আতশবাজি ও ফানুস পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর

প্রতিবছর থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানো, ফানুস ওড়ানো একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। সরকারের নানা বাধা নিষেধ থাকলেও তা মানছেন না কেউই। এর অন্যতম কারণ, বেশির ভাগ মানুষই জানেন না আতশবাজি পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর।

আতশবাজি কতটা ক্ষতিকর, তা জানার আগে জানতে হবে, এটা কাদের জন্য ক্ষতিকর। মানুষ তো বটেই, পশুপাখির জন্যও আতশবাজি হতে পারে ভয়ংকর ক্ষতির কারণ। অতিরিক্ত শব্দের কারণে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় পাখি। ২০২১ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ফোটানোর কারণে ইতালির রোম শহরে কয়েক হাজার পাখি মরে রাস্তায় পড়ে ছিল। এই পাখিগুলো হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল আতশবাজির বিকট শব্দের কারণে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে, ভয়ে বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে অনেক পাখি। এতে পাখিদের স্বাভাবিক জীবনক্রিয়া ব্যাহত হয়। তুমি যদি ভাবো, এক দিনের আনন্দ–ফুর্তিতে পাখিদের এতটুকু ক্ষতি মেনে নেওয়াই যায়। তাহলে তোমাকে আরও ভয়ংকর তথ্য দিই।

ইতালির রোম শহরে কয়েক হাজার পাখি মরে রাস্তায় পড়ে ছিল

মানুষের জন্যও এই শব্দ ক্ষতিকর, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের জন্য। কান ফাটানো শব্দে শিশুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য আতশবাজি আরও যন্ত্রণাদায়ক। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার এক শিশু আতশবাজির অতিরিক্ত শব্দের কারণে মারা গিয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পত্রিকায় আমরা সেই শিশুটির বাবার আজাহারি দেখেছি। আসলে আতশবাজি প্রতিটি মানুষের জন্যই ক্ষতিকর। এতে ব্যবহার করা হয় কার্বন ও সালফার। এই দুটি মৌল পুড়ে তৈরি হয় কার্বন মনো–অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড। এই গ্যাসগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। কার্বন মনো–অক্সাইড গ্যাস বাতাসের মাধ্যমে আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করে রক্তে মিশে যায়। ফলে শরীরের রক্ত পরিবহনে সমস্যা দেখা দেয়। পাশাপাশি ফুসফুসের ক্যানসারের জন্যও দায়ী এই গ্যাস। কার্বন মনো–অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইড মিলে তৈরি করে রেডিক্যাল। ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার জন্য এই রেডিক্যালই দায়ী।

কার্বন ডাই-অক্সাইডের ক্ষতিকর প্রভাব আমরা কমবেশি সবাই জানি। এর ফলে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়। এতে রক্তের চাপ বেড়ে যায় মস্তিষ্কে। ফলে রক্তক্ষরণও হতে পারে। এই দুই মৌলের পাশাপাশি আতশবাজিতে আরও ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম নাইট্রেট, অ্যালুমিনিয়াম ও বেরিয়াম নাইট্রেট। পরিবেশের পাশাপাশি মানুষের জন্যও এগুলো ক্ষতিকর।

এবার দেখা যাক ফানুস কতটা ক্ষতিকর। সম্প্রতি দেশে চালু হয়েছে মেট্রোরেল। মেট্রোরেলের বৈদ্যুতিক লাইনে ফানুস পড়ার কারণে ১ জানুয়ারি ২০২৩ দুই ঘণ্টা বন্ধ ছিল মেট্রোরেল। এ ছাড়া প্রতিবছর রাজধানীর নানা জায়গায় ফানুস ওড়ানো নিয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালেও রাজধানীর মহাখালী, খিলগাঁও ও মিরপুরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। দেশের বাইরে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের বড়সর দুর্ঘটনার নজির আছে। ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের একটি প্লাস্টিক ফ্যাক্টরিতে ফানুস থেকে আগুন লেগে যায়। সে আগুন নেভাতে ২০০ জন অগ্নিনির্বাপককর্মীর সময় লেগেছিল ৩ দিন। ২০২১ সালে জার্মানিতে ফানুস থেকে আগুন লেগে একটি চিড়িয়াখানার অনেক পশু মারা গিয়েছিল। সুতরাং এ ধরনের বড়সর অগ্নিকাণ্ড যে বাংলাদেশে ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

কীভাবে ফানুস থেকে আগুন লেগে যায়? ফানুসের মধ্যে মূলত মোমবাতি দিয়ে আগুন জালানো হয়। আগুন না নেভা পর্যন্ত উড়তে থাকে ফানুস। একটি ফানুস ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে ১৫ থেকে ২০ মিনিট উড়তে পারে। তারপর ফানুসটি পড়ে যায় মাটিতে। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু আগুন নিভে যায় না। ফলে এ অবস্থায় মাটিতে কোনো দাহ্যপদার্থ থাকলে তা থেকে আগুন লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া ফানুসে আটকে পড়ে মারা যায় অনেক পাখি।

আমাদের এক দিনের আনন্দের জন্য মানুষ, পশুপাখি কিংবা এই ক্ষতি মোটেই কাম্য নয়। তাই ব্যক্তি উদ্যোগে প্রত্যেকেরই সতর্ক হওয়া উচিত। অপ্রয়োজনে সরকারের নিষেধ অমান্য করে, মানুষ ও পশুপাখির ক্ষতি করে নিজের পকেটের টাকা নষ্ট না করাই উত্তম।

সূত্র: সায়েন্স ফোকাস ও অ্যানিমেল এথিকস