ভাই চশমা, তোমারে সেলাম

এই মুহূর্তে হাতের কাছে সফদর আলীকে পেলে টুপ করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ফেলতাম। তারপর বাষ্পরুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে জিলাপির প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলতাম, ‘স্যার, আমার চশমায় ওয়াইপার সেট করে দিন প্লিজ! প্লিজ প্লিজ প্লিজ!’

সফদর আলীকে চিনেছ তো? উত্তর সঠিক হয়েছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার বইয়ের সেই পাগলাটে শখের বিজ্ঞানী। আমি তার মহা মহা ভক্ত। মনে আছে নিশ্চয়ই, সফদর আলীর সব আবিষ্কারের মধ্যে চশমার ওয়াইপারও একটা। বইটা যারা পড়োনি, তাদের জন্য একটা অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি—

‘...সফদর আলীকে আবার দেখার জন্য পরের বৃহস্পতিবার আমি আবার সেই দোকানে গিয়ে একই টেবিলে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। ঠিকই সফদর আলী সময়মতো হাজির। বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল। তাই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছেন। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠি, চশমার কাচের ওপর গাড়ির ওয়াইপারের মতো ছোট ছোট দুটি ওয়াইপার সাঁই সাঁই করে পানি পরিষ্কার করছে। দোকানের ভেতরে ঢুকে কোথায় কী একটা সুইচ টিপে দিতেই ওয়াইপার দুটি থেমে গিয়ে ওপরে আটকে গেল।

সফদর আলী আমার দিকে তাকিয়ে একটু লাজুকভাবে হেসে কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “বৃষ্টিতে চশমা ভিজে গেলে কিছু দেখা যায় না কিনা!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় পেলেন এ রকম চশমা?”

“পাব আর কোথায়, নিজে তৈরি করে নিয়েছি।”

আমি তখনই প্রথম জানতে পারলাম, সফদর আলী আসলে একজন শখের বিজ্ঞানী...।’

আমার মতে, চশমার ওয়াইপার সফদর আলীর একটা মহা আবিষ্কার। চশমিশ হয়ে থাকলে তুমিও নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবে। না হয়ে উপায় কী! এই যে কী সুন্দর শীতের সকাল, গরম কাপড় আর নাকেমুখে মাস্ক পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছি। বলা নেই কওয়া নেই চশমায় জমে গেল বাষ্প! চোখের সামনে দিয়ে স্বয়ং সফদর আলী হেঁটে গেলেও চেনার উপায় নেই।

বিকল্প সমাধানও দেখছি না। এমনিতে ঢাকার বাতাস বিশ্বে ‘নামকরা’, তার ওপর শীতকাল, মাস্ক না পরে রাস্তায় বেরোলে প্রতি পাঁচ পদক্ষেপে একটা করে হাঁচি অনিবার্য। এই হাঁচি ঠেকাতে করোনাকালের বন্ধু মাস্ক পরেই পড়েছি বিপাকে। নিশ্বাস ফেললে বাতাস ধাক্কা খাচ্ছে মাস্কে, আর চোখ হচ্ছে বাষ্পরুদ্ধ। কিন্তু এর সমাধানদাতা সফদর আলীকে এখন কোথায় পাই! আর তার চশমার ওয়াইপারই-বা কোথায় মিলবে! এ যেন ‘ওয়ান পিস মেড কারিগর ডেড’!

নাকে বসে ধরে কান

কদিন আগে গিয়েছিলাম অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার দেখতে। সাগরতলের রঙিন জগৎ দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, আরে, আমার চোখে তো এখন দুইটা চশমা। সিনেমাটা ত্রিমাত্রিক, কাজেই চশমার ওপর চশমা পরতে হয়েছে। আর তখনই মনে পড়ল, কলেজে এক স্যার আমাকে ডাকতেন ‘চার চোখ’ নামে। ‘এই যে চার চোখ, দাঁড়াও। বলো দেখি...।’ তো চার চোখের কথা ভাবতেই মনে হলো, স্যার এখন আমাকে দেখলে কী বলতেন? ছয় চোখ? নিজেকে ‘মোর পাওয়ারফুল’ মনে হলো!

মার্কিন রাজনীতিবিদ ন্যান্সি পেলোসি বলেছেন, ‘বি ইয়োরসেলফ, নো ইয়োর পাওয়ার...।’ সমস্যা হলো, আমার নিজের পাওয়ারের কথা একেবারেই মনে থাকে না! আমার নিজের পাওয়ার বলতে আমার চমশার পাওয়ারের কথা বলছি। প্রতিবার চশমা বদলানোর সময় দ্বিধায় ভুগতে থাকি। আমার চশমার পাওয়ার কি মাইনাস টু পয়েন্ট সেভেন ফাইভ? নাকি মাইনাস থ্রি? দ্বিধা দূর হয় না পুরোনো চশমার যাবতীয় কাগজ কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ায়। কাজেই আবার ডাক্তারের কাছে যাও রে, আবার চোখ দেখাও রে!

প্রথমবার ডাক্তারকে চোখ দেখিয়েছিলাম কলেজে ওঠার পরপরই। অধিকাংশের যা হয়, আমারও তা-ই হয়েছিল। ক্লাসে বোর্ডের লেখা দেখে একসময় মনে হলো, ব্যাপার কী, সব এত ঝাপসা কেন? চোখ দেখে ডাক্তার একেবারে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো আওড়ালেন, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’

উদ্‌গ্রীব হয়ে বললাম, ‘কেন, খারাপ কিছু?’

ডাক্তার বললেন, ‘চশমা লাগবে।’

ব্যস, সেই থেকে চশমা আমার নাকে বসে কান ধরে ফেলল! ধাঁধাটার কথা মনে আছে তো? ‘কোন সে শয়তান, নাকে বসে ধরে কান?’ উত্তরটা সহজ—চশমা। তবে চশমা মোটেও শয়তান নয়, আমার পরম বন্ধু। ও ছাড়া জগৎ ধীর গতির ইন্টারনেটে দেখা ভিডিওর মতো—ঝাপসা!

ভেটোরি হওয়ার বিপদ

‘চার চোখ’ উপাধি দেওয়া ওই স্যারের কথা এল বলে আরেক স্যারের কথা বলি। স্যার একদিন বললেন, ‘চশমা পরে বোর্ডের লেখা পড়তে পারছিস?’

বললাম, ‘জি স্যার, সব পরিষ্কার।’

স্যার এবার আমার এক বন্ধুকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘উচ্চারণ কর, “খাওয়ার পরে চশমা পরে বইটা পড়ে ফেলতেই হাত থেকে কলমটা পড়ে গেল”।

আমার বন্ধু উচ্চারণ করল, ‘খাওয়ার “পরে” চশমা “পরে” বইটা “পরে” ফেলতেই কলমটা “পরে” গেল।’

স্যার হাসলেন, ‘তোর ভান্ডারে দেখি একটাই “র”-বয়ে বিন্দু র, ডয়ে বিন্দু ড় বলে কিছু নাই।’

সেদিন স্যার আমাদের শেখালেন ‘র’ আর ‘ড়’-এর উচ্চারণ। এক চশমার কল্যাণে কী দারুণ একটা বিষয় শেখা হয়েছিল!

চশমার সঙ্গে আরেকটা শিক্ষার কথাও মনে আছে। চশমা নেওয়ার আগে ক্রিকেট মাঠে ফাস্ট বল করতাম। নিজেকে বেশ গ্লেন ম্যাকগ্রা কিংবা মাশরাফি বিন মুর্তজা মনে হতো। চশমা নেওয়ার পর গুরু মানলাম নিউজিল্যান্ডের ডেনিয়েল ভেটোরিকে। দেখলে মনে হতো, পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগার থেকে পথ ভুলে মাঠে এসে পড়েছেন। অথচ কী জাদু তাঁর স্পিনে! অতএব আমাকেও ভেটোরির পথ ধরতে হবে। ফাস্ট বোলিংয়ে ক্যারিয়ার শেষ, স্পিন করি—বেশ বেশ!

তখন আমরা খেলতাম ‘রবার ডিউস’ নামের অদ্ভুত এক বল দিয়ে। কবজি ঘুরিয়ে বলটা ফেললেই বাঁক খায় কমপক্ষে ৪৫ ডিগ্রি কোণে। তার সঙ্গে আচমকা নাকসমান বাউন্স। খেলা পড়ল পাশের এলাকার এক বড় ভাইদের সঙ্গে। ক্রীড়ামোদী বড় ভাই এলাকার ছোট ভাইদের নিয়ে দল বানিয়েছেন। তুমুল উৎসাহ। খেলতে এলেন আমাদের মাঠে। ১০ ওভারের ম্যাচে আমরা প্রথমে ব্যাট করে কত রান তুলেছিলাম মনে নেই। দ্বিতীয় ইনিংসে আমি তাদের কাছে ধরা দিলাম সাক্ষাৎ ‘ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে! সাত কিংবা আট ওভারেই তারা ‘প্যাকেট’। সাত উইকেট নিয়ে আমি ম্যাচসেরা। ফেরার সময় ওই বড় ভাই আমার দিকে এমন এক চাহনি দিলেন যে মনে হলো বলছেন, ‘আসিস আমাদের মাঠে...।’

কদিন পর সাইকেল চালিয়ে পাশের এলাকার বড় ভাইদের এলাকায় যেতেই প্রমাদ গুনলাম। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, বড় ভাই তার বাহিনী নিয়ে আমাকে ধাওয়া দিলেন, ‘ওই চশমা চশমা! ধর ধর!’

বড় ভাইয়ের কিছু অতি উৎসাহী চ্যালা মাটির ঢেলা দিয়ে ‘কামান দাগল’! আমি প্রাণপণ প্যাডেল চেপে ত্যাগ করলাম বড় ভাইদের ‘হোম গ্রাউন্ড’। আর মনে মনে বললাম, ‘যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে, এত বেশি উইকেট আর নেওয়া যাবে না!’

চশমা খাঁটি বন্ধু

বিখ্যাত মার্কিন কার্টুনিস্ট চার্লস শ্যুলজের পিনাটস আমার খুব প্রিয় একটা কমিকস। এর একটা দারুণ চরিত্র ‘শ্রোডার’। ছেলেটা মহান জার্মান সংগীতস্রষ্টা বিটোফেনের পাঁড় ভক্ত। সারাটা ক্ষণ মাথা গুঁজে পিয়ানোতে সুর তোলে। ওই কমিকসের আরেক মজার চরিত্র ‘লুসি’ আবার শ্রোডারের মন পাওয়ার জন্য মরিয়া। শ্রোডারের পছন্দ বুঝে নানান কীর্তি করে ও। পিনাটসের একটা পর্বে আছে, বিটোফেনের জন্মদিনে লুসি একটা উপহার এনেছে শ্রোডারের জন্য। লুসি বিটোফেনের জন্মদিনের কথা মনে রেখেছে দেখে শ্রোডার ওর ‘যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য’ ত্যাগ করে বেশ পুলকিত। উপহারের প্যাকেট খুলতেই পেল একটা চশমা। সেটা চোখে পড়ে আয়নায় তাকাতেই আবিষ্কার করল, চশমাটা এলটন জনের! ম্যাজেন্টা রঙের স্ট্রবেরি শেপের বেঢপ চশমা! বোঝো অবস্থা!

এলটন জনের চশমাপ্রীতির কথা জানো বোধ হয়। ২০১৯ সালে এই বিখ্যাত ব্রিটিশ গায়ক দাবি করেছিলেন, তাঁর সংগ্রহে আছে আড়াই লাখ রোদচশমা! অথচ কৌতুকের ওই ছোট্ট ছেলেটার কথা ভাবো একবার। শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার, তোমার তিনটা চশমা কেন?’ ছেলেটা বলল, ‘একটা পরে আমি লেখাপড়া করি, একটা পরে বাইরে ঘুরে বের হই আর তিন নম্বরটা দিয়ে বাকি দুইটা চশমা খুঁজে বের করি!’

চশমা হারিয়ে ফেললে মুঠোফোনের ‘ফাইন্ড মাই ফোন’ অপশনটার কথা মনে হতো। ভাবতাম, অন্তত একটা অ্যাপ কি বানানো যায় না, যেটা চশমা খুঁজে দেবে? এই ভেবে একদিন গুগল করেছিলাম। দেখি, একটা সুইস কোম্পানি ইতিমধ্যে ‘ফাইন্ডি’ নামের একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছে! ছোট্ট একটা যন্ত্র চশমায় লাগিয়ে ব্লুটুথ দিয়ে ফোনের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেই মুশকিল আসান!

আদতে চশমা না থাকলে আমাদের মতো চশমিশ মানুষ ভীষণ মুশকিলে জীবন কাটাতাম। চশমা আমাদের পরম বন্ধু। ভাই চশমা, তোমারে সেলাম!