জোয়ান কাস্ত্রোর চেষ্টায় উপকূলে ফিরে এল প্রাণ

আমাদের গল্পের নায়ক জোয়ান কাস্ত্রো। মেক্সিকোর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের কর্টেজ উপসাগরের তীরে তাঁর গ্রাম। এই গ্রামে জেলেদের বাস। জেলেরা উপসাগরে মাছ মেরে জীবন চালায়। মাছ ধরা গ্রাম কাবো পালমোর উপসাগরে ছিল প্রবালপ্রাচীর। যেগুলো একসময় হারিয়ে যায়।

হারানো প্রবালপ্রাচীরের পুনর্জীবন দিয়েছেন কাস্ত্রো। কাস্ত্রো হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি বিশ্বের মহাসাগরগুলোকে বাঁচাতে একটি বিপ্লব শুরু করেছেন। এক প্রজন্ম আগে, এই উপকূলের জেলেরা সব মাছ ধরে উপসাগর খালি করে ফেলে। যে প্রবালপ্রাচীর তাদের জালে ধরা মাছগুলোকে লালন-পালন করেছিল, তা ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের অতি আহরণে। উপকূল থেকে এবং উপসাগরের বাইরে থেকে আসা বড় বড় ট্রলার এর জন্য দায়ী। তাদের ভারী জালের আঘাতে কোরালগুলো টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। জাহাজের নোঙরগুলো প্রবালগুলোকে ভেঙে ফেলেছিল। প্রবালপ্রাচীরটি ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাছগুলো চলে গেছে।

কর্টেজ উপসাগরের প্রবালপ্রাচীর একসময় বিখ্যাত ছিল। এটি ছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় পূর্ব উপকূলে সবচেয়ে উত্তরের প্রাচীর। সম্ভবত ২০ হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো। মার্কিন লেখক জন স্টেইনবেক যখন ১৯৪০ সালে জায়গাটি পরিদর্শন করেছিলেন, তখন তিনি বর্ণনা করেছিলেন যে কীভাবে প্রাচীরটি ‘জীবন, ছোট কাঁকড়া, কীট এবং শামুকের সঙ্গে স্পন্দিত হয়’। তিনি লিখেছিলেন, ‘একটি ছোট প্রবাল ৩০ থেকে ৪০টি প্রজাতিকে লুকিয়ে রাখতে পারে এবং প্রাচীরের রংগুলো আলোকোজ্জ্বল।’

বিখ্যাত ফরাসি সামুদ্রিক অভিযাত্রী জ্যাক কস্তা উপসাগরটিকে ‘বিশ্বের অ্যাকুয়ারিয়াম’ বলেছেন। এমনকি যখন জোয়ান তাঁর বাবার সঙ্গে মাছ ধরতে যেতেন, যখন তিনি একটি অল্প বয়সী ছেলে ছিলেন, তখন প্রবালপ্রাচীরে হাঙরের ঝাঁক ছিল। একটি ছোট নৌকা থেকে হাঙর শিকার করা আনন্দের এবং লাভজনক ব্যবসা ছিল।

কিন্তু তারপর প্রবালটি বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঙরগুলো চলে গেল অন্যান্য মাছের সঙ্গে। এককথায় হারিয়ে গেল। কাবো পালমো গ্রামটি প্রাচীরের মতো হারিয়ে যেতে বসেছিল। জীবিকা যেহেতু নেই, মানুষের বাস করার সুযোগও থাকে না। প্রবালগুলো সমুদ্রে ধুয়ে গেছে। একবার জোয়ান বলেছেন, তাঁর বাবার সঙ্গে প্রবালের মধ্যে ডুব দেওয়ার সময় তিনি নোঙর ও জালের দাগ থাকা সত্ত্বেও প্রাচীরের সৌন্দর্য দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের কারণেই এগুলো হারিয়ে গেছে।

পাল্টা লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন জোয়ান। প্রাচীরটি নিয়ে গবেষণা করার জন্য একজন স্থানীয় সমুদ্রবিদ্যার অধ্যাপককে খুঁজে পান। তাঁর সঙ্গে প্রাচীর এবং এর জীবন রক্ষার জন্য প্রচারণা শুরু করেন। অধ্যাপক পরামর্শ দেন, গ্রামবাসীর উচিত প্রবালের বেঁচে থাকা কয়েকটি অংশে মাছ ধরা বন্ধ করা। এ ছাড়া তাদের উচিত সরকারকে চাপ দেওয়া। যেন বিদেশি জাহাজগুলো দূরে রাখা যায়। এভাবে প্রাচীরগুলোকে একটি সামুদ্রিক সুরক্ষিত এলাকায় পরিণত করা যাবে। এটি একটি অসম্ভব চাওয়া মনে হয়েছিল। গ্রামবাসীকে স্বেচ্ছায় তাদের খাদ্য ও আয়ের প্রধান উৎস যা অবশিষ্ট ছিল, তা ছেড়ে দিতে হবে। দেখে মনে হচ্ছিল জোয়ান এবং তার গ্রামবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি প্রাচীরের মধ্যে একটি অবশিষ্ট আছে, যা প্রাচীরকে আবার সারিয়ে তুলতে পারবে। অধ্যাপক কথা দিয়েছিলেন, যদি প্রাচীরটিকে পুনরায় জেগে উঠতে দেওয়া হয়, তাহলে এটি আবার মাছের প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। জোয়ানের প্ররোচণামূলক শক্তির জন্য গ্রামের লোকেরা একটি নো-ফিশিং জোন তৈরি করতে রাজি হয়েছিল। সেটা ১৯৯৯ সালের কথা।

প্রায় ১০ বছর ধরে তারা অপেক্ষা করে এবং উপকূলের দিকে খেয়াল রাখে। কঠিন সময় পার করছিল গ্রামবাসী। জেলেরা সরকারের দেওয়া খাদ্যভর্তুকি নিয়েছে। কোনোমতে টিকে থেকেছে ১০ বছর। এরপর ২০০৯ সালে তারা স্বচ্ছ নীল জলে ফিরে আসা মাছের ঝাঁক দেখতে পায়। মাছগুলো প্রবালের মধ্য দিয়ে সাঁতার কাটছে। প্রাচীরের এলাকা রঙিন হয়ে উঠেছে। কিছু জেলে লোভে পড়ে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ভাঙতে চেয়েছে। কিন্তু অন্যরা বাধা দিয়েছে। ১০ বছর পর প্রথম হাঙর কাবো পালমোতে ফিরে এসেছিল। মাছের জগতে শীর্ষ শিকারি হিসেবে তারা প্রমাণ করেছিল প্রাচীরের পরিবেশগত বীরত্ব।

কর্টেজ উপসাগরের উপকূলীয় জেলেদের জন্য মাছ সরবরাহ করার ক্ষমতা ফিরে এসেছে প্রবালপ্রাচীরের। এখন সেখানে গ্রুপার, স্ন্যাপার্স, ইল, এমনকি জ্যাক টুনা মাছ রয়েছে। সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীরাও ফিরে এসেছেন গবেষণা করতে। তাঁরা বলেছেন, মাছের সংখ্যা ৪৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে নো-ফিশিং জোনে। আরও ভালো ব্যাপার হলো, সেখানে লালিত মাছগুলো আশপাশের অন্য প্রাচীরগুলোতে আবার জীবন দান করতে শুরু করেছে। বড় বড় মাছ এবং চকচকে স্বাস্থ্যকর প্রবালের পাশাপাশি ধূসর তিমিগুলো তাদের পুরোনো চারণক্ষেত্রে ফিরে এসেছে। জীববিজ্ঞানীরা খুব আগ্রহী ছিলেন। কারণ, এটি একটি উপকূলীয় মৎস্য পুনরুদ্ধার প্রকল্প দেখার জন্য ভালো একটি ক্ষেত্র। এটি প্রমাণ করে সামুদ্রিক সুরক্ষিত অঞ্চলগুলো দ্বিগুণ দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তুতন্ত্রের আবার জীবন শুরু করতে পারে।

২০০৯ সালে জেলেরা আবার তাদের কাজে ফিরেছে। বর্তমানে স্থানীয় আইন গ্রামবাসীকে জাল পাতার অনুমতি দেয়। কিন্তু বিদেশি ট্রলারগুলোকে দূরে রাখে। শুধু মাছের ওপর নির্ভর না করার জন্য গ্রামবাসী পর্যটকদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সামুদ্রিক খাবারের রেস্তোরাঁ, গেস্টহাউস এবং ডাইভিং গিয়ার বিক্রির দোকান খুলে বসেছে গ্রামবাসী। এক দশকের সংরক্ষণ ১০ বছরের জন্য জেলে পরিবারের জন্য কষ্ট নিয়ে এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভালো ফল পাওয়া গেছে। তাদের প্রবালপ্রাচীর পুনরুদ্ধার করে কাবো পালমোর লোকেরা এমন একটি ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার করেছে, যাতে আছে প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের গল্প। জেলে এবং পর্যটকদের জন্য অফুরন্ত মাছ ও সৌন্দর্যের উৎস এখন এই উপকূল। জোয়ান কাস্ত্রোর ভাইয়ের মেয়ে জুডিথ জেলেদের একজন গর্বিত মুখপাত্র। সে বলে, ‘সারা বিশ্বে কাবো পালমো থাকা দরকার।’ পৃথিবীর জন্য এখনো কী করা যেতে পারে, এটি তার উদাহরণ। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকিয়ে দেওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছে সে।

সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য জোয়ান ছিলেন শুরুর এক বিন্দু। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষা এবং মৎস্য পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বব্যাপী এটি একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে৷ সংরক্ষিত এলাকার ভেতরে এটাই প্রথম। এই উদ্যোগ প্রমাণ করে, আপনি যদি মাছ ধরা বন্ধ করেন, তবে মাছটি ফিরে আসবে—দ্রুত আর প্রচুর পরিমাণে। সমুদ্রের আশপাশের অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করবে। কানাডার নোভা স্কটিয়ার ডালহৌসি ইউনিভার্সিটির বরিস ওয়ার্ম বলেছেন, ‘প্রজাতিগুলো দ্রুত ফিরে আসে—তিন বা পাঁচ বা দশ বছরে। এতে আমরা তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক সুবিধা দেখতে পাচ্ছি।’

জোয়ানের গল্প দেখায়, সুযোগ দেওয়া হলে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও প্রকৃতি নিজেকে পুনরুদ্ধার করবে। আমাদের যা করতে হবে, তা হলো সুযোগ দেওয়া।

এবর মেক্সিকো উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরে ফিরে আসি। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ‘২০১১-১২ অর্থবছরে ইন্ডিয়ান স্যামন মাছ বা স্থানীয়ভাবে পরিচিত লাক্ষা ধরা পড়েছিল ৩ হাজার ৩০ মেট্রিক টন। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাছটির আহরণ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৬৩ মেট্রিক টনে। রূপচাঁদা ধরা পড়েছিল প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এখন ধরা পড়েছে ৯ হাজার মেট্রিক টনের কিছু বেশি। সাগরে চিংড়ি আহরণও কমেছে। এক দশকে চিংড়ি আহরণ কমেছে ১১ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। রূপচাঁদা, লাক্ষা, রিঠা কম পাওয়ার আরও একটি কারণ তুলে ধরেছেন সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন। তিনি বলেন, এসব দামি মাছ। এ জন্য বেশি পরিমাণে এসব মাছ ধরা হয়েছে। এ কারণে সাগরে এখন এসব মাছ কমে গেছে।’

আমাদের বঙ্গোপসাগরের কী হবে?

সূত্র: জিওসি মেরিন প্রোগ্রাম ডট অর্গ ও প্রথম আলো