বই পড়ার সময় বের করা যায় কীভাবে
আজকাল ফোন, ট্যাব আর সোশ্যাল মিডিয়ার ভিড়ে আমরা সবাই ব্যস্ত। ভিডিও, গেম আর মেসেজের ভিড়ে বই পড়া যেন আরও কঠিন হয়ে উঠছে। অনেক সময় মনে হয়, পড়ার জন্য আলাদা করে বসে থাকা মানেই বড় একটি চ্যালেঞ্জ। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো—যাঁরা অনেক বেশি ব্যস্ত, তাঁরাও নানাভাবে সময় বের করে নিচ্ছেন পড়াশোনার জন্য। লেখক, শিক্ষক কিংবা তারকা—যাঁরা নিয়মিত বই পড়েন, তাঁদের সবারই ছোট ছোট কৌশল আছে। সেই কৌশলগুলো কিন্তু আমাদেরও কাজে লাগতে পারে বই পড়া বাড়াতে।
এক গবেষণায় জানা গেছে, আমেরিকায় এখন মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ নিয়মিত বই পড়েন। এক দশক আগেও সংখ্যাটা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। মানে এই সময়ের মধ্যে পড়ার হার কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। গবেষকেরা বলছেন, এর বড় কারণ হলো ফোন আর সোশ্যাল মিডিয়ার দখল। যেখানে অবসর পেলেই মানুষ ভিডিও দেখে বা স্ক্রল করে, সেখানে বই পড়ার মতো মনোযোগী কাজ অনেকেই ভুলতে বসেছেন। এই খবরের পর আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন The Cut এক ভিন্নধর্মী কাজ করল। তারা ১৮ জন ব্যস্ত লেখক, শিক্ষক, সমালোচক আর শিল্পীকে জিজ্ঞেস করল—তাঁরা প্রতিদিনের জীবনযাত্রার মধ্যেও কীভাবে বই পড়ার সময় বের করেন? তাঁদের উত্তরগুলো আমাদের জন্যও হতে পারে শিক্ষণীয়।
অনেকেই বলেন, বই পড়ার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো মোবাইল ফোন। যাঁরা নিয়মিত বই পড়েন, তাঁরা পড়ার সময় ফোনকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। শুধু পড়ার সময় নয়, অন্যান্য সময়েও তাঁরা ফোন কম ব্যবহার করতে চান। কেউ কেউ বাসা থেকে বের হন ফোন ছাড়াই, আবার কেউ কেউ ফোনকে ‘বিষের মতো’ মনে করেন। যত কম ব্যবহার করা যায়, ততই নাকি ভালো। এতে হাতে এসে যায় বাড়তি সময়, যা বই পড়ার জন্য ব্যবহার করা যায়। সমালোচক মলি ইয়ং বলেন, ‘ফোনের দখল থেকে মুক্ত হতে পারলেই দিনের ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায় বাড়তি কিছু ঘণ্টা, আর তখন পড়তে পারি আনন্দ নিয়ে।’
অনেকে আবার নিয়ম-কানুন মেনে পড়েন। নাইজেরিয়ান লেখক ওচুকো আকমোভবো প্রতিদিন ঠিক করে রাখেন কত পৃষ্ঠা পড়বেন। কোনো দিন কম, কোনো দিন বেশি—কিন্তু নিয়মটা তিনি ভাঙেন না। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৫০–১০০ পৃষ্ঠা পড়তে পারলেই কয়েক দিনের মধ্যে একটি বই শেষ হয়ে যায়। অনেকটা যেন খেলায় লক্ষ্য ঠিক করে সামনে এগোনো। এমন নিয়ম মানলে বই পড়া হয়ে ওঠে একটা অভ্যাস, আর একসময় সেটি হয়ে যায় জীবনের অংশ।
কেউ আবার পড়াকে দিনের বিশেষ একটা সময়ের জন্য নির্ধারণ করে রাখেন। অভিনেত্রী নিকোল রিচি যেমন প্রতিদিন ভোরে সবার আগে ওঠেন বই পড়ার জন্য। চারপাশে তখন নিস্তব্ধতা, আর তাঁর হাতে থাকে বই। তিনি বলেন, ‘এই ভোরবেলাই আমার পড়ার সেরা সময়।’ দিনের কাজ শুরু হওয়ার আগে তিনি পড়ার আনন্দে ডুবে যান। আবার অনেকেই রাতে ঘুমের আগে পড়তে ভালোবাসেন। তাঁদের কাছে বই পড়া হলো ঘুমিয়ে পড়ার সবচেয়ে শান্ত উপায়।
অন্য রকম পথ খুঁজে নিয়েছেন আরও অনেকেই। লেখক অ্যান্ড্রু লিপস্টেইন ব্যস্ত জীবনে বন্ধু করেছেন অডিওবুককে। যাতায়াতের সময়, কিংবা সন্তান সামলানোর ফাঁকেও তিনি শোনেন গল্প আর তথ্যবহুল বই। তাঁর মতে, অডিওবুক শোনার মাধ্যমে পড়ার অভ্যাস যেমন টিকে থাকে, তেমনি দৈনন্দিন আবসর সময়গুলোও কাজে লাগে। কেউ আবার বলেন, তাঁরা নেপথ্যে গান বা ভিডিও চালিয়েও পড়তে পারেন। আবার কেউ গাড়ি, ট্রেন বা বাসে ভিড়ের মধ্যেও পড়ার সুযোগ খুঁজে পান।
অনেকে আবার বই পড়ার আনন্দকে ধরে রাখেন লেখার মাধ্যমে। একে বলে বুক জার্নালিং বা পাঠ-ডায়েরি। পড়তে পড়তে যদি কোনো লাইন ভালো লাগে, কিংবা কোনো চরিত্র তোমার মনে দাগ কাটে—তখন সেটি লিখে রাখা যায় ডায়েরিতে বা খাতায়। কেউ আবার পড়া শেষ হলে ছোট্ট রিভিউ লিখে রাখেন, কেউ শুধু তারিখ আর বইয়ের নাম লিখে রাখেন তালিকা করার জন্য। এতে যেমন পড়া আরও মজার হয়ে ওঠে, তেমনি নিজের অগ্রগতি দেখেও ভালো লাগে। বছর শেষে তুমি যদি দেখো, এই বছরে তুমি কত বই শেষ করেছ, কত গল্পের ভেতর দিয়ে হেঁটেছ, সেটাই হয়ে যাবে তোমার নিজের পড়ার ইতিহাস।
এসব উদাহরণ আমাদের একটি কথাই মনে করিয়ে দেয়, সময় বের করতে না পারা আসলে খুব ভালো কোনো অজুহাত নয়, চাইলেই একটু করে সময় বের করে নেওয়া যায় পছন্দের কাজগুলোর জন্য। ফোনকে একটু দূরে রাখা, দিনের নির্দিষ্ট সময়ে পড়ার নিয়ম তৈরি করা, কিংবা ছোট ছোট ফাঁকা সময়কে কাজে লাগানো—সবই বই পড়ার জন্য নতুন দরজা খুলে দেয়। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি হলো, নিজের মতো করে একটা পড়ার যাত্রা তৈরি করা। কারও পড়া হয় পরিকল্পনা মেনে, কারও আবার হয় একেবারেই অগোছালোভাবে—বাসে, ট্রেনে, বা ঘুমের আগমুহূর্তে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, যেভাবেই হোক পড়া যেন থেমে না যায়। যদি মন থেকে চাও, তবে সব সময়ই বইয়ের কাছে ফেরার একটা পথ পাওয়া যায়। আর সেই পথটাই তোমার নিজের গল্প হয়ে থাকবে।