ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা ১০ মানুষ

আইরিশ লেখক জোনাথন সুইফটের গালিভার ট্রাভেলস বইটির নাম নিশ্চয়ই শুনেছ? জাহাজে চড়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছিলেন গালিভার। মাঝপথে সমুদ্রঝড়ে তাঁর জাহাজ হয়ে যায় লন্ডভন্ড। কোনোরকমে ভাসতে ভাসতে একটি দ্বীপে গিয়ে ওঠেন গালিভার। জ্ঞান ফিরতেই তাঁর চোখ চড়কগাছ। আরে, এরা কারা? কোথা থেকে এল এরা? সবাই মানুষ, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁদের আকৃতিটাই আশ্চর্য করেছে গালিভারকে। তাঁরা রীতিমতো গালিভারের পকেটে ঢুকে দেখছে ওই গুহায় (আসলে, সাধারণ জামার পকেট) কী আছে। গালিভারকে দেখে অবাক সে দ্বীপের সবাই। এত বড় মানুষ কোথা থেকে এল! সেই লিলিপুটদের কাছে গালিভার যেন এক দৈত্যাকার মানুষ। লিলিপুটদের বিশাল আকারের বিল্ডিংয়ের চেয়েও গালিভারের উচ্চতা বেশি। দানব না বলে উপায় আছে! লিলিপুটদের শহরে গালিভার যেমন দৈত্য বনে গিয়েছিল, আমাদের পৃথিবীতে কি সত্যি সত্যি কোনো গালিভার আছে? যার পাশে দাঁড়ালে আমাদের নিজেকে মনে হবে ছোট্ট একজন লিলিপুট? এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে। তাঁদের নিয়েই আজকের আলোচনা। পৃথিবীর সেরা ১০ জন লম্বা মানুষের ব্যাপারে জানাব আজ।

তবে লম্বা মানুষের ব্যাপারে জানার আগে আরেকটা কথা বলতে চাই। অতিরিক্ত লম্বা হওয়া কি কোনো রোগ? অনেকটা সে রকমই। চলো আগে জানি মানুষ কেন অতিরিক্ত লম্বা হয়! আসলে, মানুষের অস্বাভাবিক উচ্চতার জন্য দায়ী মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি। ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন, কী বলো?

আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে দুই চোখের ঠিক মাঝে থাকে একটি ছোট্ট গ্রন্থি। এর নাম পিটুইটারি গ্ল্যান্ড। এই গ্ল্যান্ডের সামনে থাকে একটি গ্রোথ হরমোন। এই হরমোনের কারণে আমরা লম্বা হই। কিন্তু স্বাধারণ মানুষের লম্বা হওয়ার একটা সীমা আছে। সাধারণত ২১ বছরের পর আর মানুষ লম্বা হয় না। অর্থাৎ, গ্রোথ হরমোন আর কাজ করে না। কারণ, এই বয়সে এসে একজন মানুষের গ্রোথ প্লেট বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কোনো কারণে যদি পিটুইটারি অস্বাভাবিক হারে গ্রোথ হরমোন তৈরি করতে থাকে, তবে সেই মানুষটিও অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকবে। মূলত ১৮ বছরের আগে কারও পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমার হলে মানুষ অস্বাভাবিকভাবে লম্বা হতে থাকে। বিশ্বে যেসব মানুষ অতিরিক্ত লম্বা, তাঁদের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে।

এবার আসা যাক মূল কথায়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত জন্ম নেওয়া সর্বোচ্চ লম্বা মানুষের গল্প। যদিও তাঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। আজকের লেখায় আমরা শুধু পুরুষদের নিয়ে আলোচনা করব। নারীদের নিয়ে অন্য একটি লেখায় আলোচনা করা যাবে।

১০. ডন কোয়েলার ও বার্নার্ড কয়েন

উচ্চতা: ৮ ফুট ২ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯২৫-১৯৮১ (ডন কোয়েলার) ও ১৮৯৭-১৯২১ (বার্নার্ড কয়েন)
জাতীয়তা: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র 

আজকের তালিকার সেরা দশে আছে দুজন। স্বভাবতই লেখাটি সেরা ১০ জনের পরিবর্তে সেরা ১১ জনে রূপান্তরিত হয়েছে। ডন কোয়েলারের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানাতে। তিনি ১৯৬৯ থেকে টানা ১২ বছর বিশ্বের সবচেয়ে (জীবিত) লম্বা মানুষ ছিলেন। ডনের যমজ বোনও ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন। তাঁর মা ও বাবা যথাক্রমে ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি ও ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন। ১৯৮১ সালে শিকাগোতে ৫৫ বছর বয়সে হৃদ্‌রোগে মারা যান ডন কোয়েলার।

বার্নার্ড কোয়েনও ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে লম্বা (জীবিত) মানুষ। ১৮৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়াতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর উচ্চতা নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর উচ্চতা ৭ ফুট ৯ ইঞ্চি মাপা হয়েছিল। তবে ১৯২১ সালে মৃত্যুর আগে তাঁর উচ্চতা বেড়ে হয়েছিল ৮ ফুট ২ ইঞ্চি। ২৩ বছর বয়সে মারা যান কোয়েন। 

৯. বিকাশ উপাল

উচ্চতা: ৮ ফুট ২.১ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯৮৬-২০০৭
জাতীয়তা: ভারতীয়

বিকাশ ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ছেলে। তিনি ভারতের সবচেয়ে লম্বা মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আমির খান অভিনীত রং দে বাসন্তী সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। ২১ বছর বয়সে ২০০৭ সালের ৩০ জুন ব্রেন টিউমারের অস্ত্রোপচারের সময় মৃত্যুবরণ করেন বিকাশ। 

৮. সুলতান কোসেন

উচ্চতা: ৮ ফুট ২.৮২ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯৮২ থেকে বর্তমান
জাতীয়তা: তুরস্ক

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে সুলতান কোসেন জীবিত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা মানুষ। সুলতানের জন্ম তুরস্কের মার্দিনা শহরে। পেশায় তিনি কৃষক। ক্রাচ ব্যবহার করে হাঁটতে হয় তাঁকে। বুঝতেই পারছ তাঁর পা কত বড়। আগেই বলেছি, পিটুইটারি গ্রন্থিতে টিউমারের কারণে মানুষ অস্বাভাবিকভাবে লম্বা হতে থাকে। ২০১০ সালে সুলতানের টিউমার অপসারণের চিকিৎসা করা হয়। ২০১২ সালে নিশ্চিত করা হয় যে তাঁর চিকিৎসা সফল হয়েছে। এখন আর লম্বা হচ্ছেন না তিনি। ৪০ বছর বয়সেও বেঁচে আছেন দিব্যি।

৭. এডওয়ার্ড বিউপ্রে 

উচ্চতা: ৮ ফুট ২.৯ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯৮১–১৯০৪
জাতীয়তা: কানাডা

এডওয়ার্ড সার্কাসে খেলা দেখাতেন। একজন পেশাদার কুস্তিগিরও ছিলেন তিনি। কানাডার সাচকাচোয়ানে জন্মগ্রহণ করেন এই এডওয়ার্ড। ৭ বছর বয়সে তাঁর উচ্চতা স্বাভাবিক থাকলেও ৯ বছর বয়সে উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ৬ ফুট। ১২ বছর বয়সে ৬ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতা হলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন এডওয়ার্ড। তিনি একজন ঘোড়সওয়ারও ছিলেন। ১৭ বছর বয়সে তাঁর উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ ফুট ৩ ইঞ্চি। ফলে তিনি ঘোড়সওয়ারের পেশাও ছেড়ে দেন। এরপর বাবার সঙ্গে ব্যবসার কাজে মনোযোগী হন। কিন্তু বেশি দিন আর কাজ করা হয়ে ওঠেনি। ১৯০৪ সালে ফুসফুসে রক্তক্ষরণে মারা যান এডওয়ার্ড। বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। মৃত্যুর সময় তাঁর উচ্চতা ছিল প্রায় ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং ওজন ছিল ১৭০ কেজি।

৬. ভ্যাইনো মাইলিরিন

উচ্চতা: ৮ ফুট ৩ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯০৯–১৯৬৩
জাতীয়তা: ফিনল্যান্ড

ফিনল্যান্ডের হেলসিস্কিতে জন্মগ্রহণ করেন ভ্যাইনো। তিনিও একজন পেশাদার কুস্তিগির ছিলেন। সার্কাস খেলা দেখাতে ভ্রমণ করেছিলেন ইউরোপে। ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপ থেকে ফিনল্যান্ডে দিরে আসেন এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে কাজ করা সবচেয়ে লম্বা মানুষ ছিলেন ভ্যাইনো। ১৯৪৬ সালে চাকরি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যান এবং একটি মুরগির খামার করেন। ১৯৬৩ সালে হেলসিঙ্কিতে মারা যান এই ফিনিশীয় নাগরিক।

৫. লিওনিড স্ট্যাডনিক

উচ্চতা: ৮ ফুট ৫ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯৭০–২০১৪
জাতীয়তা: ইউক্রেন

লিওনিডের জন্ম ইউক্রেনে। তবে তাঁর উচ্চতা নিয়ে দ্বিমত আছে। লিওনিডের পরিবারের তথ্যমতে, তাঁর উচ্চতা ছিল ৮ ফুট ৫ ইঞ্চি। কিন্তু তাঁর ফটোগ্রাফি থেকে হিসাব করে দেখা যায় তাঁর উচ্চতা ছিল ৮ ফুট। এখন আর সত্যিটা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। ২০১৪ সালে ৪৪ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর কারণ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ।

৪. জিন্নাত আলী

উচ্চতা: ৮ ফুট ৬ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯৯৬–২০২০
জাতীয়তা: বাংলাদেশ

জিন্নাত আলী একজন বাংলাদেশি নাগরিক। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারের রামু উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর পিতা–মাতার দ্বিতীয় সন্তান। ১১ বছর বয়স থেকে জিন্নাত আলীর বয়স হঠাৎ বাড়তে থাকে। তিনি প্রতিদিন তিন বেলায় প্রায় ৩ কেজি চালের ভাত ও সমপরিমাণ তরকারি খেতেন। জিন্নাত আলীর মাথায় টিউমার হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর চিকিৎসার ভার বহন করা হয়। কিন্তু  তারপরও ২৪ বছরের বেশি বাঁচতে পারেননি তিনি। ২০২০ সালে ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মারা যান বাংলাদেশের সবচেয়ে লম্বা মানুষটি। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বিশ্বের (জীবিত) সবচেয়ে লম্বা মানুষ ছিলেন।

৩. জন ক্যারোল 

উচ্চতা: ৮ ফুট ৮ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯৩২–১৯৬৯
জাতীয়তা: যুক্তরাষ্ট্র

ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ লম্বা ব্যক্তি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জন ক্যারোল। তিনি ১৯৩২ সালে নিউইয়র্কের বাফোলোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাফেলো জায়ান্ট নামেও পরিচিত। ১৬ বছর বয়সে তাঁর হাত ও পায়ের দৈর্ঘ্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে তাঁর মেরুদণ্ড অস্বাভাবিকভাবে বেঁকে যেতে শুরু করে। ক্যারোল চেয়েছিলেন একটা স্বাভাবিক জীবন বেছে নিতে। প্রতিদিন অফিস করতে। চাকরির জন্য চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু ওই লম্বা হওয়াটাই কাল হয় ক্যারোলের জন্য। কেউ তাঁকে চাকরি দেয়নি। তিনি ৩৭ বছর বয়সে নিজ শহর বাফোলোর কাছে একটি হাসপাতালে মারা যান।  

২. জন রোগান

উচ্চতা: ৮ ফুট ১১ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৮৬৮–১৯০৫
জাতীয়তা: যুক্তরাষ্ট্র

১৯৩০-এর দশকে রবার্ট ওয়াডলো তাঁকে লম্বায় ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে তিনিই ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষ। ১৮৬৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের হেন্ডারসনভিল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। রোগানের বাবা একজন দাস ছিলেন। ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর শারীরিক বিকাশ স্বাভাবিক ছিল। এরপর থেকেই তাঁর শরীর অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। রোগানকে সে সময় বেশ কয়েকটি সিনেমায় কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রোগান তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৪ বছর বয়সে তাঁর অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে শরীর রোগা হয়ে যায়। ফলে তিনি হাঁটতে বা দাঁড়াতে পারতেন না। মৃত্যুর আগে তিনি চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯০৫ সালে ৩৭ বছর বয়সে মারা যান রোগান। 

১. রবার্ট ওয়াডলো

উচ্চতা: ৮ ফুট ১১ ইঞ্চি
জীবনকাল: ১৯১৮–১৯৪০
জাতীয়তা: যুক্তরাষ্ট্র

ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াডলো। জন রোগান ও রবার্ট ওয়াডলোর উচ্চতা একই। ৮ ফুট ২ ইঞ্চি। কিন্তু রবার্ট ওয়াডলো পরে জন্মগ্রহণ করায় তিনিই ইতিহাসের সবচেয়ে লম্বা মানুষের খেতাব পেয়েছেন। ১৯১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম ইলিনয়ের একটি ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তাঁর ওজন ছিল প্রায় ৪ কেজি। ৫ বছর বয়সে উচ্চতা হয় ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। ৮ বছর বয়সে উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। এ বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে উচ্চতার দিক থেকে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু সে সময় এর ভালো কোনো চিকিৎসা ছিল না। পিটুইটারি গ্রন্থির যে টিউমারের কারণে এই রোগ হয় তার চিকিৎসা তখন ছিল না। ফলে মাত্র ২২ বছর বয়সেই মৃত্যুর কোলে ডুবে পড়ে রবার্ট। ১৯৮৬ সালে ওয়াডলোর আঁকারের সঙ্গে মিল রেখে আল্টন কলেজে একটি স্ট্যাচু বানানো হয়।

সূত্র: অলটপ এভরিথিং ডট কম