পাচার রোধে গন্ডারের শিংয়ে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ দিয়েছেন গবেষকেরা
বিপন্ন প্রজাতির গন্ডারকে চোরাকারবারি ও শিকারিদের হাত থেকে বাঁচাতে পদক্ষেপ নিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার উইটওয়াটারস্র্যান্ড ইউনিভার্সিটি। তাঁরা গন্ডারের শিংয়ের ভেতর তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে রাইসোটোপ (Rhisotope)। এতে কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়েশন অ্যান্ড হেলথ ফিজিক্স ইউনিট, পারমাণবিক শক্তি কর্তৃপক্ষ এবং আরও কিছু সংরক্ষণবাদী সংস্থা।
গবেষকদের দাবি, এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপগুলো গন্ডারদের জন্য মোটেও ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এগুলো শিংয়ের মধ্যে থাকায় সারা বিশ্বের কাস্টমস কর্মকর্তারা তাঁদের কাছে থাকা রেডিয়েশন স্ক্যানার দিয়ে সহজেই তা শনাক্ত করতে পারবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গন্ডার দেখা যায় দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিন্তু প্রতিবছর সেখানে শত শত গন্ডার চোরাশিকারিদের হাতে মারা যায়। ‘রাইসোটোপ’ প্রকল্পের খরচ হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার ডলার। টাকায় যা প্রায় ৩ কোটি ৫৪ লাখ ৪০ হাজার ৬৩৯। এর জন্য ছয় বছর ধরে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে গবেষকদের।
এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন উইটস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস লারকিন। তিনি জানান, ‘এখনও প্রতিদিন অন্তত একটি করে গন্ডার চোরাশিকারিদের হাতে মারা পড়ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, যদি আমরা সতর্ক না হই, তাহলে এই সংখ্যাটা কেবল বাড়তেই থাকবে। শিকার বন্ধের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, কারণ আমরা এখন শুধু প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি না বরং সমস্যা শুরু হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
অধ্যাপক লারকিন জানান, ‘২০টি গন্ডারের ওপর চালানো পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, তেজস্ক্রিয় পদার্থগুলো প্রাণীদের জন্য ‘সম্পূর্ণ নিরাপদ’। উইটস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার সঙ্গে মিলে দেখেছেন যে ৪০ ফুট লম্বা একটি শিপিং কন্টেইনারের ভেতরে থাকলেও এই তেজস্ক্রিয় শিংগুলো শনাক্ত করা সম্ভব।
দক্ষিণ আফ্রিকার গন্ডার সংরক্ষণের জন্য কাজ করা জেমি জোসেফ এই রাইসোটোপ প্রকল্পকে ‘উদ্ভাবনী ও খুবই প্রয়োজনীয়’ বলে প্রশংসা করেছেন। সংরক্ষণবাদী সংস্থা ‘সেভ দ্য রাইনো’-এর পরিচালক জেমি জোসেফ বলেন, ‘এটি কোনো চূড়ান্ত সমাধান নয়। কেবল ভালো আইন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে গন্ডার সংকট পুরোপুরি শেষ হতে পারে। তবে এই পদ্ধতিটি দেশ থেকে গন্ডারের শিং পাচার হওয়া কমাতে সাহায্য করবে এবং অবৈধ পাচারের পথগুলো চিহ্নিত করতে বিশেষজ্ঞদের নির্ভরযোগ্য তথ্য দেবে।’
‘সেভ দ্য রাইনো’ জানিয়েছে, ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছর দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪০০-র বেশি গন্ডার শিকার করা হয়েছে। রাইসোটোপ প্রকল্পের প্রধান জেসিকা বাবিচ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো আফ্রিকার এই বিখ্যাত ও বিপন্ন প্রাণীটিকে রক্ষা করতে রাইসোটোপ প্রযুক্তিকে আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি করার মাধ্যমে আমরা কেবল গন্ডার নয়, আমাদের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকেও রক্ষা করছি।’
আফ্রিকান গন্ডারের শিং সাধারণত এশিয়ার বাজারে পাচার হয়। সেখানে ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরিতে এটি ব্যবহার করা হয়। এটিকে সম্মানের প্রতীক হিসেবেও দেখা হয়। বর্তমানে সাদা গন্ডারকে বিপন্ন ও কালো গন্ডারকে গুরুতরভাবে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
গন্ডার সংরক্ষণের জন্য চালু করা এই রাইসোটোপ প্রকল্পের সুবিধা সবাই যেন পায়, সে জন্য উইটওয়াটারস্র্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগার এবং সরকারি সংস্থা সবাইকে এতে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি গন্ডারের সংরক্ষণকারীদের উৎসাহিত করছে, যেন তাঁরা নিজেদের সংরক্ষণে থাকা গন্ডারের শিংয়ে এই তেজস্ক্রিয় ইনজেকশন দেয়। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো গন্ডারের শিং পাচারকে এত কঠিন এবং বিপজ্জনক করে তোলা, যেন চোরাশিকারিদের কাছে এটি আর লাভজনক না থাকে।
সূত্র: ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং, বিবিসি, এনবিসি নিউজ