রাস্তার ধারে ডাস্টবিন ছাড়াই জাপান কীভাবে এত পরিষ্কার

পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন দেশগুলোর মধ্যে একটি জাপানগেটি ইমেজেস

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টা নিয়ে বিশ কিছু ভিডিও দেখা যায়। যেখানে অনেক ব্লগার জাপানের রাস্তায় হাঁটছেন আর বলছেন তাঁদের হাতে থাকা খাবারের খোসা বা প্যাকেট তাঁরা প্রায় ৩০ মিনিট ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন। কেন? কারণ, তাঁরা নাকি জাপানের রাস্তায় একটিও ডাস্টবিন খুঁজে পাচ্ছেন না। আধুনিক ও পরিচ্ছন্নতার জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত জাপানের মতো একটি দেশে রাস্তায় ডাস্টবিন না থাকাটা কি সত্যিই সম্ভব? নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো বিশেষ কারণ? আর যদি হয়ও তাহলে সেখানকার মানুষ ময়লা ফেলে কোথায়? আর ডাস্টবিন ছাড়া জাপান কীভাবে এত পরিষ্কার থাকে?

পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন দেশগুলোর মধ্যে একটি জাপান। সেখানকার রাস্তাঘাট সব সময় ঝকঝকে–তকতকে থাকে। জাপানের রাস্তায়ও ডাস্টবিন রয়েছে। তবে আমাদের দেশের মতো না। সেখানে ডাস্টবিন থাকার পরও মানুষ রাস্তায় ময়লা ফেলেন। জাপানে নির্দিষ্ট স্থান পর পর আধুনিক ডাস্টবিন রয়েছে।

তবে জাপানের রাস্তায় তেমন একটা ডাস্টবিনের দেখা না পাওয়ার প্রধান কারণ জাপানিদের সংস্কৃতি। তারা মনে করে, ময়লাটা যখন আপনি তৈরি করেছেন, তখন সেটা পরিষ্কার করার দায়িত্বও আপনারই। জাপানে সবাই নিজের তৈরি করা আবর্জনা নিজেই বহন করে। রাস্তায় ফেলে দেয় না। এই নিয়মটিকে তারা ব্যক্তিগত দায়িত্ব বা জবাবদিহির অংশ মনে করে। এই অভ্যাসের কারণেই জাপানের রাস্তাঘাট সব সময় পরিষ্কার থাকে। কারণ, সেখানে রাস্তায় ময়লা ফেলাকে খুবই খারাপ চোখে দেখা হয়।

আরও পড়ুন

জাপানিরা বিশ্বাস করে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কেবল ব্যক্তিগত অভ্যাস না। এটি সমাজের সবার জন্য একটি সমান ও গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। তাই তারা যখন তাদের চারপাশের পরিবেশের সৌন্দর্য ও শৃঙ্খলা বজায় রাখে তখন তারা অত্যন্ত গর্ববোধ করে। তাদের কাছে পরিচ্ছন্নতা হলো সম্মিলিত দায়িত্ব ও জাতীয় পরিচয়ের অংশ।

জাপানের রাস্তায় ডাস্টবিন না থাকার আরেকটি বড় কারণ তাদের বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা রয়েছে। তারা ময়লাকে শুধু ময়লা হিসেবে ফেলে না। তারা সেটিকে অনেকগুলো ভাগে ভাগ করে। যেমন, শুধু কাগজের জন্যই রয়েছে আলাদা আলাদা ভাগ। টয়লেট পেপার, খাবারের প্যাকেটের কাগজ, লেখার কাগজ এগুলো সবই আলাদা করে ফেলতে হয়। কারণ, জাপানে এই শ্রেণিবিভাগ মেনেই ময়লা সংগ্রহ করা হয়। এভাবে প্রতিটি ময়লাকে আলাদা করে ফেলা হয়।

জাপানের ময়লা তোলার গাড়িগুলোও খুব নিয়ম মেনে চলে। তারা কিন্তু একসঙ্গে সব ময়লা নেয় না। ধরো আজ তারা শুধু কাগজের ময়লা নেবে। কাল আসবে প্লাস্টিকের ময়লা নিতে। আর তার পরের দিন হয়তো কাচের ময়লা নেবে। মানে, নির্দিষ্ট দিনে শুধু একটি নির্দিষ্ট ধরনের আবর্জনাই তারা সংগ্রহ করে খুবই সাবধানে।

আরও পড়ুন
জাপানের রাস্তায় সোলার চালিত আধুনিক ডাস্টবিন
গেটি ইমেজেস

এখন ভাবো, যদি রাস্তায় অনেক ডাস্টবিন থাকে, তাহলে কী হবে? যারা বাড়িতে নিয়ম মেনে ময়লা ভাগ করে না, তারা সব ধরনের ময়লা কাগজ, প্লাস্টিক, কাচ সেই ডাস্টবিনে একসঙ্গে ফেলে দেবে। এর ফলে, সরকারের ময়লা পরিষ্কার করার খরচ অনেক বেড়ে যাবে। তাই জাপান সরকার মানুষকে বাড়িতেই নিজেদের ময়লা ভাগ করে রাখতে উৎসাহিত করে। এ কারণেই তাদের এত কঠিন বর্জ্য ফেলার নিয়মটিও ঠিকমতো কাজ করে এবং পুরো ব্যবস্থাটি কম খরচে চলে।

জাপানে গেলে তুমি একটা জিনিস খেয়াল করবে, রাস্তার ধারে ময়লার স্তূপের চারপাশে কাকেরা সব সময় ঘোরাঘুরি করে। মানুষ যখনই ময়লা ফেলে, তখনই এরা সেখানে উড়ে আসে এবং খাবার খোঁজে। প্রায়ই এই কাকেরা ময়লার স্তূপটিকে এলোমেলো করে ফেলে। যদিও এটা একটা বড় সমস্যা। তবু খুব কম লোকই এদের তাড়ানোর চেষ্টা করে। আসলে, কাক এবং বন্য বিড়ালের মতো প্রাণীরা যাতে খাবারের সন্ধানে ময়লা ছড়িয়ে না ফেলে এবং দুর্গন্ধ সৃষ্টি না করে, সে জন্যও জাপানের রাস্তায় ডাস্টবিনের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

জাপানের রাস্তায় ডাস্টবিন না থাকার একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ১৯৯৫ সালে টোকিওর সাবওয়েতে সারিন গ্যাস হামলা। ‘আউম শিনরিকিও’ নামের একটি দল এই মারাত্মক আক্রমণটি চালিয়েছিল। তারা পাবলিক এলাকার ডাস্টবিনের ভেতরেও সারিন গ্যাস লুকিয়ে রেখেছিল। এই ভয়াবহ ঘটনার পর জাপান সরকার সতর্কতা হিসেবে তাড়াতাড়ি বেশির ভাগ ডাস্টবিন সরিয়ে ফেলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে যাতে কেউ ডাস্টবিনে বোমা বা অন্য কোনো বিপজ্জনক জিনিস লুকিয়ে হামলা করতে না পারে।

আজও এ ঘটনার প্রভাব জাপানে রয়েছে। সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার ভয় জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি বড় চিন্তা, আর সেই কারণেই রাস্তায় ডাস্টবিনের সংখ্যা সীমিত রাখা হয়েছে। জাপানের এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিটি পরিবেশকে বাঁচানোর প্রতি তাদের গভীর আগ্রহকেও দেখায়। রাস্তায় ডাস্টবিন কম থাকার কারণে মানুষ কম পরিমাণে ময়লা তৈরি করতে উৎসাহিত হয়। যখন কেউ জানে যে তাকে নিজের ময়লা ব্যাগ বা পকেটে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে, তখন সে এমনিতেই কম বর্জ্য তৈরি করে। এ জন্য বিদেশি পর্যটক গেলে তাঁদের জাপানের রাস্তায় ডাস্টবিন খুঁজে পেতে এত কষ্ট হয়।

সূত্র: সিএনএন, জাপান ইন্টার্নশিপ

আরও পড়ুন