ক্রিপিপাস্তা: ভয়ংকর যে পাস্তা খাওয়া যায় না!

স্বয়ংক্রিয় মেশিনে তৈরি পাস্তা
ছবি: বিজনেস ইনসাইডার

ওপরের ছবিটি দেখে সবার প্রথমে সাধারণ কোনো কারখানায় তৈরি পাস্তার কথাই মনে পড়বে। সন্দেহজনক কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটি স্বয়ংক্রিয় মেশিন থেকে বের হচ্ছে প্রিয় খাবার পাস্তা। কিন্তু খালি চোখে যে সবকিছু দেখা যায় না, তা আমরা ভুলে যাচ্ছি। এর পেছনে আছে এক ভয়ংকর রহস্য। তাহলে পুরো ঘটনায় যাওয়া যাক।

২০১৩ সালের ৪ আগস্ট। ইতালির এক শহরে অবস্থিত একটি পাস্তা ফ্যাক্টরি, নাম ‘পাস্তা ডেলিজিওসো’। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সেখানে কাজের শিফট চলছিল। সাধারণভাবেই কর্মদিবসটি অতিবাহিত হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে শিফট শেষ হওয়ার পর। একজন কর্মী রিপোর্ট করে, ছয় অপারেটরকে লাঞ্চ টাইমের পর থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই এ বিষয়ে সেভাবে নজর না দিয়ে প্রক্রিয়াজাত পাস্তার শিপিং প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত হয়ে যায়। সপ্তাহখানেক চলে যাওয়ার পরও নিখোঁজ সেই ছয়জন অপারেটরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। প্রশাসন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, শুরু করে তদন্ত। যদিও তদন্ত করে কিছু পাওয়া যায়নি। কারণ, নিখোঁজ হওয়ার আগে তাদের কেউ দেখেনি এবং পরেও কেউ দেখেনি। সেদিন লাঞ্চ টাইমে বিদ্যুৎ না থাকায় সিসিটিভি ক্যামেরাও বন্ধ ছিল। এই ছয়জনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা রহস্যই রয়ে যায়। কিন্তু এ ঘটনার সবচেয়ে ভয়ংকর অংশ এখনো বাকি আছে। তা হলো পাস্তা ডেলিজিওসোর কিছু ক্রেতা এ ঘটনার সমসাময়িক সময়ে অভিযোগ করে যে তারা তাদের পাস্তার ভেতর মানুষের চুল এবং কাপড়ের টুকরা পেয়েছে এবং সেই পাস্তাগুলোর স্বাদও ছিল অদ্ভুত।

এতক্ষণ যে ঘটনাটি বলা হলো, তা মূলত একধরনের বিশেষ শ্রেণির গল্প, যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়ায়। গল্পটি প্রথম এক জনপ্রিয় ইন্টারনেট ফোরামে পোস্ট করা হয়েছিল। সেখান থেকে সেটি ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ইন্টারনেট থেকে ছড়িয়ে পড়া গল্পটি এখন মানুষের মুখে মুখে। আমি গল্পটি ২০১৭ সালে এক জনপ্রিয় পডকাস্টে প্রথমবারের মতো শুনি। এভাবে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়ানো উদ্ভট ভয়ংকর গল্পগুলোকে ‘ক্রিপিপাস্তা’ বলা হয়।

ক্রিপিপাস্তা মূলত এমন সব উদ্ভট ভয়ংকর গল্প, যেগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে ছড়াতে একসময় সবার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। এই শব্দের উৎপত্তি মূলত ইন্টারনেট স্ল্যাং ‘কপিপাস্তা’ থেকে। কপিপাস্তা বলতে বোঝানো হয় সেসব লেখাকে, যেগুলো কপি হতে থাকে বারবার এবং ছড়াতে থাকে ইন্টারনেটের প্রতিটি কোনায়।

শুরুটা যেভাবে

ক্রিপিপাস্তার শুরুর ইতিহাস খুব একটা স্পষ্ট নয়। নব্বইয়ের দশকে চেইন ই-মেইল এবং বিভিন্ন ইন্টারনেট ফোরামে কয়েকজন স্বাধীন লেখকের হাতে যাত্রা শুরু হয় ক্রিপিপাস্তার। শুরুর দিকে আলোড়ন তোলা ক্রিপিপাস্তাগুলো মূলত একটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইটের বিশেষ একটি বোর্ডে পোস্ট করা হয়েছিল।

শুধু ক্রিপিপাস্তা নিয়ে প্রথম ওয়েবসাইট চালু হয় ২০১০ সালে। এরপর ক্রিপিপাস্তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে আরও।

রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট

উল্লেখযোগ্য ক্রিপিপাস্তা

ক্রিপিপাস্তা বর্তমানে কয়েকটি শ্রেণি বা ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। এগুলোর মাঝে হরর গল্প, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা কন্সপিরেসি থিওরি এবং অস্বাভাবিক কার্যকলাপ বা প্যারানরমাল রিচুয়াল অন্যতম। হরর গল্প হিসেবে ‘জেফ দ্য কিলার’ বেশ জনপ্রিয়। এর গল্প মূলত বুলিংয়ের স্বীকার এক কিশোরকে ঘিরে। বুলিংয়ের কারণে একসময় জেফ এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে যে সে একজন সাধারণ কিশোর থেকে সাইকো কিলারে পরিণত হয়। জেফ এর সিগনেচার ডায়ালগ হলো ‘গো টু স্লিপ’। জেফ অনলাইন হরর সংস্কৃতির সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রগুলোর একটি। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি হরর গল্প হলো—‘সাইরেন হেড’, ‘দ্য রেক’, ‘স্লেন্ডার ম্যান’, ‘টর্চার স্যুপ’ ও ‘পেনপ্যাল’। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট নামের ক্রিপিপাস্তা সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল। অন্যদিকে অস্বাভাবিক কার্যকলাপ হিসেবে ‘ওয়ান ম্যান হাইড অ্যান্ড সিক’, ‘সেভেন গেটস অফ হেল’, ‘দ্য ক্রিয়েচার ইন ইয়োর মাইন্ড’ এবং ‘টমিনোজ হেল’ বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।

চলচ্চিত্রে ক্রিপিপাস্তা

চলচ্চিত্রজগতে ক্রিপিপাস্তা গল্প নির্মাণের চলন বেশ পুরোনো। এগুলো মধ্যে ‘স্লেন্ডার ম্যান’ (২০১৮) বক্স অফিসে বেশ সাড়া ফেলেছিল। এই চলচ্চিত্রে দেখা যায়, ম্যাসাচুসেটসের একটি শহরে কয়েক বন্ধুর একটি দল ইন্টারনেটে ‘স্লেন্ডার ম্যান’ নামের একটি ক্রিপিপাস্তার সংস্পর্শে আসে। তারা ‘স্লেন্ডার ম্যান’ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করে। ক্রিপিপাস্তাটিতে দাবি করা হয়েছিল যে ‘স্লেন্ডার ম্যান’-এ বর্ণিত ঘটনাগুলো বাস্তবে ঘটেছে। তারা ঠিক করে ‘স্লেন্ডার ম্যান’-এর রহস্য ভেদ করে প্রমাণ করবে—‘স্লেন্ডার ম্যান’ একটি কাল্পনিক চরিত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু এই অভিযানে নামার পর তাদের এক বন্ধু হারিয়ে যায় এবং তাদের সঙ্গে ঘটতে থাকে একের পর এক রহস্যজনক ঘটনা। ক্রিপিপাস্তার গল্পে নির্মিত উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র হলো ‘জেফ দ্য কিলার’ (২০১৯), ‘মোমো’ (২০১৮), ‘রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট’ (২০১৯) ও ‘সাইরেন হেড’ (২০২০)।

জেফ দ্যা কিলার

জনপ্রিয়তা

‘টাইম’ ম্যাগাজিন অনুযায়ী ক্রিপিপাস্তা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে ২০১০ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ক্রিপিপাস্তা সম্পর্কে আর্টিকেল ছাপানোর পর। বর্তমানে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে ক্রিপিপাস্তার জনপ্রিয়তা বাড়লেও একই সঙ্গে কমেছে নতুনত্ব ও সত্যতা।

বর্তমানে ক্রিপিপাস্তা

ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে এখন আর ক্রিপিপাস্তা শুধু ইন্টারনেট ফোরামে সীমাবদ্ধ নেই। ক্রিপিপাস্তার জন্য সুনির্দিষ্ট ওয়েবসাইট ও ফোরামগুলোতে পাঠকের সংখ্যা কিছুটা কমলেও ক্রিপিপাস্তার জনপ্রিয়তা আগের তুলনায় কমেনি, বরং বেড়েছে। বর্তমানে ক্রিপিপাস্তা অডিও লাইব্রেরি, পডকাস্ট, চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজ, ডকুমেন্টারি ও অ্যানিমেটেড ভিডিওর মাধ্যমে উপভোগ করা যায়।

এ ছাড়া বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিকল্পনাপ্রবণ কিছু মানুষ ক্রিপিপাস্তার চর্চা ধরে রেখেছেন। যেমন প্রায় পাঁচ বছর আগে একটা ঘটনার কথা বলা যায়। ঘটনাটি আমার আগের স্কুলের। সেদিন টিফিন পিরিয়ডের সময় ক্লাসে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিলাম। এমন সময় আমাদের এক বন্ধু এসে বলল, স্কুলের পাঁচতলায় নাকি কিছু একটা হয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, পাঁচতলা, অর্থাৎ আমাদের স্কুলের ল্যাবের ভেতর থেকে নাকি রাতে কান্নার শব্দ আসে এবং ১০ বছর আগে ওখানে একজন ছাত্র ‘কেমিক্যাল’ পান করে আত্মহত্যা করেছিল। অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর জানতে পারলাম এ ঘটনা দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে এবং তা অনেকেই শেয়ার করে। সেখান থেকেই এটি স্কুলের সবার কানে পৌঁছায়। এটি যে সম্পূর্ণ কাল্পনিক, তা পরবর্তীকালে প্রথম পোস্ট করা ব্যক্তিও স্বীকার করে নেয়।

স্লেন্ডার ম্যান (২০১৮)

সত্যতা

বেশির ভাগ ক্রিপিপাস্তা মানুষের নিছক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ‘রাশিয়ান স্লিপ এক্সপেরিমেন্ট’। ফ্যাক্ট চেকাররা আলোড়ন তোলা এই কন্সপিরেসি থিওরিটি অনেকবারই ভুয়া প্রমাণ করেছে।

শুরুর দিকের কিছু ক্রিপিপাস্তা সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা হলেও ব্যবহারকারীর সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, ততই কমতে থাকে ক্রিপিপাস্তার সত্যতা।

আমরা বর্তমানে এমন এক বিশ্বে বসবাস করি, যেখানে সবাই বাস্তবতা থেকে পালিয়ে নিজেদের কল্পনার জগতে আশ্রয় নিতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে যারা আমার মতো হরর বই পড়ে, হরর সিনেমা দেখে বা হরর পডকাস্ট শোনে নিজের রাতের ঘুম হারাম করতে পছন্দ করে, তাদের কাছে বাস্তবতা থেকে কিছুক্ষণ পালিয়ে থাকার বেশ দারুণ একটি পন্থা হতে পারে ক্রিপিপাস্তা। ক্রিপিপাস্তার একেকটি গল্প সবচেয়ে সাহসী ব্যক্তিটিরও মেরুদণ্ডে হিম স্রোত বইয়ে দেয়।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ক্রিপিপাস্তা ডটকম, ডেইলি ডট