ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব সত্যেন্দ্রনাথ বসু

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে বসা সত্যেন বোস

১৯২৪ সাল। মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তখন সুইজারল্যান্ডের জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। একদিন তাঁর কাছে একটা চিঠি আসে। চিঠির সঙ্গে একটা গবেষণাপত্র। প্রেরক তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আইনস্টাইন চিঠিটা পড়লেন মন দিয়ে। তাতে একটা অনুরোধ। সঙ্গে যে গবেষণাপত্রটা পাঠিয়েছেন তরুণ বিজ্ঞানী, সেটা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক-এ। আইনস্টাইন তখন বিজ্ঞানজগতের সুপারস্টার। তাঁর কাছে এভাবে চিঠি লিখতে বুকের পাটা লাগে। শুধু প্রবন্ধ ছাপানোর সুপারিশ করার অনুরোধ হলে কথা ছিল। আইনস্টাইন তখন নিজের কাজ নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত। পৃথিবীর অন্য প্রান্তের কোনো এক অখ্যাত তরুণ কিনা আবদার করেছেন তাঁর লেখা অনুবাদের।

আইনস্টাইন বিরক্ত হননি। ছুড়েও ফেলে দেননি প্রবন্ধটা। তরুণ বিজ্ঞানীর আবদার রাখলেন তিনি। ইংরেজিতে লেখা সত্যেন বোসের প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করলেন। তারপর পাঠিয়ে দিলেন সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক-এ। সঙ্গে লিখে দিলেন একটা ছোট্ট নোট। ‘বোসের এই কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আমি অন্যত্র আলোচনা করব।’ এই একটা নোটই পাল্টে দিল এ দেশের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস।

সত্যেন বোসের জন্ম ১৮৯৪ সালের প্রথম দিনে। কলকাতার ২২ নম্বর ঈশ্বর মিল লেনে। বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের হিসাবরক্ষক। মা আমোদিনী পুরোপুরি গৃহিণী। সাধারণ একটা স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯০৭ সালে ভর্তি হন কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু স্কুলে। এন্ট্রাস পাস করেন হিন্দু স্কুল থেকেই। তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএসসি। সেখান থেকেই গণিতে বিএসসি ডিগ্রি লাভ, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। এমএসসি মিশ্র গণিতে। এবারও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। রেকর্ড শতকরা ৯২ মার্ক নিয়ে। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা আর সত্যেন বোস দুজনই শিক্ষকতা শুরু করলেন রাজারবাগ বিজ্ঞান কলেজে। সেখানকার এক শিক্ষক তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেন। প্রেসিডেন্সিতে নাকি ভালো গণিতের শিক্ষক নেই। তাই সেখান থেকে যাঁরা বের হন, গণিতের তাঁরা কিস্যুটি বোঝেন না। বিদ্রূপ সহ্য হলো না মেঘনাদ সাহা আর সত্যেন বোসের। দুজন গণিত বিভাগ থেকে ইস্তফা দিয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে যোগ দিলেন। ভাগ্যিস, পদার্থবিদ্যায় এসেছিলেন, নইলে বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানের দুই দিকপালকে পেত কি না কে জানে? ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন সত্যেন বোস। চার শ টাকা বেতনে। সেই সময়ের হিসাবে সেটা মন্দ নয়।

কী বলেছিলেন সত্যেন বোস, যেটা শুনে আইনস্টাইনও মুগ্ধ হলেন! ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে পদার্থবিজ্ঞান পড়ে এক অদ্ভুত সমস্যায়। কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ ব্যাখ্যা করতে পারছে না চিরায়ত বলবিজ্ঞান। তখন জার্মান বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক প্রকাশ করলেন তাঁর বৈপ্লবিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন ফটো-তড়িিক্রয়ার ব্যাখ্যায় ব্যবহার করলেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব।

সত্যেন বোসের প্রবন্ধটা সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক-এ ছাপা হলো ১৯২৪ সালের জুন মাসে। তত দিনে কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে মৌলিক কাজ হয়েছে তিনটে। প্ল্যাঙ্ক, আইনস্টাইন আর বোর করেছেন কাজ তিনটি। চতুর্থ কাজটি করলেন আমাদের সত্যেন বোস। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে আগে জন্ম হয়েছে বলবিদ্যার। তারপর সেখানে ঢুকেছে পরিসংখ্যান। কিন্তু কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের জন্য তখনো বলবিদ্যার জন্ম হয়নি। তার আগেই কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের জন্ম দিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম সমীকরণের ডান দিকে দুটো অংশ। একটা অংশে আলোকে বিকিরণ শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আরেকটা অংশে আলোকে দেখানো হয়েছে গুচ্ছশক্তির কণা হিসেবে। সমস্যটা হলো, ডান দিকের প্রথম অংশটির হিসাব করতে হচ্ছিল ম্যাক্সওয়েল তড়িচ্চুম্বকীয় সমীকরণের সাহায্যে। কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বকে নিউটন এবং ম্যাক্সওয়েল কারও সমীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়। সেটা সমাধান করার মতো কোনো স্বতন্ত্র অঙ্ক প্ল্যাঙ্কের জানা ছিল না। আইনস্টাইনই প্রথম বিষয়টা নিয়ে কাজ করেন। একটা সমাধানও বের করেন তিনি। কিন্তু আইনস্টাইনের সমাধানটা পুরোপুরি ঠিক ছিল না। অথচ প্ল্যাঙ্কের সেই তত্ত্ব ধরেই আইনস্টাইনের ফটোতড়িৎ ক্রিয়া, নীলস বোরের কোয়ান্টাম পরমাণুর মডেল গড়ে উঠেছে। তাই এই তত্ত্বগুলোতেই সেই ত্রুটির প্রভাব পড়েছিল। সত্যেন বোস ত্রুটিটার মূল উৎপাটন করতে চাইলেন।

সত্যেন বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কোয়ান্টাম তত্ত্ব পড়াতেন। একদিন সেটাতেই হলো ভুল। ভুল কখনো কখনো আশীর্বাদ বয়ে আনে। ‘ভুল’ ক্যাকুলেশনের যে ‘ভুল’ সমাধান বের হলো, সেটা এককথায় অভূতপূর্ব! সেটাতে কোয়ান্টামের পুরোনো ত্রুটিটা ‘নাই’ হয়ে গেছে। চমকে উঠলেন সত্যেন বোস। বুঝতে পারলেন প্ল্যাঙ্ক সূত্রের ফাঁকটা তিনি দেখে ফেলেছেন। যেটা দেখার চেষ্টা করছিলেন আইনস্টাইন, ডিবাইয়ের মতো কোয়ান্টামের দিকপালও। কিন্তু ঠিকঠাক ফাঁকটা তাঁরা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সত্যেন বোস পেলেন। ওই ভুল থেকেই। পুরো ক্যালকুলেশনটা তিনি নোট করে নিলেন। তারপর সেটা নিয়ে চলল কাটাছেঁড়া। দীর্ঘ পরিশ্রমের পর স্যত্যেন বোস প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে ত্রুটিমুক্ত করতে সমর্থ হলেন।

সত্যেন বোস আলোর কণাতত্ত্বের সম্পূর্ণ একটা কোয়ান্টাম সমীকরণ দাঁড় করালেন। সাইটস্রিফট ফ্যুর ফিজিক-এ সত্যেন বোসের সেই প্রবন্ধ প্রকাশের পর হইচই পড়ে গেল বিজ্ঞান-দুনিয়ায়। রাতারাতি সত্যেন বোসের নাম জেনে গেলেন বড় বড় বিজ্ঞানীরা। চিরদিনের মতো বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও।

মহাবিশ্বের তাবৎ বস্তুকণাকে দুটো ভাগে ভাগ করা হলো। কিছু কণা বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি ও পল ডিরাকের ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান (Fermi-Dirac Statistics) মেনে চলে, তাদের নাম দেওয়া হলো ফার্মিওন। আর যেসব কণা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান (Bose-Einstein Statistics) মেনে চলে, তাদের নাম হলো বোসন কণা। অর্থাৎ মহাবিশ্বের তাবৎ কণাদের অর্ধেকের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের সত্যেন বোসের নাম।

এরপর বোসের পরিসংখ্যান নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু করেন আইনস্টাইন। আরও পরিমার্জিত করে সুন্দর কাঠামোতে দাঁড় করান সেটাকে। এ জন্যই পরিসংখ্যানটির নাম হয়ে যায় বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। এই পরিসংখ্যানের সূত্র ধরেই জন্ম হয় বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থার (Bose-Einstein condensate)। এটাকে বলে পদার্থের পঞ্চম অবস্থা। এ এক আশ্চর্য অবস্থা। পরম শূন্য তাপমাত্রার খুব কাছাকাছি তাপমাত্রায় গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণুগুলো সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অনেকটা ফোটনের মতো আচরণ করে পরমাণুগুলো। বস্তুর ওই অবস্থাকে কঠিন, তরল, বায়বীয় বা আয়নিত—কোনোটার সঙ্গেই মেলানো যায় না। তাই ওই অবস্থার নাম দেওয়া হলো বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থা। তবে অত সহজে মেলেনি এই ঘনীভবনের দেখা। অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। বোস-আইনস্টাইন ঘনীভূত অবস্থার অস্তিত্ব পরীক্ষাগারে প্রমাণের জন্য ২০১১ সালে তিন পদার্থবিদ পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, সত্যেন বোসকে নোবেল দেওয়া হয়নি!

১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকতায় মৃত্যুবরণ করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।