ইতিহাসের দুর্ধর্ষ নারী স্নাইপার, যাঁর হাতে মৃত্যু হয়েছে ৩০৯ সৈনিকের

সোভিয়েত ইউনিয়ন রেড আর্মির স্নাইপার লুডমিলা পাভলিচেঙ্কোছবি: সংগৃহীত

প্রাচীনকালের মতো এখন আর মুখোমুখি যুদ্ধ হয় না। এখন তো আকাশ থেকেই বোমা ফেলে ধ্বংস করা হয় শত্রুকে! তবে এ যুগেও যোদ্ধাদের একটি চিরাচরিত ধরন দেখা যায়। ধৈর্য ও দক্ষতা দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পাহারা দেওয়া স্নাইপারদের কথা বলছি। স্নাইপার হলেন সামরিক বা আধাসামরিক ব্যক্তি, যাঁরা নিপুণ হাতে লক্ষ্যভেদ করতে পারেন। শত্রুর চোখের আড়ালে থেকে শত্রুর ওপর নজর রাখেন। বিশেষ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন তাঁরা। আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগারে প্রতিবার টান দেওয়ার সময় তাঁদের বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ এখানে মানুষের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন থাকে। এজন্য স্নাইপারদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

প্রাচীন রোমে স্নাইপারদের প্রথম অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়। তখন স্নাইপাররা স্করপিওস নামে এক বিশেষ আড়ধনুক ব্যবহার করতেন। এটি ৩০০ ফুটের বেশি দূরত্বে আঘাত করতে সক্ষম। বর্তমানে প্রযুক্তি বদলে গেছে। স্নাইপারদের ব্যবহৃত অস্ত্র উন্নত হতে হতে স্করপিওস থেকে এসেছে আধুনিক মার্কসম্যান রাইফেল।

ভিডিও গেম, কমিকস ও মুভি-সিরিজে বরাবরই প্রাধান্য পেয়ে আসছেন স্নাইপাররা। তবে আজ বলব ইতিহাসের দুর্ধর্ষ এক স্নাইপারের গল্প। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন রেড আর্মির স্নাইপার লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি 'লেডি ডেথ' নামেও পরিচিত।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা

লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো ১৯১৬ সালে বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দক্ষিণে বেলায়া সেরকভ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব-কৈশোরে তিনি দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। ১৪ বছর বয়সে সপরিবার কিয়েভে বসবাস শুরু করেন। সে সময়ই শুটিংয়ের হাতেখড়ি। শুটিংয়ে দক্ষতার জন্য ভেরোশিলভ শার্পশুটার ব্যাজ এবং মার্কসম্যান সনদ পেয়েছিলেন। পরে স্থানীয় অস্ত্র কারখানায় কাজ শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

রেড আর্মিতে যোগদান

২০১৫ সালে নির্মিত হয় বায়োপিক ‘ব্যাটল ফর সেভাস্তোপোল’। ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়
ছবি: সংগৃহীত

১৯৪১ সালের মাঝামাঝি সময়ে হিটলার 'অপারেশন বারবারোসা' শুরু করেন। তখন নাৎসি জার্মানির সশস্ত্র বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ শুরু করে। লুডমিলা পাভলিচেঙ্কোর কানে আসে এ খবর। দ্রুত রেড আর্মির রিক্রুটমেন্ট অফিসে গিয়ে উপস্থিত হন। রিক্রুটমেন্ট অফিসাররা প্রথমে তাঁকে নার্স হিসেবে নিয়োগ দেন। একজন স্নাইপার হওয়ার জন্য তিনি দৃঢ়চিত্ত ছিলেন। সোভিয়েত বাহিনীর হাতে রক্ষার দায়িত্ব থাকা পাহাড়ে রোমানিয়ার সৈনিকদের সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করলে রেড আর্মির ২৫তম রাইফেল ডিভিশনে স্নাইপার হিসেবে নিয়োগ দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই

লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো প্রথমে ওদেসা পোর্ট অবরোধে সামনের সারিতে লড়াই করেন। সেখানেই দক্ষতা দেখান। ১৮৭ জন শত্রু ওদেসায় তাঁর হাতে বধ হন। সিনিয়র সার্জেন্ট পদে পদোন্নতি পান তিনি। ১৯৪১ সালের অক্টোবরে নাৎসি বাহিনী ও রোমানীয় সেনাবাহিনী ওদেসার নিয়ন্ত্রণ নিলে পাভলিচেঙ্কো ও তাঁর ইউনিট সমুদ্রপথে সেভাস্তোপোলের দিকে অগ্রসর হয়। এরপর শুরু হয় ঐতিহাসিক সেভাস্তোপোলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পাভলিচেঙ্কো বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেন। তাঁর বীরত্বের কথা নাৎসিরাও জানত, পাভলিচেঙ্কোর নাম শুনলে ভয় পেত তারা। ১৯৪২ সালের মে মাস পর্যন্ত তাঁর হাতে বধ হওয়া সৈনিকের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৭। তিনি লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি পান।

এভাবেই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। একপর্যায়ে পাভলিচেঙ্কো গুরুতর আহত হলে তাঁকে রণক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে এর মাঝেই তাঁর বধ করা শত্রুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০৯–এ। যাঁদের ভেতর শত্রুপক্ষের ৩৬ জন দক্ষ স্নাইপারও ছিলেন।

যুদ্ধশেষে কী করলেন

রণক্ষেত্র থেকে প্রত্যাহারের পর পাভলিচেঙ্কোকে রেড আর্মির মেজর পদে উন্নীত করা হয়। এরপর তিনি স্নাইপিং প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে পুনরায় কিয়েভ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ইতিহাসবিদ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। পাভলিচেঙ্কো একবার সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মাননা হিরো অব সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং দুবার সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা অর্ডার অব লেনিন লাভ করেন।

বই, গান আর সিনেমায়

তাঁর স্মরণে ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ বিশেষ স্ট্যাম্প ইস্যু করে
ছবি: সংগৃহীত

লুডমিলা পাভলিচেঙ্কোর আত্মজীবনী ‘লেডি ডেথ: দ্য মেমোরিজ অব স্তালিন’জ স্নাইপার’ প্রকাশিত হলে বেশ সাড়া ফেলে। তাঁর বীরত্বের গল্প শুনে ফ্যাসিবিরোধী সংগীতশিল্পী উডি গুথরি ‘মিস পাভলিচেঙ্কো’ শিরোনামে একটি গান উৎসর্গ করেন। ২০১৫ সালে নির্মিত হয় বায়োপিক ‘ব্যাটল ফর সেভাস্তোপোল’। ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়। তাঁর স্মরণে ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ বিশেষ স্ট্যাম্প ইস্যু করে।

১৯৭৪ সালের ১০ অক্টোবর পাভলিচেঙ্কো স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার আগে দীর্ঘদিন যুদ্ধ–পরবর্তী পিটিএসডি (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার) ও হতাশায় ভুগছিলেন তিনি। আসলে যে পরিস্থিতিতে বা যে কারণেই হোক না কেন, মানুষের মৃত্যু মানুষকে কাঁদায়। যে ব্যক্তি দীর্ঘদিন যুদ্ধ বা মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত থাকেন, একধরনের ট্রমা তাকে গ্রাস করতে পারে।

যুদ্ধপরিস্থিতিতে লুডমিলা পাভলিচেঙ্কো হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। বধ করেছেন শত্রুপক্ষের সৈনিকদের। এখনো কিছু সেনাবাহিনীতে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে স্নাইপারেরা আছেন। কিন্তু তাঁদের হাতে মানুষের মৃত্যু কারোই কাম্য নয়। সত্যি বলতে বর্তমান যুগে যুদ্ধ কিংবা মানুষের মৃত্যু কোনোটাই মেনে নেওয়া যায় না। যুদ্ধ নয়, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠাই এখন পৃথিবীবাসীর লক্ষ্য। মানুষের হাতে মানুষ নিরাপদ থাকবে, এমনটাই তো সবার আশা হওয়া উচিত।