যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাবে

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে প্রতিবাদ সমাবেশছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মধ্যে উত্তেজনা চলছে। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ভর্তি থেকে বিরত রাখার হুমকি দেন। এটি যদি কার্যকর হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। মোট শিক্ষার্থীর এক চতুর্থাংশেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাদ পড়বে। এত পরিমাণ শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি হার্ভার্ডের মতো স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিপর্যয় হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। হার্ভার্ড ক্যাম্পাসের জন্য এটি ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপরও পড়বে ব্যাপক প্রভাব।

তবে গত শুক্রবার এক ফেডারেল জাজ ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন। ঘটনাটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও সতর্কবার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসন উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে বিরোধী মনোভাব দেখিয়েছে। হার্ভার্ডের তুলনায় এনওয়াইইউ (নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি), জনস হপকিন্স, কলম্বিয়া ও কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অনুপাত বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কত শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী

একসময় মনে করা হতো, যুক্তরাষ্ট্রের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশি, সেটির আন্তর্জাতিক খ্যাতি বা সুনামও বেশি। একে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক সক্ষমতার প্রতীকও মনে করা হতো। কিন্তু এখন এটিই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীন ও ভারতের শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। এই দুই দেশে গত দুই দশক ধরে মানুষের আয় বেড়েছে। ফলে গত দুই দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। কারণ অনেক পরিবার নিজেদের সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুঁকির আরও কিছু কারণ আছে। বিশেষ করে সরকারি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্টেট বা রাজ্য সরকার ধীরে ধীরে বরাদ্দ কমিয়ে দিচ্ছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের দিকে ঝুঁকেছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা সাধারণত সম্পূর্ণ টিউশন ফি দিয়ে পড়াশোনা করে।

আমরা এখন চীনের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি নিয়ে অনেক আলোচনা করছি। ওটা হলো পণ্যের ঘাটতি। কিন্তু যদি সেবা খাতের কথা ভাবি—যেমন উচ্চশিক্ষা, তাহলে এখানে আমরা বিশাল উদ্বৃত্তে আছি
সান দিয়েগোর অর্থনীতিবিদ গৌরব খান্না

যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে সরব হওয়ার কারণে। যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশ থেকে যা আমদানি করে, তার চেয়ে কম সে দেশে রপ্তানি করলে সেটিকে ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য ঘাটতি হিসেবে দেখছে। ফলে দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ট্যারিফ বা কর হার বাড়িয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলছে ভিন্ন কথা। যেমন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান দিয়েগোর অর্থনীতিবিদ গৌরব খান্না আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার ধারার পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এখন চীনের সঙ্গে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি নিয়ে অনেক আলোচনা করছি। ওটা হলো পণ্যের ঘাটতি। কিন্তু যদি সেবা খাতের কথা ভাবি—যেমন উচ্চশিক্ষা, তাহলে এখানে আমরা বিশাল উদ্বৃত্তে আছি।’ এর মানে যুক্তরাষ্ট্রে চীন বা ভারত থেকে বহু শিক্ষার্থী পড়তে যায়। তবে চীন বা ভারতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পড়তে আসে খুব কম শিক্ষার্থী।

উচ্চশিক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাত। এতে যে সব বিদেশি শিক্ষার্থী অংশ নেয়, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কমিউনিটিতে বসবাস করে। যেখানে তারা বাসাভাড়া দেয়, খাদ্যসামগ্রী কেনে এবং বইয়ের পেছনেও অর্থ ব্যয় করে। আন্তর্জাতিক শিক্ষাবিষয়ক অলাভজনক সংস্থা নাফসার এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ১১ লাখের বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী মার্কিন অর্থনীতিতে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখেছে। যার বেশিরভাগই টিউশন ফি ও আবাসন ব্যয়।

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ফাইল ছবি: এএফপি

এর বিপরীতে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয় বা ফেডারেল প্রকল্প থেকে সরাসরি আর্থিক সহায়তা পায়। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেকেই কম টিউশন ফি দিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। ফলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা টিউশন বাবদ মার্কিন শিক্ষার্থীদের চেয়ে দেড় গুণের বেশি অর্থ প্রদান করে।

এটাকে অন্যভাবে দেখা যায়। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের দেওয়া উচ্চ টিউশন ফি আসলে মার্কিন শিক্ষার্থীদের কম খরচে পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করে। কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য স্থানীয় বা বাইরের স্টেটের শিক্ষার্থীর তুলনায়ও বেশি টিউশন ফি নির্ধারণ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায়, তবে শুধু পড়াশোনার ক্ষতি হবে না, গবেষণা বা ভবিষ্যতের দক্ষ কর্মী তৈরি হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়বে। আর্থিক দিক দিয়েও বড় ধাক্কা লাগতে পারে। হার্ভার্ডের ক্ষেত্রে যেভাবে প্রশাসন থেকে হুমকি এসেছে, এর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতি আর গবেষণায় ফেডারেল অনুদান কমিয়ে দেওয়ার কারণে। অনেক দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান হার্ভার্ডের অ্যালামনাই বা হার্ভার্ডে পড়াশোনা করেন। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপ্রধানদের অনেকেই নিশ্চয়ই হার্ভার্ড পাশ করা ব্যক্তি হবেন। এখন ট্রাম্প প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উত্তেজনায় তারাও ক্ষুব্ধ হতে পারেন। বিপদে পড়তে পারে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা হাজারো শিক্ষার্থী। এই বিপদ কি শীঘ্রই কেটে যাবে? এটিই এখন দেখার অপেক্ষা।

আরও পড়ুন