৫০ বছরে সোলসের জয়গান

কলেজের করিডরে দেখা একদিন...

১৯৯০ সালের এক পড়ন্ত বিকেল।

মন খারাপ করে বসে আছেন কয়েক তরুণ। ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাদ্যযন্ত্রগুলো। অথচ কিছুদিন আগেও এই গিটার, ড্রামস, বেজ বা কি-বোর্ড নিয়ে নিজেরাই কনসার্টে যাওয়ার জন্য টগবগ করতেন। হাজার হাজার দর্শক তাঁদের গানে গলা মেলাতেন।

এবারের পরিস্থিতি খুব ভিন্ন। এমন দু–একজন চলে গেলেন, যাঁদের কণ্ঠ বা সংগীত আয়োজন ছাড়া ব্যান্ডে গান বাঁধা খুব মুশকিল। ব্যান্ড মানেই তো দল। ব্যান্ড মানেই দল বেঁধে গান অনুশীলন করে হইহই করতে করতে কনসার্টে যাওয়া।

ব্যান্ড টিকিয়ে রাখতে গেলে কনসার্টের কোনো বিকল্প নেই। কনসার্ট আর অ্যালবামের গান ছাড়া ব্যান্ডের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দুঃসাধ্য। অন্তত সে সময়ে পরিস্থিতি এ রকমই ছিল।

এ–ই যখন অবস্থা, একদিন বুয়েটে শো করতে এলআরবি ব্যান্ডের ডাক আসে। এলআরবিও তখন সবে নতুন ব্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। গুরু চলে গেছেন এলআরবিতে আর শিষ্য রয়ে গেছেন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়ে পড়া সেই ব্যান্ডে। একজন নতুন ব্যান্ড নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখছেন আর শিষ্য ঠিক ভেবে পাচ্ছেন না ঠিক কীভাবে উঠে দাঁড়াবেন। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর প্রত্যয় তার ষোলো আনা। কাউকে না কাউকে সময়ের প্রয়োজনেই নেতার ব্যাটন হাতে নিতে হয়।

—ভাই, ব্যান্ডটা তো টিকিয়ে রাখতে হবে। আমাদের এত পুরোনো একটা ব্যান্ড!

—শোন, এলআরবির শো আছে বুয়েটে। আমাদের আগে তোদের গাওয়ার সুযোগ করে দিলে গান করতে পারবি আধা ঘণ্টা?

—আমরা কি পারব?

—পারবি না কেন? অবশ্যই পারবি। প্র্যাকটিস শুরু কর।

বুয়েট শোতে যেন নবজাগরণ হলো বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের অন্যতম সেরা ব্যান্ডের। ব্যান্ডের নাম সোলস। আর সেই তরুণ গুরু-শিষ্য হলেন আমাদের অতি পরিচিত দুই সংগীত ব্যক্তিত্ব প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চু আর সদা হাস্যমুখ পার্থ বড়ুয়া।

কী অদ্ভুত যোগাযোগ জানো? সোলস ব্যান্ডের যাত্রা শুরুও এক কনসার্টের সূত্র ধরেই।

তখন সোলসের নাম ছিল ‘সুরেলা’। সেই গল্প বরং শোনা যাক।

সেই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে…

স্বাধীনতার পরপর বাংলা গানের ছিপনৌকায় একটা পালাবদলের ঢেউ এসে লাগছিল। পপ-রক ঘরানার সেসব গান কিশোর-তরুণীরা দারুণ পছন্দ করতে শুরু করল।

চট্টগ্রামের ছেলে লুলুর বাড়িতে গানের চল ছিল। গানপাগল লুলু গিটার আর ব্যানজো বাজাতে ভালোবাসত। আরেক তরুণ সাজেদ পারদর্শী ছিল গিটার আর অ্যাকোর্ডিয়ানে। মানুষের ভিড় এড়িয়ে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হওয়া এক কনসার্টে দুই তরুণের আলাপ-পরিচয় শেষে সখ্য গড়ে ওঠে।

তারপর?

এক অদৃশ্য কনডাক্টরের নির্দেশিত পথে একে একে সব ঘটতে শুরু করে। সাজেদ আর লুলুর অদম্য আগ্রহে গড়ে ওঠে ব্যান্ড সুরেলা। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে সুরেলা বদলে যায় আত্মার সঙ্গে আত্মীকরণে। সুরেলা নাম বদলে ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে হয়ে যায় সোলস।

নাম বদলে ফেলে সোলস যেন পরিপূর্ণ ব্যান্ড হয়ে ওঠে। কঙ্গো, পারকাশনে আসেন রনি। ড্রামস–গিটার তো হলো, কিন্তু ব্যান্ডে কাউকে গান তো গাইতে হবে। ডিসি হিল পার্কে রনি একদিন তপন চৌধুরীকে নিয়ে আসেন। সোলস পেয়ে যায় বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসের অন্যতম সেরা মেলোডিমাখা কণ্ঠ তপন চৌধুরীকে। সুর-সংগীত আয়োজনের দায়িত্ব নিয়ে ব্যান্ডে যোগ দেন কিংবদন্তিতুল্য নকীব খান। রুডি-লরেঞ্জোর পর নাসিম আলী খান মাইক্রোফোনে মাত করতে শুরু করেন ইংরেজি গানে। গিটারে নিজের জাত চেনাতে শুরু করেন আইয়ুব বাচ্চু নামের এক গিটার–জাদুকর। কত কত নাম! শুধু নাম লিখতে গেলেই তো পাতা ভরে যাবে। একেকটা নামের বিনি সুতোয় জড়িয়ে থাকা কথা আর সুরের কত যে গল্প!

সোলস আক্ষরিক অর্থেই তখন মানুষ ও মাটির কাছাকাছি (এই নামে সোলসের একটা দারুণ অ্যালবাম বের হয় ১৯৮৭ সালে)। একদিকে যেমন কীর্তিনাশার ঢেউয়ে বিষাদ ভাটিয়ালি, অন্যদিকে দরগাহে মোম না জ্বেলে অন্তর প্রজ্বলনের সুরেলা আহ্বান। মুখরিত জীবনের জয়গানে যেমন তারুণ্য মাতোয়ারা, একই সময় মন শুধু মনকে ছুঁয়েই আলোড়ন তুলে ফেলা এ–প্রান্ত থেকে ও–প্রান্তে।

চট্টলার পাহাড় আর সাগরকে আলিঙ্গন করে সোলস রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে স্বনামে। ব্যান্ডের গানের জয়জয়কার শুরু হয়ে গেছে। রেকর্ডিং স্টুডিও আর সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নানা অপ্রতুল অবস্থার মধ্যেও শ্রোতারা লুফে নিচ্ছে আজম খান, লাকী আখান্দ্‌ আর ব্যান্ড সোলসকে। সোলস তখন একের পর এক গান বাঁধছে সমস্বরে।

সোলস, ‘সুপার সোলস’...

আমার ছোটবেলা কেটেছে বই পড়ে আর গান শুনে। অবশ্যই ক্লাসের পড়া শেষ করে। তখন তো এত গেজেট বা ফেসবুক ছিল না। আমরা গান শুনতাম মগ্ন হয়ে। বই পড়তে পড়তে মাথা তুলে তাকিয়ে আকাশের সঙ্গে বিষাদ বা আনন্দ ভাগাভাগি করতাম।

সে সময়টায় রেনেসাঁ, ফিডব্যাক, সোলস খুব শোনা হতো। ১৯৮৬-৮৭ সালের কথা। আমি তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ি। কত কত গান যে শুনছি আর শুনতে শুনতে লিরিক মুখস্থ হয়ে যাচ্ছে। কোথায় গিটার বাজছে আর কোথায় কি–বোর্ড—সব মাথায় ঢুকে কনসার্ট শুরু করে দিচ্ছে। মজা না ব্যাপারটা? বিনা পয়সায় কনসার্ট শোনার সুযোগ!

পার্থ বড়ুয়া

তখন এত ভাবাভাবির বয়স ছিল না, কিন্তু এখন ফিরে তাকালে আমার রীতিমতো বিস্ময় জাগে যে সোলসের প্রথম অ্যালবাম এত সমৃদ্ধ হলো কোন জাদুমন্ত্রে! লিরিকের বৈচিত্র্য, সংগীত আয়োজনের গভীরতা আর তপন চৌধুরীর দারুণ মেলোডিমাখা কণ্ঠ—সব মিলে সুপার সোলস পপ-রক ঘরানার অন্যতম সেরা অ্যালবাম মনে হয় আমার কাছে। তোমরা গানগুলো না শুনে থাকলে এই লেখা পড়েই ইউটিউবে শুনে ফেলো।

‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ তো এত বছর পরও সমান জনপ্রিয়। সোলসের বর্তমান কান্ডারি পার্থ বড়ুয়া, নাসিম আলী খান, মাসুম, আশিক আর রিয়েল যখন মঞ্চে ওঠেন—‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ না করে শো শেষ করা? নৈব নৈব চ! কিন্তু এর পাশাপাশি ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে/ অজানা হাজার কত কাজের ভিড়ে/ ছোট্টবেলার শত রং করা মুখ/ সুর তোলে আজও এই মনকে ঘিরে’র ফিরে দেখার আকুলতা অথবা ‘দরগাহে মোম জ্বেলে কী হবে/ মিথ্যে ফকির সেজে কী হবে/ অন্তর যদি না হয় সুন্দর/ বিফল হবে সাধনা’—চারপাশে এক সাইকেডেলিক আবহের অনুরণন তোলে। নকীব খানের সুর-কণ্ঠে ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ অথবা অনেক দূর থেকে ভেসে আসা বিষাদী কণ্ঠ—‘ভুলে গেছ তুমি/ ফিরে তো আসবে না/ মন বলে তবু/ দেখা হবে দুজনা।’

কিংবা নদী এসে পথ শুনলে প্রকৃতির শান্ত এক অপার্থিব ছবি ভেসে আসে। তার আগ দিয়ে আমরা যে ভালোবাসি সোনার বাংলাকে গানে আবহমান বাংলার কথা উঠে আসে ভিন্ন আঙ্গিকে। গিটার, ড্রামস আর কণ্ঠ ধরে সবাই যেন সেই গান গাইছে একসঙ্গে।

সুপার সোলস-এর পর একে একে সোলস উপহার দেয় কলেজের করিডরে, মানুষ মাটির কাছাকাছি, ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট, এ এমন পরিচয়, আজ দিন কাটুক গানে। সোলস আরেকবার যাত্রা শুরু করে। নতুন করে, নতুন সাউন্ডস্কেপ আর তত দিনে যেহেতু মিক্স-মাস্টারিংয়ের বেশ উৎকর্ষ সাধিত হয়ে গেছে—স্বভাবতই ক্যাসেট যুগের সেই নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে গান শুনতে আরও বেশি ভালো লাগে। বাদ্যযন্ত্রগুলো কানে আরাম দেয়। হেডফোনে গান শুনলে তো কথাই নেই।

এবার সোলসের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটো গানের পেছনের গল্প শোনাই তোমাদের।

মন শুধু মন ছুঁয়েছে অথচ কেন এই নিঃসঙ্গতা…

একটা গান কতকাল স্থায়ী হবে, তা বলা রীতিমতো অসম্ভব। এমন কত গান আছে, সময়কে দোর্দণ্ডপ্রতাপে বাহুবন্দী করেছে, অথচ সময় পরিভ্রমণে হারিয়ে গিয়েছে অন্তরালে। আবার কিছু গান আছে, ধীরে ধীরে শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। হয়তো অ্যালবাম প্রকাশের সময়ে সেভাবে কেউ শোনেনি, কিন্তু এক পক্ষকাল পরে সেই গানই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে, থেকে গেছে শ্রোতার কান থেকে মনে।

আবার অল্প কিছু গান আছে, যা প্রকাশের পরপরই শ্রোতারা সাদরে গ্রহণ তো করেছেই, একই সঙ্গে যুগ থেকে যুগান্তরে সেই গান নানান বয়সী শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। এ রকম গানের সঙ্গে শ্রোতা একাত্ম হয়েছে, নিজেকেই খুঁজে পেয়েছে।

সোলসের জনপ্রিয় গান অনেক। দুটো গান ধরতে বললে আমি বলব ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ আর ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা’-র কথা।

একটা গান কেন জনপ্রিয় হয়, তার আদতেই উত্তর নেই। হয়তো তার সুরটা সুন্দর বা শব্দচয়ন অনন্যসাধারণ। অথবা কোরাসটা এত সুন্দর যে শুধু কোরাসের কারণে গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অথবা ধরো কথা-সুর-কণ্ঠের সঙ্গে সংগীত আয়োজন, যাকে আমরা মিউজিক কম্পোজিশন বলি—একদম যথাযথ। সব কটিই যথার্থ। কিন্তু ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’–র বেলায় এর প্রতিটি অনুঘটক কাজ করলেও আমার মনে হয়, এই গানের প্রথম লাইনটাই যেন পুরো গানের কথা বলে ফেলেছে। এক লাইনেই অনেক কিছু বলে দেওয়া যাকে বলে!

নকীব খানের কথা আর নকীব খান-জিলু খানের যৌথ সুরে কালজয়ী গান হলো ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’। সহজ কথা আসলে সহজ করে বলা সহজ নয়। গানের ক্ষেত্রে এ কথা যেন আরও বেশি সত্য। কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, বাংলা গানে এমনকি ব্যান্ডের গানেও সহজিয়া কথা-সুরের গানই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে, স্থায়ী হয়েছে।

‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গানের লিরিক আর সুর একই সঙ্গে লেখা। নকীব খান যখন লেখায় মত্ত, পাশেই বসে থাকা বড় ভাই গুনগুন করে সুর করছিলেন। নকীব খানও সেই সুর ধরে নিজের মতো করে সুর করে লেখা শেষ করেন। তখনকার সময়ে স্টুডিও ছিল হাতে গোনা। ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং শুরু হলেও শেষ হয় ঝংকার স্টুডিওতে। তপন চৌধুরী সে সময়ে লালমাটিয়া গ্রাফিক আর্ট কলেজের ছাত্র। তখন তো মাত্র একটাই চ্যানেল-বিটিভি। বিটিভির কোনো এক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য গানটি রেকর্ড করা হয়। আর প্রকাশ পায় সোলসের প্রথম অ্যালবামে।

টাইম মেশিনে চড়ে যদি আশি থেকে নব্বইয়ের শুরুর দিকে চলে যাই, কানে এসে লাগে ব্যান্ডের অসংখ্য গান। তখন রীতিমতো ব্যান্ডের গানের জোয়ার। আমরা টিফিনের টাকা জমিয়ে ক্যাসেট কিনছি। মন দিয়ে গান শুনছি।

‘এ এমন পরিচয়’ অ্যালবাম শেষে সোলসের একটা পালাবদল হলো তো আগেই বলেছি। মূল গায়ক তপন চৌধুরী নেই, গিটার–কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু নেই, নকীব খান, পিলু খানরা তো অনেক আগেই রেনেসাঁ গঠন করেছেন—সব মিলে সোলসের একটা টালমাটাল অবস্থা।

আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরেই ব্যান্ড সংগীতজগতে পরিচিত পান পার্থ বড়ুয়া। অকপটে সে কথা তিনি স্বীকার করেন বারবার। একরকম দ্বিধান্বিত মন নিয়েই পার্থ বড়ুয়া ব্যান্ডের হাল ধরলেন। সোলসের পুরোনো সারথি নাসিম আলী খানের পাশাপাশি একঝাঁক তরুণ, মেধাবী মিউজিশিয়ান পাশে এসে দাঁড়ালেন। একটু একটু করে অ্যালবামের গান জমতে শুরু করল। এরই মাঝে রাত নেমেছে, চায়ের কাপে পরিচয়, নীরবে, আজ দিন কাটুক গানে...

কিন্তু একটা গান সবাইকে মাত করে দিল। সব গান ছাপিয়ে প্রকাশের পরপরই সবার মুখে মুখে ফিরতে লাগল। ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা, কেন এই মৌনতা আমাকে ঘিরে/ কেউ না জানুক কার কারণে/ কেউ না জানুক কার স্মরণে/ কোন পিছুটানে/ তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে।’ কবির বকুলের লেখা এই গান গেয়ে একদিকে পার্থ বড়ুয়া যেমন রাতারাতি তারকাখ্যাতি পেয়ে গেলেন, সোলসও যেন কিছুই হয়নি ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। এত ভাঙা-গড়া, উত্থান-পতন, ব্যান্ড সদস্যদের ছেড়ে যাওয়া—এক লহমায় এসব বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে আজ দিন কাটুক গানে অ্যালবাম দিয়ে নতুন করে যাত্রা শুরু করল সোলস। একটা নতুন সাউন্ডস্কেপ ধরে। নতুন সুর, কথার বৈচিত্র্য সোলসের বরাবরই ছিল। আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় পার্থ বড়ুয়ার হারমোনাইজিং, সঙ্গে একটু হাস্কি, কিন্তু তারুণ্যে পরিপূর্ণ কণ্ঠস্বরের কথা।

১৯৯৪ সালের দিকে ‘গীতি বিচিত্রা’ নামে ব্যান্ডের গানের অনুষ্ঠান হতো। সেই অনুষ্ঠানে প্রচারের জন্য সোলসের কাছে নতুন গান চাওয়া হয়। সময় বেঁধে দেওয়া হয় তিন থেকে চার দিন। এত কম সময়ের মধ্যে নতুন গান লেখা-সুর করা, তারপর মিউজিক আর রেকর্ডিং—সহজ কথা তো নয়। সোলসের পার্থ বড়ুয়ার মন বেশ খারাপ। মন খারাপ করেই প্র্যাকটিস শেষে রাত করে তাজ হোটেলে খেতে গেল সবাই। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, নাহ্‌! গান তো করতেই হবে, এত ভালো সুযোগ তো হেলায় হারানো যায় না।

গান লেখার দায়িত্ব দেওয়া হলো গুণী গীতিকার কবির বকুলকে। কবির বকুলকে পাকড়াও করে পার্থ বড়ুয়া বাসায় ফিরে এলেন। রাত তখন গভীর। পুরো শহর ঘুমিয়ে আছে। কেমন একটা নীরব-নিঃসঙ্গ চারপাশ। কবির বকুলের কলম চলতে শুরু করল। গানের মুখ আর অন্তরা মাত্র ৩০ মিনিটেই লেখা আর সুর হয়ে গেল। সবার পছন্দ হলো। ব্যস! পুরো গান লেখা-সুর হয়ে গান দাঁড়িয়ে গেল একসময়।

অনেক পরে, ২০০৯ সালে দেশে ফিরে আমি আর পার্থদা মুখোশ অ্যালবামের জন্য ছয়টা গানের কাজ শুরু করি। সে এক তুমুল ব্যস্ত সময়। একদিন পার্থদার বাসায় গান নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। পিয়ানো দেখিয়ে পার্থদা বলে উঠলেন,

—এই পিয়ানো দেখছিস না? ‘নিঃসঙ্গতা গানে’র সুর কিন্তু এই রুমে এই পিয়ানোতে বসে করা। আমি এক বসায় খুব কম সময়ে বকুলের লিরিকটা সুর করেছিলাম।

—কখনো ভেবেছিলেন এই গান এত জনপ্রিয় হবে? কালজয়ী হবে?

—একদমই না। কিন্তু কথাটা এত ভালো ছিল, সুর করতে করতেই মনে হচ্ছিল দারুণ কিছু একটা হতে যাচ্ছে।

হৃদয়ের কুঠুরিতে থেকে যাওয়া নাম…

সোলসে আসলেই দারুণ কিছু একটা হয়েছে বরাবর। গীতিকবিদের দিকে যদি তাকাও—হেনা ইসলাম, তাজুল ইসলাম, শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, সালাউদ্দিন সজল, কবির বকুল, লতিফুল ইসলাম শিবলী—অনন্য সব গীতিকবিকে আমরা পেয়েছি। তাঁদের অসাধারণ শব্দচয়ন, প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি নানাবিধ বিষয়ভিত্তিক গানের সমারোহ আমরা দেখেছি।

বাংলা ব্যান্ডের গানে সোলস একটা প্রতিষ্ঠানের নাম। এ কারণেই সোলস থেকে যাঁরা চলে গেছেন, তাঁরা প্রায় সবাই অত্যন্ত সফলভাবে গানের ক্যারিয়ার এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নকীব গান-পিলু খানের রেনেসাঁ, আইয়ুব বাচ্চুর এলআরবি বা তপন চৌধুরী সলো ক্যারিয়ারের দিকে তাকালেই আমরা এর সত্যতা টের পাই। অনেক মিউজিশিয়ান এসেছেন সোলস ব্যান্ডে। তাঁরা তাঁদের মেধা আর প্রজ্ঞায় একের পর এক সোনা ফলিয়েছেন সোলসের সঙ্গে।

সেই যে প্রায় ভেঙে যাওয়া ব্যান্ডের হাল ধরলেন সোলসের বর্তমান কান্ডারি পার্থ বড়ুয়া, শুরুতে বলেছিলাম না? খেয়াল করে দেখো, সেই ৯০ পেরিয়ে আরও ৩০ বছর চলে গেছে। ৫০ বছর ধরে সোলস আছে নিজস্ব দ্যুতিতে। আপন মহিমায়। বাংলা ব্যান্ডজগতে সোলস সারা জীবন থাকবে।

শরীর তো ক্ষয়ে যায়। আত্মার ক্ষয় নেই। আত্মা রয়ে যায়।

ঠিক যেভাবে সুরেলা কথা-সুর-সংগীতের মায়াবী জগতে শ্রোতাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় সোলস রয়ে গেছে ৫০ বছর ধরে।