যেভাবে খুঁজে পাওয়া গেল ১০০ বছরের আগে ডুবে যাওয়া জাহাজ
১০০ বছরের বেশি আগে আর্নেস্ট শ্যাকলটনের জাহাজ অ্যান্টার্কটিকায় ডুবে যায়। ২০২২ সালে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে খুঁজে পাওয়া যায় হারানো জাহাজটিকে। কীভাবে এত বছর পর গবেষকেরা সাগরের গভীরে জাহাজটি খুঁজে পেলেন?
‘ছেলেরা, সে চলে গেছে।’ কথাটা আজ থেকে প্রায় ১১০ বছর আগে জাহাজের ক্রুদের উদ্দেশে বলেছিলেন আর্নেস্ট শ্যাকলটন। ১৯১৫ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ-আইরিশ এই অভিযাত্রীর নেতৃত্বে ‘এন্ডুরেন্স’ নামে একটি জাহাজ দক্ষিণ মেরুর দিকে যাত্রা করে। কিন্তু সেটি আর তীরে পৌঁছাতে পারেনি। যাত্রাপথে অ্যান্টার্কটিক বরফে আটকে ডুবে যায়। জাহাজে তখন ২৬ জন ক্রু, ৬৯টি স্লেজ কুকুর আর একটি বিড়াল ছিল। ১০৭ বছর সেই জাহাজের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে ২০২২ সালে জাহাজটি আবার খুঁজে পাওয়া গেছে।
২০২২ সালে একদল সাহসী অভিযাত্রী আবারও এন্ডুরেন্সের খোঁজে বের হন। অভিযানের নাম দেওয়া হয় এন্ডুরেন্স ২২। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্ববিদ, পরিবেশবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের নিয়ে একটা দল গঠিত হয়। দলটিকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে ইংল্যান্ডের দাতব্য সংস্থা ফকল্যান্ডস মেরিটাইম হেরিটেজ ট্রাস্ট। টানা ৩৫ দিন ধরে দলটি অ্যান্টার্কটিকায় জাহাজটির খোঁজে অভিযান চালায়। তারা যে জাহাজটি ব্যবহার করে এন্ডুরেন্স খুঁজতে গিয়েছিল, তার নাম এসএ আগুলহাস টু। এটি একটি আধুনিক জাহাজ। নানা রকম উন্নত প্রযুক্তি ছিল এতে। সোনার প্রযুক্তি ও আন্ডারওয়াটার রোবটের সাহায্যে অবশেষে এন্ডুরেন্স খুঁজে পাওয়া যায়। ২০২২ সালের ৫ মার্চ হারিয়ে যাওয়া জাহাজটি দেখতে পায় মানুষ।
এন্ডুরেন্স অনুসন্ধান
এন্ডুরেন্স২২ অভিযানে ব্যবহৃত হয় একদল রোবট ও স্ক্যানার, যা সীমিত আলোয় জাহাজের ধ্বংসাবশেষ বিশ্লেষণ করতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র ছিল SAAB Sabertooth—একটি হাইব্রিড রিমোট অপারেটিং ভেহিকল (ROV) ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানির নিচে চলাচলকারী যান (AUV), যা গভীর সমুদ্রের অনুসন্ধানে বিশেষভাবে দক্ষ।
সেবারটুথ গবেষণা জাহাজ থেকে ১০০ মাইলের বেশি দূর পর্যন্ত গিয়ে ছবি সংগ্রহ করতে পারে, যা পরে বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। ফলে যখন বরফের কারণে অনুসন্ধানী জাহাজটির পথ আটকে গিয়েছিল, তখন দূর থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো স্ক্যান করে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। এই ভাসমান যান ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরতে পারে, ফলে এটি হাইরেজল্যুশনের ক্যামেরার সাহায্যে এন্ডুরেন্সের চারপাশের স্পষ্ট ছবি তুলতে সক্ষম হয়। এসব তথ্যের ভিত্তিতে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও সমুদ্রতলের একটি ত্রিমাত্রিক মডেল তৈরি করা সম্ভব হয়।
এন্ডুরেন্স বনাম টাইটানিক
সাগরের প্রায় ৩ হাজার ৮ মিটার গভীরে ছিল এন্ডুরেন্স। কিন্তু এত বছর পরও কীভাবে এই কাঠের জাহাজ এত অক্ষত রয়ে গেছে? টাইটানিকের কথাই ধরো, প্রায় একই সময়ে একই গভীরতায় ডুবেছিল। টাইটানিকের লোহা অনেকটা ক্ষয়ে গেছে, অথচ এন্ডুরেন্স এখনো বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে।
বরফের চাপের কারণে এন্ডুরেন্স ধ্বংস হয়ে কয়েক হাজার মিটার পানির নিচে ডুবে গেলেও, এটি উল্টে না গিয়ে কিলের (জাহাজের নিচের প্রধান কাঠামো) ওপর সোজা দাঁড়িয়ে থাকে। ওয়েডেল সাগরের অতল গভীরে তাপমাত্রা শূন্য থেকে মাইনাস এক ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকায় কাঠ পচিয়ে ফেলার মতো ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবাণু টিকতে পারেনি। এ ছাড়া গভীর পানিতে অক্সিজেনের অভাবও কাঠ ক্ষয়ের হার অনেক কমিয়ে দিয়েছে। সাধারণত ডুবে যাওয়া জাহাজের কাঠ নষ্ট করে যেসব অণুজীব, সেগুলোও এত ঠান্ডা ও কম অক্সিজেনের কারণে বেঁচে থাকতে পারেনি।
অন্যদিকে টাইটানিক ছিল উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় ৩ হাজার ৮০০ মিটার গভীরে, যা লোহার জন্য ক্ষতিকর বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আদর্শ আবাসস্থল। প্রচুর আয়রন বা লোহাযুক্ত কাঠামো থাকায়, সেখানে লোহা পচনকারী অণুজীব দ্রুত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ফলে টাইটানিকের কাঠামো অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।