হাস্যকর গবেষণার জন্য ‘নোবেল’ কারা দেন, কারা পান
বিড়াল কি একই সঙ্গে তরল আর কঠিন আচরণ করে!-কি, এই প্রশ্ন শুনে হাসি পাচ্ছে তো! কিন্তু জানো, এই প্রশ্ন নিয়েই একবার গবেষণা হয়েছিল। আর সেই গবেষণা ইগ নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিল। ফরাসি বিজ্ঞানী মার্ক-আঁতোয়ান ফারদাঁ দেখিয়েছিলেন, বিড়াল যেকোনো পাত্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে; পাত্র ছোট হলেও। সেই গবেষণা থেকেই বিড়ালের তরল ও কঠিন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। শুনতে হাস্যকর মনে হলেও এর ভেতরে ছিল পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা বোঝানোর চেষ্টা।
নোবেল পুরস্কার মানেই কল্পনায় আসে গম্ভীর বিজ্ঞানী, কঠিন সমীকরণ আর ভারী ভাষার গবেষণা। কিন্তু নোবেলের আরেক রকম রূপ আছে, যা দেখলে প্রথমে হাসি পায় তারপর ভাবনা শুরু হয়। এর নাম ইগ নোবেল পুরস্কার।
কী এই ইগ নোবেল
১৯৯১ সাল থেকে ইগ নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে—এমন সব গবেষণাকে, যেগুলো শুনতে অদ্ভুত ও হাস্যকর। কিন্তু এর ভেতরে আছে সত্যিকারের বিজ্ঞান।
ইগ নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক আব্রাহামস। এই পুরস্কারের আয়োজন করে অ্যানালস অব ইম্প্রোবেবল রিসার্চ নামের একটি বিজ্ঞান ও রম্যবিষয়ক সাময়িকী। মার্ক আব্রাহামস এই সাময়িকীর সম্পাদক। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ইগ নোবেল দেওয়ার সময় পুরো অনুষ্ঠানটাই যেন এক আনন্দমেলায় পরিণত হয়। প্রতিবছর হাজার হাজার মনোনয়ন থেকে পুরস্কারের জন্য ১০ জন বিজয়ীকে বেছে নেওয়া হয়।
২০২৫ সালের ইগ নোবেল দেওয়া হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। মঞ্চে আসেন গবেষকেরা। বক্তৃতা করেন খুব অল্প সময়ের জন্য। কথা শুনে দর্শকেরা হাসেন, আবার অনেক সময় থমকে যান ভাবনায়। মঞ্চে যখন গবেষকেরা নিজেদের গবেষণা উপস্থাপন করেন, তখন ওপর থেকে ঝরে পড়ে কাগজের বিমান। আর এই পুরস্কার বিজয়ীদের দেওয়া হয় ১০ ট্রিলিয়ন জিম্বাবুয়ে ডলার। তবে তার আর্থিক মূল্য প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে মজাটাই আসল।
এই পুরস্কারের উদ্দেশ্য একটাই—মানুষকে আগে হাসানো তারপর ভাবতে বাধ্য করা। বিজ্ঞান যে শুধু পরীক্ষাগার আর কঠিন বইয়ের ভেতর আটকে নেই, সেটাই দেখানো।
ইগ নোবেল পুরস্কারের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যাব্রাহামস বলেন, ‘ইগ নোবেলের ধারণা হলো মানুষের মনোযোগ ধরে ফেলা, সেটা তিন সেকেন্ডের জন্য হলেও। মানুষ যখন হাসে, তখনই সে মনোযোগ দেয়। আর বিজ্ঞান শেখানোর জন্য মনোযোগটাই সবচেয়ে দরকার।’
মানুষ কেন কলার খোসায় পিছলে পড়ে
মানুষ কেন কলার খোসায় পিছলে পড়ে—এর কারণ কখনো খুঁজে দেখেছ? বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। জিতেছেন ইগ নোবেলও।
ইগ নোবেলের ইতিহাসে এমন আরও অনেক গবেষণা আছে, যেগুলো প্রথমে কৌতুক মনে হয়। একবার গবেষণা করে দেখা হয়েছিল, গরুকে জেব্রার মতো ডোরাকাটা রং করলে মাছি কম কামড়ায় কি না। এমনকি এক গবেষণায় মৃত মাছ কি সাঁতার কাটতে পারে, সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছিল। এসব কাজ হাস্যকর মনে হলেও বিজ্ঞানীরা আসলে এর মাধ্যমে প্রকৃতি আর আচরণবিজ্ঞানকে নতুনভাবে বুঝতে চেয়েছেন।
এবারের ইগ নোবেলেও ছিল নানা মজার গবেষণা। কেউ গবেষণা করেছেন হাঁস, কবুতর বা বাদুড়ের আচরণ নিয়ে। কেউ আবার অস্বাভাবিক সব চলন বা অভ্যাসের ভেতর দিয়ে প্রাণীর স্নায়ু আর দৃষ্টিশক্তি বোঝার চেষ্টা করেছেন।
পাস্তা বানাতে গেলে কেন দলা বাঁধে না
ইতালির গবেষক ড্যানিয়েল মারিয়া বুসিয়েল্লো পরীক্ষা করেছেন, ইতালির আইকনিক পাস্তা ‘কাচিও এ পেপে’ বানাতে গেলে কেন দলা বাঁধে না? এর বৈজ্ঞানিক কারণ কী?
এই গবেষণার কথা শুনে প্রথমে হাসি পেলেও কিন্তু একটু ভাবলেই বোঝা যায়—এ সবই বিজ্ঞানের খেলা।
খাবার নিয়েও এসেছে মজার গবেষণা। কোথাও দেখা হয়েছে খাবারের উপাদান বদলালে তার গঠন বা আচরণ বদলায় কি না। আবার কোথাও গবেষণা হয়েছে প্রাণীরা কোন ধরনের খাবার পছন্দ করে আর কেন।
ছোট হবে না কেউ
ইগ নোবেলের সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো, এখানে কাউকে ছোট করা হয় না। এই পুরস্কার ব্যঙ্গ করে ঠিকই; কিন্তু সেই ব্যঙ্গের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে বিজ্ঞানচর্চার আনন্দ। অদ্ভুত প্রশ্ন করাও যে বিজ্ঞানের অংশ, সেটাই এখানে গুরুত্ব পায়।
অনেকে প্রশ্ন করেন, ইগ নোবেল পুরস্কারে কে কে গেল না বা কে পেল না? ইগ নোবেলে সে রকম কোনো প্রতিযোগিতার তালিকা থাকে না। এখানে নাম লেখাতে হয় না। গবেষণার কাজটাই নির্বাচিত হয়। কেউ উপস্থিত থাকতে পারেন, কেউ না-ও পারেন। সেটা এখানে মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য হলো ভাবনা।
হাসতে হাসতে শেখা
ইগ নোবেলের ধারণা এই বার্তা দেয়, বিজ্ঞান মানে শুধু পরীক্ষাগার আর জটিল ভাষা নয়। হাসি, কৌতূহল আর অদ্ভুত প্রশ্ন দিয়েও বিজ্ঞান শেখা যায়।
তাই কৌতূহলকে ভয় পেলে চলবে না। সব প্রশ্ন গম্ভীর হতে হবে এমনও নয়। অনেক সময় হাসি থেকেই জন্ম নেয় নতুন চিন্তা। আজ যে গবেষণায় মানুষ হো হো করে হেসে উঠছে, হয়তো আগামী দিনে সেটাই বিজ্ঞানকে নতুন পথে নিয়ে যাবে।
সূত্র: অ্যানালস অব ইম্প্রোবেবল রিসার্চ, এএফপি, ফিজ অর্গ ও সায়েন্স এক্স নেটওয়ার্ক