‘সবার জন্য এক কিডনি’ বানালেন বিজ্ঞানীরা

ল্যাবে ইউনিভার্সাল কিডনি প্রস্তুত করা হচ্ছেছবি: ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

ভাবো তো যদি এমন এক কিডনি তৈরি করা যেত, যেটা যেকোনো রক্তের গ্রুপের মানুষ ব্যবহার করতে পারবে! এতে কত মানুষের জীবন বাঁচানো যেত, তাই না! বিজ্ঞানীরা এবার ঠিক তেমনটাই করেছেন—তাঁরা তৈরি করেছেন এমন এক ‘ইউনিভার্সাল কিডনি’। এই কিডনি যেকোনো রক্তের গ্রুপের মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হতে পারে। আগে রক্তের গ্রুপ মেলানো ছাড়া কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব ছিল না।

কানাডা ও চীনের বিজ্ঞানীদের একটি যৌথ দল এই গবেষণা করেছেন। তাঁদের পরীক্ষামূলক কিডনি একটি মৃত মস্তিষ্কের (ব্রেন-ডেড) দাতার শরীরে কয়েক দিন কাজ করেছে। মূলত এ ঘটনাই গবেষকদের নতুন আশার আলো দেখিয়েছে।

কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ

যাঁরা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট বা কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষা করেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েন O রক্তের গ্রুপের মানুষ। কারণ, O টাইপের কিডনি অন্য রক্তের গ্রুপের মানুষের শরীরে কাজ করতে পারে; কিন্তু যাঁদের রক্তের গ্রুপ O এবং কিডনির প্রয়োজন, তাঁদের O গ্রুপের দাতার কিডনির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অন্য রক্তের গ্রুপের মানুষের কিডনি O রক্তের গ্রুপের মানুষের শরীরে কাজ করতে পারে না। এ কারণে O গ্রুপের রোগীদের অপেক্ষা করতে হয় বেশি, আর অনেকেই সেই অপেক্ষার মধ্যেই মারা যান।

গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রায় ১১ জন মানুষ কিডনি না পেয়ে মারা যান। যাঁদের বেশির ভাগই O রক্তের গ্রুপের রোগী।

ইউনিভার্সাল কিডনি যেভাবে কাজ করে

রক্তের গ্রুপ নির্ভর করে ABO অ্যান্টিজেন নামে কিছু চিহ্নের ওপর, যা রক্তকণার গায়ে থাকে। এগুলো শরীরকে বলে দেয় ‘এটা নিজের’ নাকি ‘অন্যের’। যদি অন্য গ্রুপের অ্যান্টিজেন পাওয়া যায়, শরীর সেটিকে ‘শত্রু’ ভেবে আক্রমণ করে—তাই ভিন্ন রক্ত বা অঙ্গের প্রতিস্থাপন ঝুঁকিপূর্ণ।

এই সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন একধরনের বিশেষ এনজাইম, যা কাজ করে ছোট্ট কাঁচির মতো। এই এনজাইম কিডনির কোষের গায়ে থাকা টাইপ A অ্যান্টিজেনের সুগার চেইন কেটে ফেলে। ফলাফল—কিডনিটা হয়ে যায় একেবারে টাইপ O, মানে ‘সব রক্তের সঙ্গে মানানসই’রূপে।

গবেষক ও কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট স্টিফেন উইদার্স মজার উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘এটা অনেকটা গাড়ি থেকে লাল রঙের প্রলেপ তুলে নিচের নিরপেক্ষ রঙের স্তর দেখা পাওয়ার মতো। একবার সেটা করা হলে রোগীর রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা আর অঙ্গটিকে বিদেশি হিসেবে মনে করে না।’

এখনো কিছু পথ বাকি

যদিও এই পরীক্ষায় কিডনি কয়েক দিন ঠিকমতো কাজ করেছে, তৃতীয় দিনে সেটি আবার কিছুটা টাইপ A-এর বৈশিষ্ট্য দেখাতে শুরু করে। তখন শরীর কিছুটা প্রতিক্রিয়া দেখায়, তবে সেটি সাধারণত যতটা ভয়াবহ হয়, তার চেয়ে অনেক কম। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি ইঙ্গিত দেয় যে শরীর ধীরে ধীরে এমন কিডনি গ্রহণ করতে শিখছে।

জীবিত মানুষের শরীরে এই পরীক্ষার আগে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ বাকি আছে। এ কারণে এখনো জীবিত মানুষের শরীরে এই কিডনি প্রতিস্থাপনের অনুমোদন পাওয়া যায়নি; কিন্তু গবেষকরা বলছেন, তাঁরা বাস্তব প্রতিস্থাপনের দিকেই এগোচ্ছেন।

প্রতিদিন হাজারো মানুষ নতুন কিডনির আশায় অপেক্ষা করেন। যদি এই ‘ইউনিভার্সাল কিডনি’ প্রযুক্তি সফল হয়, তাহলে একদিন হয়তো রক্তের গ্রুপ আর কোনো বাধা হবে না, আর অনেক জীবনও বেঁচে যাবে।

‘যখন বছরের পর বছর ল্যাবের গবেষণা বাস্তব রোগীদের জীবনে ছোঁয়া দেয়, তখনই বিজ্ঞানীরা সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত হন’—স্টিফেন উইদার্সের এ কথাতেই বোঝা যায় তাঁদের আশা কত বড়!

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট ও নেচার বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং