কিডনি প্রতিস্থাপন: কেন করা হয়, কীভাবে করা হয়

সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য নামের মেয়েটি আমাদের সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশে এই প্রথম ‘ব্রেন ডেড’ রোগীর কিডনি ও কর্নিয়া চার জীবিত ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের এই প্রক্রিয়ার নাম হলো ক্যাডাভেরিক বা ডিজিজড কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট অর্থাৎ সদ্য মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন। উল্লেখ্য, জীবিত ব্যক্তির শরীর থেকেও কিডনি নেওয়া যায়, একে বলে লিভিং কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট। আজ আমরা জানব কেন আর কীভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।

কাদের দরকার হয় কিডনি

আমাদের শরীরের এক জোড়া কিডনির মূল কাজ হলো রক্তের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে নিষ্কাশন করা। এর বাইরেও কিডনির আছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ। যেমন শরীরে পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষা করা, অ্যাসিড বেস ব্যালান্স বা অম্ল-ক্ষারের ভারসাম্য বজায় রাখা, রক্তের লোহিত কণা উৎপাদনের জন্য ইরাথ্রোপোয়েটিন হরমোন তৈরি করা, ভিটামিন ডিকে কার্যকর করার মাধ্যমে ক্যালসিয়াম বিপাক নিয়ন্ত্রণ করাসহ নানা কাজের দায়িত্ব কিডনির। তাই কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়লে শরীরের সব সিস্টেম মুখ থুবড়ে পড়ে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, জন্মগত কিডনি রোগ, কিডনির গ্লোমেরুলার ডিজিজ ইত্যাদি কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন শত শত মানুষের কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়ছে। কোনো মানুষের কিডনি কতটা ভালো কাজ করছে, তা জানার জন্য বিজ্ঞানীরা যে সূচক ব্যবহার করেন, তার নাম গ্লোমেরুলার ফিলট্রেশন রেট বা জিএফআর। কোনো সুস্থ ব্যক্তির জিএফআর সাধারণত ১২০ মিলিলিটার, প্রতি মিনিটে প্রতি ১ দশমিক ৭৩ স্কয়ার মিটারে। যদি এই জিএফআর কমতে কমতে ১৫–এর নিচে চলে আসে, তখন তা প্রাণসংহারী হয়ে ওঠে। তখনই দরকার হয় কৃত্রিমভাবে কিডনির কার্যকারিতা পরিচালনা করার ব্যবস্থা নেওয়া। দুইভাবে এটা করা যায়। এক. ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে, দুই. অন্য কারও কিডনি প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে। এর মধ্যে ডায়ালাইসিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ব্যয় দুটোই বেশি। কারণ, নিয়মিত ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়া কেবল ব্যয়সাপেক্ষই নয়, রোগীর জন্য কষ্টকরও। তার চেয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন অনেক ভালো পদ্ধতি। কিন্তু সমস্যা হলো, কিডনি কোথায় পাওয়া যাবে?

কিডনি প্রতিস্থাপনের ইতিহাস

১৯৫৪ সালে বোস্টনে জোসেফ মুরে এক যমজ ভাইয়ের কিডনি আরেক ভাইয়ের শরীরে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করেন। এই প্রতিস্থাপিত কিডনি আট বছর টিকে ছিল। এই সাফল্যের জন্য জোসেফ মুরে ১৯৯০ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এর পর থেকে কিডনি অকার্যকারিতা বা এন্ড স্টেজ কিডনি ডিজিজের রোগীদের বেঁচে থাকার একটি অন্যতম অবলম্বন হয়ে ওঠে কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এই চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, কিডনিদাতা বা ডোনার পাওয়া। কে-ই বা নিজের একটা কিডনি অন্যকে দিয়ে দিতে রাজি হবেন? তাই বিজ্ঞানীরা বিকল্প উপায় খুঁজছিলেন। একটি উপায় হলো যদি সদ্য মৃত কোনো ব্যক্তির, যাঁর আর কিডনির দরকার নেই, তাঁর শরীর থেকে কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়। ১৯৫৫ সালে লন্ডনে প্রথম বিজ্ঞানীরা এই প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু বিফল হন। পরবর্তীকালে ১৯৫৯ সালে যুক্তরাজ্যের লিডসে প্রথম মৃত ব্যক্তির কিডনি অন্যের শরীরে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়, যা টিকে ছিল আট বছর। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রধান উৎস হচ্ছে ডিজিজড বা মৃত ব্যক্তির কিডনি। পাশ্চাত্যে প্রতি ১০টি কিডনি প্রতিস্থাপনের মধ্যে ৬টিই নেওয়া হয় মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে। সাধারণত কোনো জটিলতা না হলে মৃত ব্যক্তির শরীর থেকে নেওয়া কিডনি আরেকজনের শরীরে ১০ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে পারে। যেহেতু একজন মানুষ একটি সুস্থ কিডনি নিয়েই বেঁচে থাকতে পারে, তাই একজন মৃত ব্যক্তির কিডনি দুজন কিডনি অকার্যকর রোগীর জীবন বাঁচাতে সক্ষম।

কার শরীর থেকে নেওয়া যাবে কিডনি

ব্রেন ডেড ঘোষণা করা হয়েছে এমন ব্যক্তি মানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) যন্ত্রের সাহায্যে অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ এখনো সচল আছে, কিন্তু তাঁকে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেছেন, এমন ব্যক্তির শরীর থেকে কিডনি নেওয়া হয়। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আগপর্যন্ত যন্ত্রের সাহায্যে তাঁর হৃৎস্পন্দন বা বিটিং হার্ট নিশ্চিত রাখা হয়, যাতে দান করা অঙ্গগুলোয় রক্ত পরিসঞ্চালন অব্যাহত থাকে। কেবল কিডনি নয়, হার্ট, প্যানক্রিয়াস, যকৃৎ, ফুসফুস ইত্যাদি অঙ্গ দান করার মাধ্যমে একজন মানুষ নিজের মৃত্যুর পর আটজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পারেন। এর বাইরে কর্নিয়া, ত্বক, হাড়ের অংশ ইত্যাদি দান করার মাধ্যমে আরও ৭৫ জন মানুষের জীবনকে সুন্দর করে তুলতে সাহায্য করতে পারেন।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ‘ব্রেন ডেড’ রোগীর দান করা কিডনি অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ১৮ জানুয়ারি রাতে। এই কিডনি দান করে গেছে সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য

কীভাবে নেওয়া হয় কিডনি

যদি কেউ মৃত্যুর আগে অঙ্গ দানের সম্মতি দিয়ে থাকেন বা তাঁর পরিবার এতে সম্মত হয়, তবে ব্রেন ডেথ ঘোষণা করার পরপরই তাঁর শরীর থেকে অঙ্গ সংগ্রহ করা হয়। তাঁকে অপারেটিং রুমে নিয়ে যথাস্থানের ৪ থেকে ৭ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা কেটে কিডনি বের করে আনা হয়। যেহেতু সে সময় রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায়, তাই বিশেষ ধরনের স্টোরেজ সলিউশন বা বরফশীতল তরল দিয়ে অঙ্গগুলো দ্রুত ফ্লাশ করা হয়। এর ভেতরকার রক্ত যেন জমাট বেঁধে না যায়, সে জন্য যথেষ্ট অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট যেমন হেপারিন ব্যবহার করা হয়। তারপর জীবাণুমুক্ত কনটেইনারে বরফের মধ্যে সংগ্রহ করে দ্রুততম সময়ে তা গ্রহীতার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিস্থাপনের আগে গ্রহীতার কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষার দরকার হয়। সাধারণত দাতার শরীর থেকে সংগ্রহ করার পর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রহীতার শরীরে তা প্রতিস্থাপন করার নিয়ম।

কীভাবে তুমি হতে পারো একজন ডোনার

উন্নত বিশ্বে অঙ্গ দানে আগ্রহী ব্যক্তিদের একটি রেজিস্ট্রার রাখা হয় হাসপাতালগুলোয়। ডোনার বা দাতা জীবদ্দশায়ই একটি ফর্মে সই করে অঙ্গ দানের অঙ্গীকার করে যান। যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন, তবে তাঁর পরিবারকে জানিয়ে দ্রুত একজন গ্রহীতা বা ক্যান্ডিডেটকে খবর দেওয়া হয়। সাধারণত গ্রহীতাদের একটা তালিকা আগে থেকেই তৈরি থাকে, যেখান থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী খবর দেওয়া হয়। এর মধ্যে দাতার কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গ সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। আবার কোনো দুর্ঘটনা বা ইনজুরির কারণে কারও আকস্মিক মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারের সম্মতিতেও অঙ্গ সংগ্রহ করা যায়। ৫০ বছর বয়সের নিচে এবং সুস্থ কিডনিধারী ব্যক্তিরাই কিডনি দানের জন্য সবচেয়ে ভালো ডোনার বলে বিবেচনা করা হয়।

তুমি যদি অঙ্গ দান বা অর্গান ডোনেশনের মাধ্যমে অন্যের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাও, তাহলে একটি অঙ্গীকারনামায় নিজের ইচ্ছের কথা লিখে রাখতে পারো। ভালো হয় যদি আত্মীয়স্বজন বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবকেও এ বিষয়ে জানিয়ে রাখো। সারাহ ইসলাম যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেল, তাতে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও হয়তো ডোনার রেজিস্ট্রার তৈরি হবে। মানুষের জন্য মানুষের এর চেয়ে বড় উপহার আর কী হতে পারে?