক্ষেত্রে লাল রং বেছে নেয়। যেসব দেশে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা আছে বা সাম্যবাদের ইতিহাস আছে, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাসপোর্ট হয় লাল রঙের। যুক্তরাজ্য অবশ্য ২০১৯–এর অক্টোবর থেকে লালের বদলে নেভি ব্লু রঙের পাসপোর্টে ফিরে গেছে। আগে কমিউনিস্ট শাসনাধীন ছিল, এমন দেশগুলো লাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে, যেমন চীন ও রাশিয়া। তবে কমিউনিস্ট শাসনাধীন রাষ্ট্র কিউবা ও লাওস ব্যবহার করে নীল পাসপোর্ট। যদিও সব ক্ষেত্রে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয় না।

পাসপোর্ট চালুর পর থেকেই এর বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। অনেক বিশ্বনেতা চেয়েছিলেন, আগের দিনের মতো কোনো পরিচয়পত্র ছাড়াই স্বাধীনভাবে মানুষ যেন যাতায়াত করতে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও পাসপোর্ট জনপ্রিয় ছিল না। এই পদ্ধতির সমালোচনা করেছিল গণমাধ্যমও।

লালের পর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নীল পাসপোর্ট। এটি ‘নতুন বিশ্বের’ প্রতীক। আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলো পাসপোর্টে নীল রং বেশি ব্যবহার করে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, কোস্টারিকা, এল সালভাদর, ব্রাজিল, কানাডা, ভেনেজুয়েলা, গুয়াতেমালা, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে ইত্যাদি। নীল রঙের পাসপোর্টধারী দেশের তালিকাটি বেশ লম্বা।

পাসপোর্টের রং কালো হওয়াটা খুব বিরল ঘটনা। এই রং বেছে নিয়েছে মালাউই, তাজিকিস্তান প্রজাতন্ত্র, ডোমিনিকান রিপাবলিক ও ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো। নিউজিল্যান্ডও কালো পাসপোর্ট ব্যবহার করে সাংস্কৃতিক কারণে। এই দেশের বিখ্যাত রাগবি দল ‘অল ব্ল্যাকস’, ক্রিকেট দলকেও বলা হয় ‘ব্ল্যাক ক্যাপস’। কালো রং দেশটির পরিচয় বহন করে।

১৯২০ সালে বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে গঠিত হয় লিগ অব নেশনস। তখন ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে পড়ছিল; গড়ে উঠছিল নতুন নতুন জাতিরাষ্ট্র। নাগরিক পরিচয় ও রাষ্ট্র শাসনের প্রয়োজনে প্রচলিত হয় পাসপোর্টের ব্যবস্থা।

যুদ্ধের পর প্রচুর মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে চলাচল করছিল। তাদের অনেকের কাছেই পরিচয় প্রমাণের নির্দিষ্ট কোনো কাগজপত্র ছিল না, থাকলেও তা ছিল স্থানীয়ভাবে পাওয়া এলোমেলো কাগজ। যুদ্ধ চলার সময়েই জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও ইতালির মতো দেশগুলো শত্রু দেশের মানুষের জন্য পরিচয়পত্র বহন করা বাধ্যতামূলক করে।

বাংলাদেশের পাসপোর্ট
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত

এতেও নতুন সমস্যা তৈরি হয়। সীমান্তরক্ষীরা নানা রকমের আকার ও ধরনের ভ্রমণপত্র বা ডকুমেন্ট পেতে থাকেন। তখন কোনটা আসল, কোনটা নকল বোঝা যাচ্ছিল না। এই সমস্যার একটা সমাধান দরকার ছিল। ১৯২০ সালে লিগ অব নেশনস (বর্তমানে জাতিসংঘ) বিশ্বনেতাদের প্যারিসে আমন্ত্রণ জানায় ‘পাসপোর্ট, কাস্টমস ফর্মালিটি ও ট্রানজিট টিকিট সম্মেলনে’।

সেখানে ঠিক হয়, পাসপোর্ট দেখতে হবে এক রকম, একই ধরনের তথ্য থাকবে। পাসপোর্টের মাপ হবে ১৫.৫ x ১০.৫ সেন্টিমিটার (৬ x ৪ ইঞ্চি), থাকবে ৩২টি পৃষ্ঠা। নিয়ম করা হয়, পাসপোর্টের ওপরের কভারে থাকবে দেশের নাম ও জাতীয় প্রতীক। এই নিয়ম এখনো প্রচলিত। তবে বেড়েছে পৃষ্ঠার সংখ্যা।

পাসপোর্ট চালুর পর থেকেই এর বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। অনেক বিশ্বনেতা চেয়েছিলেন, আগের দিনের মতো কোনো পরিচয়পত্র ছাড়াই স্বাধীনভাবে মানুষ যেন যাতায়াত করতে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও পাসপোর্ট জনপ্রিয় ছিল না। এই পদ্ধতির সমালোচনা করেছিল গণমাধ্যমও। মানুষ মনে করত, এটি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে, লঙ্ঘন করে গোপনীয়তা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও তৈরি হয় প্রচুর।

১৯২৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমসে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘দ্য পাসপোর্ট নুইসেন্স’। সেখানে লেখা হয়েছিল, ‘এই যুদ্ধ–পরবর্তী পাসপোর্ট ব্যবস্থা ঝামেলাপূর্ণ, বিরক্তিকর ও আন্তর্জাতিক মেলামেশার পথে বাধা।’ তবে এ থেকে আর ফেরার পথ ছিল না। লিগ অব নেশনসের সদস্যরা আর কখনো মুক্ত সীমান্ত বা পাসপোর্ট ছাড়া এক বিশ্বে ফেরার ধারণায় একমত হতে পারেনি।

তাই পাসপোর্ট টিকে গেল।

সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, ডিডব্লিউ

আরও পড়ুন