স্বপ্নে বাঁচা মেসির গল্প

নচিকেতার সেই গান তো তোমরা শুনেছ, ‘কেউ হতে চায় ডাক্তার/ কেউবা ইঞ্জিনিয়ার…।’ এই চাওয়াটা আসলে স্বপ্ন। আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নে বাঁচি। মাথার ভেতর স্বপ্নের ঘুণপোকা কুট কুট করে না কামড়ালে মানুষ বেঁচে থাকতে পারত না। স্বপ্নই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, যেভাবে তোমরা এখন পড়াশোনা করে এটা-ওটা হওয়ার স্বপ্ন দেখছ।

আজ তেমন এক স্বপ্নবাজ কিশোরের গল্প হোক, যে বড় হয়ে স্বপ্নপূরণের আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল গোটা পৃথিবীর সামনে। তেমন কান্না এক জীবনে যদি কখনো কাঁদতে পারো, লোকে বলবে আনন্দাশ্রু! এর তুলনা হয় না।

লুসাইলে লিওনেল মেসির চোখেও তোমরা এই আনন্দাশ্রু দেখেছ। সেটি আর্জেন্টিনার ফাইনাল জয়ের বেশ কিছুক্ষণ পর। তার আগে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা যখন জিতল, তখন মেসিকে কারও চোখে পড়েছে? আবেগে ছল ছল চোখ দুটি গ্যালারিতে পরিবারকে খুঁজছিল। সেই পরিবার, ছোটবেলায় খুব মন খারাপের সময়ে যাঁদের কাউকে সে পায়নি। বড় একটা সমস্যা বাসা বেঁধেছিল শরীরে। বড় হতে দিচ্ছিল না। মেসিকে একাই লড়তে হয়েছে সেই লড়াই। কৈশোরের মোচা ফুঁড়ে একা একা বড় হওয়ার জ্বালায় যে পড়েছে সে-ই জানে কেমন লাগে! ছাত্রাবাস কিংবা হোস্টেলে তোমাদের কারও কারও মতো মেসিরও অনেক ছুটির দিন কেটেছে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে। পরিবারবিহীন এই জীবনের ধারাপাতে প্রতিটি পৃষ্ঠায় আসলে লড়াই। স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। মেসির স্বপ্ন ছিল, ভাগ্য পক্ষে ছিল না। কিন্তু মানুষ চাইলে কী না হয়!

ভাগ্যকে নিজের মতো করে গড়ে মেসির বিশ্বজয়ের সেই অপূর্ব কাহিনিতে তোমাদের স্বাগত।

মেসি ফুটবলার হতে চেয়েছে। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে, এই একটা স্বপ্নকেই সে পরিচর্যা করেছে। রোজারিওর ধুলামাখা পথে খেলায় সায় ছিল পরিবারের। আর লাই দিয়েছিলেন দাদি সেলিয়া। তাঁর আশকারাতেই এলাকার ক্লাব গ্রান্দোলি হয়ে নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ থেকে বার্সেলোনা, তারপর বিশ্বজয়ের পথে নেমে পড়া—মেসির এই গল্প তোমরা অনেকেই জানো। তোমরা প্রেরণা পেয়েছ। কারণ, মেসি শিখিয়েছে, কখনো হাল ছাড়তে নেই।

ভেবে দেখ, চার বছর বয়সী একটা বাচ্চা রাস্তায় বাবার সঙ্গে খেলছে। বছরখানেক পর তাকে টেনে নিল স্থানীয় দল গ্রান্দোলি। সেটিও মজার এক গল্প। ১৯৮৬ সালে জন্ম নেওয়া বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে গড়া দলের একটা ম্যাচ ছিল। ম্যাচটা গ্রান্দোলির, দলের নাম ‘টিম ৮৬’। একজন খেলোয়াড় তখনো আসেনি। কোচ মেসিকে দলে নেন। সে জন্য আগে মেসির দাদিকে রাজি করাতে হয়েছিল। ম্যাচে মেসির খেলা দেখে তো সবার আক্কেলগুড়ুম। এত ভালো! নির্ঘাত ম্যারাডোনার মতো হবে! গ্রান্দোলি মেসিকে নিয়ে নিল। সেটা তার ফুটবলার হওয়ার পথে প্রথম ধাপ।

যাহোক, আগের কথায় ফেরা যাক। বাবা হোর্হে ও মা মারিয়া কুচিত্তিনির কাছ থেকে ক্লাব নিয়ে নেয় মেসিকে। তাকে চিনতে কারও সমস্যা হতো। দলের মধ্যে গড়নে সবচেয়ে ছোট। বাকিরা দিন-মাস-বছর ধরে বড় হয়ে উঠলেও মেসির ক্ষেত্রে তা হচ্ছিল না। ১১ বছর বয়সে উচ্চতা ছিল ৪ ফুট ৪ ইঞ্চি। গত তিন বছর ধরে অর্থাৎ ৯ বছর বয়স থেকে মেসির আর উচ্চতা বাড়েনি। হাত ও পায়ের গড়নও বয়সের তুলনায় ছোট। সাড়ে ৯ বছর বয়সে রোজারিওতে ডা. ডিয়েগো শোয়ারস্টেইনকে দেখান মেসির মা–বাবা। বছরখানেক ধরে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পর মেসির বয়স যখন ১১ ছুঁই ছুঁই, জানা গেল রোগটার নাম গ্রোথ হরমোন ডেফিশিয়েন্সি। প্রতি ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার শিশুর মধ্যে একজনের হয় এই রোগ। শরীরের ভেতর পিটুইটারি গ্রন্থির মধ্যে একটি গ্রন্থি ছিল না, যে কারণে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে মেসির শরীর পর্যাপ্ত গ্রোথ হরমোন পাচ্ছিল না। এই হরমোনের অভাবে তার হাড় থেকে মাংসের গঠন বাড়ছিল না। চিকিৎসকেরা অনুমান করেছিলেন, কোনো রকম ব্যবস্থা না নিলে মেসির উচ্চতা হবে সর্বোচ্চ ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি।

এখন মেসির উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে শুধু তাঁর ইস্পাতদৃঢ় মনোবলের কারণে। ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে হরমোন দিতে হতো। সে জন্য মাসে খরচ হতো ১ হাজার ৫০০ ডলার করে (প্রায় দেড় লাখ টাকা)। নিম্নমধ্যবিত্ত মেসির মা–বাবার সেই সামর্থ্য ছিল না। তাঁর ক্লাব নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ চিকিৎসার জন্য একবার ৩০০ পেসো দিয়ে আর পারেনি। ওদিকে স্পেন থেকে বার্সেলোনা মেসিকে নিতে চায়। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে টিস্যু পেপারে চুক্তি সাইন করার সেই গল্পও তোমাদের জানা। তবে সেই গল্পের আরেকটি দিক হলো, মেসির ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা হালে পানি পায়। কারণ, বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। বার্সা তার চিকিৎসার খরচ দিতে রাজি হয়েছিল।

রোজারিও থেকে মেসির গোটা পরিবার বার্সেলোনায় চলে এসেছিল। অন্য এক দেশে, অন্য সংস্কৃতির মধ্যে তাঁরা মানিয়ে নিতে পারেননি। আর্জেন্টিনার জন্য মেসির মা ও ভাই-বোনদের মন কাঁদত। এক রাতে তাই পারিবারিক বৈঠক বসল। প্রশ্ন একটাই, এখন কী করব? স্পেনেই থাকব না আর্জেন্টিনায় ফিরব? এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মেসিই দিতে পারত। কারণ, সবকিছু তাকে ঘিরে। বাবা মেসিকে জিজ্ঞেস করলেন,‘তুমি কী চাও?’

১২ বছর বয়সী মেসি বলেছিল, ‘আমি থাকতে চাই। আমি বার্সেলোনার হয়ে ফুটবল খেলতে চাই।’ তারপর বার্সেলোনায় মেসির সঙ্গে শুধু তার বাবা থাকলেন। মা, ভাই, বোন ফিরে গেলেন আর্জেন্টিনায়। এমন অনেক ছুটির দিন কেটেছে, মেসির বাবা হয়তো বাসায় প্লে স্টেশনে খেলছেন। মেসিও খেলছেন। কতক্ষণই–বা ভালো লাগে! হইহুল্লোড় করার কেউ নেই। মেসি অন্য রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছেন। ভাইবোনদের মনে পড়েছে। কিন্তু সেদিন মেসি বার্সেলোনায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত না নিলে আজ তোমরা যে মেসিকে দেখছ—মস্ত বড় এক ফুটবলার, বিশ্বকাপজয়ী, সর্বকালের অন্যতম সেরা কিংবদন্তি—সেই মেসি হারিয়ে যেত। স্বপ্নপূরণের জন্য কখনো কখনো খুব কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে হয়।

রোগটা ধরা পড়ার পর প্রতি রাতেই মেসিকে পায়ে ইনজেকশন নিতে হতো। সাত দিন ডান পায়ে, পরের সাত দিন বাঁ পায়ে। এভাবে তিন বছর হরমোনের ইনজেকশন নিতে হয়েছে। মেসি নিজের হাতেই ইনজেকশনগুলো পায়ে পুশ করেছেন। জেরার্দো গ্রিঘিনি একসময় তাঁর সঙ্গে খেলতেন। জেরার্দো দেখেছেন, ‘সে খুব স্বাভাবিকভাবে ইনজেকশনগুলো পুশ করত। জানত, ফুটবলার হতে তাকে এটা করতেই হবে। আমার মনে হয় না ১০-১১ বছর বয়সী আর কারও এতটা মানসিক শক্তি থাকতে পারে, যে ওই বয়সে ভাববে, আমি এখন এটা করলে ভবিষ্যতে স্বপ্নপূরণে কাজে লাগবে।’

মেসি সেই স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছেন। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের পর লুসাইলের আইকনিক স্টেডিয়ামে মেসি যখন হাঁটছিলেন, পেছন থেকে কেউ একজন এসে তাঁর গায়ে টোকা দেন। মেসি পেছন ঘুরেই দেখেন মা! পরম আনন্দে বুকে টেনে নেন। সেই যে শৈশবে মেসিকে রেখে আর্জেন্টিনায় ফিরে গিয়েছিলেন মারিয়া কুচিত্তিনো, মেসির মা—সারা জীবন ধরে তিনি যে মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন, সেই সময়টা ধরা দিতেই আনন্দে কেঁদে ফেলেন। ভিজেছে মেসির চোখও। বিশ্বকাপের খোঁজে বাড়িছাড়া হওয়ার পর বার্সেলোনার হয়ে ক্লাব ফুটবলে এমন কিছুই নেই যে মেসি জেতেননি। বাকি ছিল শুধু বিশ্বকাপ। সেই শিরোপাটা, ম্যারাডোনা ১৯৮৬ সালে এনে দেওয়ার পর যা আর্জেন্টাইনরা আর জেতেনি ৩৬ বছর। আর্জেন্টাইনদের স্বপ্নের এই বোঝাটা মেসি বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বয়ে চলেছেন। ২০০৬ বিশ্বকাপে হয়নি, ২০১০ বিশ্বকাপেও হলো না, ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠায় সুযোগ এসেছিল, সেবারও ব্যর্থ! মেসির হাতে কী তাহলে বিশ্বকাপ উঠবে না?

এই প্রশ্নের যূপকাষ্ঠে প্রতিনিয়ত পুড়েছেন মেসি। ভক্তরা সমালোচনা করেছে। মেসি ক্লাবের হয়ে যতটা দেন, দেশের হয়ে ততটা নয়। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে হার এবং তারপর কোপা আমেরিকার দুটি ফাইনালে হারের পর মেসি নিজেই হাল ছেড়ে দেন! অবসর ঘোষণা করেন জাতীয় দল থেকে। কেউ মানেনি। তাই ফিরেও আসতে হয়। কিন্তু আবারও সেই হতাশা। ২০১৮ বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকে বিদায়! তবে কি হবে না?

কাতার বিশ্বকাপে মেসি বোধ হয় নিজের সঙ্গেই বোঝাপড়া করতে চেয়েছিলেন। হলে এবারই, না হলে কখনোই হবে না! আগেই ঘোষণা দিলেন, এটাই তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। মাঠে খেললেন উজাড় করে। তাতে ফিরল ম্যারাডোনার স্মৃতি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে গোল করা ও গোল করানো মিলে মোট ১০টি গোলে অবদান ছিল ম্যারাডোনার। মেসিরও এবার তাই! ১০ গোলে অবদান। ম্যারাডোনার মতো মেসিও জিতলেন বিশ্বকাপ। তাতে কী প্রমাণিত হলো?

কখনো হাল ছাড়তে নেই। হোঁচট খেতে খেতে বারবার পড়ে গেলেও উঠে দাঁড়াতে হয় নিজের সামর্থ্যে বিশ্বাস রেখে। সব পথেরই শেষ থাকে। মেসি যেখানে থামতে চেয়েছিলেন, তার শেষ বিন্দুতেই (ফাইনাল) পেলেন আলোর দেখা। সেই আলো, যাঁর জন্য ছোটবেলা থেকে বাড়িছাড়া, পরিবারছাড়া, একাকিত্ব, ইনজেকশন, যন্ত্রণা, সমালোচনা…।

কখনো হাল ছাড়তে নেই বন্ধুরা।