ডাইনোসরদের কথা তো আমরা সবাই জানি। তাদের ফটো দেখেছি। জুরাসিক পার্ক সিনেমাতেও দেখেছি। কী বিশাল চেহারা? দেখলেই কেমন ভয় ভয় অনুভূতি হয়! একদিন বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় দেখা গেল চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডাইনোসররা, তাহলে কেমন হবে? অনেকেই হয়তো ভাবছো, যারা সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, তারা আবার ফিরবে কেমন করে? হ্যাঁ, বিজ্ঞানীরা সেই সম্ভাবনার কথাই বলছেন। আর এটা নাকি হবে ২০৫০ সালের মধ্যে!
বহুদিন আগের কথা। পৃথিবীতে এসে আছড়ে পড়েছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা এক উল্কাপিণ্ড। এতে আমূল বদলে গিয়েছিল পৃথিবীর জলবায়ু। বাতাসে ছাই-ধুলা, নানা ধরনের গ্যাসে ভরে গিয়ে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে পৃথিবী বেঁচে থাকার অযোগ্য হয়ে ওঠে, যা ডাইনোসরদের বিলুপ্তির পথ সুগম করেছিল। যদিও অনেকে মনে করেন, উল্কাপিণ্ড আঘাত হানার আরও আগে থেকেই বিলুপ্তির পথে হাঁটা শুরু করেছিল ডাইনোসররা।
২০৫০ সালের মধ্যে আমরা ডাইনোসর দেখতে পাব, এমন কথা বলছে যুক্তরাজ্যের দ্য অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউট। ইনস্টিটিউটের প্রধান ম্যাডসেন পেইরি জানিয়েছেন, কয়েক প্রজাতির ডাইনোসর পুনর্জন্ম দেওয়া হবে। আর এটা করা হবে পাখিদের থেকে।
পাখিদের থেকে? কারণ, পাখিই তো ডাইনোসরদের উত্তর-প্রজন্ম। কালে কালে আলাদা চেহারা পেয়েছে, এই যা! আর তাই পাখিদের ডিএনএর গভীরে লুকিয়ে রয়েছে কোটি কোটি বছর আগের ডাইনোসরদের ইতিকথা। নির্বাচিত প্রজনন ও জিন প্রযুক্তির সমন্বয়ে সেই সময়ের ডাইনোসরদের শারীরিক গঠন, যেমন মুখ, দাঁত, লেজ, সামনের ছোট ছোট ডানা তৈরি করা হবে। এভাবেই আমরা পাব একটা আস্ত ডাইনোসরকে।
আমরা জুরাসিক পার্ক সিনেমায় ডাইনোসরদের নবজীবন পাওয়া দেখেছি। সেই সিনেমায় দেখা যায়, বিজ্ঞানীরা ডাইনোসরের ডিএনএর কপি সরীসৃপের ডিমের ভেতরে স্থাপন করেছেন। সেই ডিম থেকে জন্ম নেয় জুরাসিক আমলের ডাইনোসর। যদিও পরীক্ষার কাজে ব্যবহার করা যায় ডাইনোসরের এমন ডিএনএ আজ পর্যন্ত মেলেনি। তাই ডাইনোসরের পুনরুত্থানকে কেউ কেউ কষ্টকল্পনা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, একুশ শতক ফুরানোর আগেই তাঁরা তা পেয়ে যাবেন।
তাঁদের এই আশার পেছনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বিজ্ঞানী রবার্ট ল্যানজার বিপন্ন প্রজাতির একটি বুনো ষাঁড়ের ক্লোনিং সাফল্য। ২০০৩ সালে আমেরিকার সান ডিয়াগো চিড়িয়াখানা রবার্ট ল্যানজাকে এই বুনো ষাঁড়ের ক্লোন করার অনুরোধ করে। ষাঁড়টি ২৫ বছর আগে মারা গিয়েছিল। ল্যানজা সেই ষাঁড়ের মৃতদেহ থেকে ব্যবহারযোগ্য সেল নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে সেটা উটাহর একটি খামারে পাঠিয়ে দেন। সেখানে একটি গাভিতে সেটা ইমপ্ল্যান্ট করা হয়। ১০ মাস পর সুখবর আসে। জন্ম নিয়েছে বুনো ষাঁড়।
বুনো ষাঁড়ের ডিএনএ পাওয়া গিয়েছিল। তাই সহজে এটা করা গেছে। কিন্তু ডাইনোসর তো বিলুপ্ত হয়েছে ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। তাই বুনো ষাঁড়ের প্রক্রিয়ায় ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনা সম্ভবত সম্ভব নয়। এমনটাই বলছেন ফিজিকস অব দ্য ফিউচার বইয়ের লেখক মিচিও কাকু (সূত্র)। এদিকে ডাইনোসরের ঊরুর হাড়ের ফসিলে সফট টিস্যু পাওয়া গেছে। এই টিস্যু থেকে ডিএনএ নয়, শুধু প্রোটিনের প্রতিলিপি পাওয়া গেছে। আর এই প্রোটিন থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে টাইরানোসারাস রেক্স নামের ডাইনোসরের সঙ্গে ব্যাঙ ও মুরগির ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। তবে এগুলো থেকে ডাইনোসরের জিনোম একত্র করা সুদূরপরাহত।
তবে মিচিও কাকুর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দ্য সেলফিশ জিনখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স ডাইনোসরদের ফিরিয়ে আনার আশা জিইয়ে রেখেছেন। কারণ হিসেবে তিনি জানান, সরীসৃপদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির জিনোমের জেনেটিক্যালি তুলনা করে, পরে তা থেকে গাণিতিকভাবে একটি সাধারণ ডাইনোসরের ডিএনএ সিকোয়েন্স পুনর্গঠন করা সম্ভব। তিনি উল্লেখ করেন, মুরগির ঠোঁটকে দাঁতে
রূপান্তরিত করা খুবই সম্ভব। যদিও দাঁতের প্রাচীন বৈশিষ্ট্যগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে। তবে জিনোমের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে সেসব।
জীববিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে জিন যেকোনো সময় খোলা যাবে (টার্ন অন), আবার বন্ধও রাখা (টার্ন অফ) যাবে। এর মানে হলো জিনের প্রাচীন বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব এখন না থাকলেও এটি সুপ্ত আছে। এই সুপ্ত জিনের বৈশিষ্ট্যগুলো যদি কোনোভাবে আবার ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে প্রাচীন বৈশিষ্ট্যগুলো আবার ফিরে আসবে।
যেমন প্রাচীন সময়ে মুরগির পায়ের সঙ্গে একধরনের পর্দা (ওয়েবিং) ছিল। এই পর্দা কিন্তু মুরগির জিন থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি। সুপ্ত অবস্থায় আছে মাত্র। জিন চালু করার মাধ্যমে মুরগির পায়ের পর্দা আবার ফিরিয়ে আনা যাবে। এখন আমরা যদি ধরে নিই মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগের ডাইনোসরের জিন পাখির জিনোমের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, এই সুপ্ত জিনগুলো যদি সক্রিয় করে দিতে পারি, তাহলে পাখিগুলো ডাইনোসরের বৈশিষ্ট্য পেয়ে যাবে। বিজ্ঞান গবেষণা দিন দিন যে হারে উন্নতি করছে, এই প্রক্রিয়ায় ডাইনোসরদের ফিরে আসা মোটেই অসম্ভব নয়!
সূত্র: ফিজিকস অব দ্য ফিউচার/ মিচিও কাকু