স্বাধীনতার জন্য যাঁরা হেঁটেছিলেন ১৪০০ মাইল

শান্তিনিকেতনের পথে বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার দল (কামরুল আমান-সামনে বাঁ থেকে তৃতীয়)ছবি: ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত

১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিদের হত্যা করছে পাকিস্তানি সেনারা। বাংলাদেশের মানুষ তখন দলে দলে আশ্রয় নেয় সীমান্তের ওপারে, ভারতে। খোলা হয় শরণার্থী শিবির। প্রায় এক কোটি বাঙালিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব এসে পড়ে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের ওপর। ভারতের কিছু রাজ্যের মানুষ এতে নাখোশ হয়। শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে আর মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য না করতে নানাভাবে সরকারকে চাপ দিতে থাকে তারা।

ঠিক ওই সময়ে পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ আয়োজনের। এতে অংশ নেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বাংলাদেশের ৩৮ জন শিক্ষিত যুবক। ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন দূতাবাসে স্মারকলিপি দেওয়া, পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যা ও হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা তুলে ধরে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলাই ছিল এই পদযাত্রার উদ্দেশ্য।

পদযাত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে জনসভা করতেন। গণহত্যা সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলে আহ্বান জানাতেন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর। তাঁদের সবার হাতে শোভা পেত— ‘আমাদের এক কথা—বাংলাদেশের স্বাধীনতা’, ‘মুজিবের মুক্তি চাই’ সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও জাতীয় পতাকা। ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে পদযাত্রাটি চলে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হতে থাকে পদযাত্রার খবর।

বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে পদযাত্রাটি এগিয়ে নেওয়ার সার্বিক পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল ‘অখিল ভারত শান্তি সেনা মণ্ডল’ নামের একটি সংগঠন। এটি গঠিত হয় মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী আটটি সংগঠনের সম্মিলনে। এদের সহযোগিতা করে ‘গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন’। পদযাত্রার মূল উদ্যোক্তা ভারতের অহিংস সর্বদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ। আহ্বায়ক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দীনেশ চন্দ্র মুখার্জি।

পদযাত্রী ৩৪ জনকে বাছাই করার কাজ করেন যশোরের শাহ হাদিউজ্জামান, মরহুম এম রওশন আলী, বিমল রায় চৌধুরী ও শেখ মোখলেসুর রহমান খোকন। ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর বনগ্রাম থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে পৌঁছে দলটি। সেখানে ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তরের মাটি ছুঁয়ে স্বাধীনতার জন্য শপথ নেন দলের সদস্যরা। বাকি চারজন পরে এসে যোগ দেন মুর্শিদাবাদে।

পদযাত্রা দলের লিডার ছিলেন আবদুল খালেক। ডেপুটি লিডার-১ খুলনার একরামুল ইসলাম। কামরুল আমান ছিলেন ডেপুটি লিডার-২। বাকিরা হলেন রফিকুল ইসলাম, খলিলুর রহমান, মুরারী মোহন সরকার, বিনয় কুমার বিশ্বাস, আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ আবু বকর, পরিতোষ কুমার মণ্ডল, আবদুল লতিফ–১, আবদুল লতিফ–২, সৈয়দ রবিউল হক, দুলাল মণ্ডল, ওহিদুজ্জামান চাকলাদার, তুষার কান্তি সুর, শেখ আনোয়ার কামাল, সুভাষ চন্দ্র বসু, অমিত দেব, ক্ষীতিশ চন্দ্র মণ্ডল, আনন্দ মোহন রায়, প্রদীপ কুমার শীল, আবদুস সামাদ, আনোয়ারুল কাদির, পরিতোষ কান্তি কবিরাজ, দেলোয়ার হোসেন, অনিল কুমার বিশ্বাস, মইন উদ্দিন, সহিদুল ইসলাম, বিশ্বনাথ সাহা, সমীর কুমার বসু, ওমেদ আলী, আবু বকর সিদ্দিকী, শামসুল হক, মতিলাল দাস, অহিভূষণ চক্রবর্তী, সনৎ কুমার বিশ্বাস, আশরাফ হোসেন ও দিলীপ কুমার নাগ।

পদযাত্রী দলের ডেপুটি লিডার-২ কামরুল আমানের মুখোমুখি হলে তিনি জানান বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রার আদ্যোপান্ত।

পদযাত্রা শুরুর আগের দিন, অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের কাশীশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ে র৵ালিসহ একটি জনসভায় দলটিকে অভিনন্দন জানানো হয়। রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন গান্ধীপন্থী লেখক মৌলভি রেজাইল। বক্তব্য দেন মোহাম্মদ একরামুল, শ্রী দেশাই ও আবদুল খালেক। পরদিনই বাংলাদেশের পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানারসহ দলটি বহরমপুর থেকে গোকর্ণের দিকে আনুষ্ঠানিক যাত্রা করে।

বিশ্ব ভারতী মিলনায়তনে বক্তব্যরত কামরুল আমান
ছবি: ব্যক্তিগত অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত

পদযাত্রার আগাম কর্মসূচি ইংরেজি ও হিন্দিতে গণমাধ্যমগুলোতে জানিয়ে দিতেন উদ্যোক্তারা। প্রায় দেড় মাস দলটিকে প্রতিদিন গড়ে ১৫-১৬ মাইল হেঁটে গন্তব্যে যেতে হতো। বিকেলের দিকে স্থানীয়ভাবে আয়োজন করা হতো জনসভার। উঠোন বৈঠকও হয় অগণিত। দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে চলত মতবিনিময়। এভাবে দলটি মুর্শিদাবাদ, সেইনথিয়া, সুরি, শান্তিনিকেতন, ককশা, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, আসানসোল, নিয়ামতপুর, কুলটি, চিত্তরঞ্জন ও বিহার, পাটনা, লক্ষ্ণৌ ও আগ্রাসহ প্রভৃতি জায়গায় পদযাত্রা করে।

স্থানীয় জনগণই দলটির খাওয়ার ব্যবস্থা করত। পাটনাতে পল্টনের মতো বিশাল একটি মাঠে মিটিং হয়। বক্তৃতায় দেশের গণহত্যার কথা জানান পদযাত্রীরা। লিডার খালেক রাজশাহীর আর কামরুল আমান তুলে ধরেন ঢাকার গণহত্যার বর্বরতার কথা। বর্ণনাগুলো যখন হিন্দিতে অনুবাদ করে বলা হচ্ছিল, তখন হুহু করে কাঁদছিলেন সেখানকার মানুষ। লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের বক্তব্য শুনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কণ্ঠ মিলিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। মুজিবের মুক্তিতে পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারও করে তারা।

৩০ জানুয়ারি ছিল গান্ধীর প্রয়াণ দিবস। ওই দিন দিল্লির রাজঘাট গান্ধী সমাধিতে পদযাত্রাটি শেষ হবে—এমনটিই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু তার আগেই স্বাধীনতা লাভ করায় ১৭ ডিসেম্বর ভারতের উত্তর প্রদেশে এসে পদযাত্রাটি শেষ হয়।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দেশ তখন স্বাধীন। ১৮ ডিসেম্বর লক্ষ্ণৌতে বিশাল আয়োজনে উদ্‌যাপিত হয় বিজয় দিবস। ভারতীয় বিমান, সেনা ও নৌবাহিনী, ক্যাডেট, স্কাউট, গার্লস গাইড ও জনসাধারণের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় পতাকাসহ অংশ নেয় পদযাত্রার এ দলটি। ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দেশে ফিরে আসে ‘বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রা’ দলটির যুবকেরা।

স্বাধীনতার জন্য পদযাত্রা দলটি ভারতে হেঁটেছিল ১ হাজার ৪০০ মাইল। মুক্তিযুদ্ধটা কেন ন্যায় যুদ্ধ—সেটি ভারতীয়সহ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরাই ছিল তাঁদের কাজ। তাঁদের কাছে ওটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধ।

কিন্তু দুঃখের বিষয় স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরও কণ্ঠযোদ্ধা বা ফুটবল যোদ্ধাদের মতো ৩৮ পদযাত্রীর কাউকেই মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। বুকে জমিয়ে রাখা এমন কষ্ট নিয়েই চলে গেছেন অনেকেই। যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরাও থাকছেন নিভৃতে। ফলে একাত্তরে গৌরবের এ ইতিহাস আজ প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে।