বন্দী হাতিকে বনে ফিরিয়ে দেবে বাংলাদেশ

গাছ টানার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে হাতিপ্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশে যে হাতিগুলো বহু বছর ধরে বন্দিদশায় আছে, সেগুলোকে বনে ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। মংগাবে এশিয়ার প্রতিবেদনে সাংবাদিক আবু সিদ্দিক লিখেছেন, 'বাংলাদেশ সরকার বন্দী হাতিদের বর্তমান মালিকদের কাছ থেকে ফিরিয়ে এনে এগুলোকে বনাঞ্চলে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে।'

দেশে বন্য ও বন্দী হাতির সংখ্যা

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে গড়ে ২৬৮টি বন্য হাতি আছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এই প্রজাতিটিকে বাংলাদেশে ‘অতিমাত্রায় বিপন্ন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

এই হাতিগুলো মূলত দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন—চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম হিল ট্র্যাক্টস ও কক্সবাজার জেলায় বসবাস করে।

আরও বলা হয়েছে, এর বাইরে দেশে ৯৬টি হাতি বন্দিদশায় আছে। এর মধ্যে ১৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের (যেমন চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কের), আর বাকি ৮২টি ব্যক্তিগত মালিকদের কাছে।

আরও পড়ুন

বন্দিদশার কারণ ও বর্তমান ব্যবহার

বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে শেরপুরে এই হাতির মৃত্যু হয়
সংগৃহীত

আগে হাতি ব্যবহৃত হতো কাঠ টানার কাজ, মাল পরিবহন ও সার্কাসে। কিন্তু মংগাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের কারণে এসব কাজে হাতির প্রয়োজন কমে গেছে। এখন অনেক মালিক হাতিদের দিয়ে অবৈধভাবে চাঁদা তোলার কাজ করাচ্ছেন।

এমন কাজে ব্যবহারের সময় একবার অতিরিক্ত গরমে একটি হাতির মৃত্যু হয়। ২০২৪ সালে হাইকোর্ট বন্য প্রাণীর ওপর নিষ্ঠুরতা বন্ধে নির্দেশনা দেন।

সরকারের উদ্যোগ

মংগাবে এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সায়েদা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, 'হাতির প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধে আমরা পরিকল্পনা নিয়েছি। এদের মালিকদের কাছ থেকে ফিরিয়ে এনে প্রথমে আলাদা একটি বনে রাখা হবে। পরে দেখা হবে তারা বনে মানিয়ে নিতে পারে কি না। ফলাফল যা–ই হোক, হাতিদের আর বন্দী রাখা হবে না।'

আরও পড়ুন

হাতি পুনর্বাসন প্রকল্প

চাঁদা তোলার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে হাতি
স্টিফানো/ফ্লিকার

তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের বাজেট ৪০০ কোটি টাকা। প্রথম ধাপে দেশে বসবাসকারী, আগত ও বন্দী হাতিদের অবস্থা নিয়ে নতুন করে সমীক্ষা চালানো হবে। প্রকল্প পরিচালক এ এস এম জাহির উদ্দিন আকন বলেছেন, 'বাংলাদেশে শেষ হাতি সমীক্ষা হয়েছিল ২০১৬ সালে। এখন সংখ্যা বদলেছে কি না, জানতে আমরা আবার জরিপ করব।'

এ এস এম জাহির উদ্দিন আকন আরও জানান, 'প্রাথমিকভাবে মৌলভীবাজারের রেমা-কালেঙ্গা আর চট্টগ্রামের চুনতি বন—এই দুই জায়গার মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়া হবে হাতিদের নতুন আবাস হিসেবে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ নতুন। তাই আমরা দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিচ্ছি। শ্রীলঙ্কার হাতি পুনর্বাসনকেন্দ্রের মতো উদাহরণও আমরা বিবেচনা করছি।'

তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ মন্তব্য করেছেন, 'বন্দী হাতিরা তাদের প্রাকৃতিক স্বভাব অনেকটাই হারিয়েছে। মানুষের সংস্পর্শে থাকায় তারা নানা রোগও বহন করতে পারে। তাই উদ্যোগটি বাস্তবায়ন কঠিন হবে।'

আরও পড়ুন

হাতি ধরার পুরোনো ইতিহাস

আবু সিদ্দিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে হাতি ধরার ইতিহাস ১৮শ শতকের ব্রিটিশ আমল থেকে। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও জমিদাররা হাতি ব্যবহার করত সেনা ও কাঠ পরিবহনের কাজে।

ঢাকাতেও এ ইতিহাসের চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। হাতিরপুল, মাহুতটুলি, হাতিরঝিল—সব নাম এসেছে সেই সময়ের হাতির চলাচল আর থাকার জায়গা থেকে।

হাতি সংরক্ষণে উদ্যোগ

হাতি ফিরবে বনে
প্রতীকী ছবি

২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৪৪টি বনরেঞ্জে হাতির উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা ১ হাজার ৫১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে অনেক বন্য হাতি হারাচ্ছে নিজেদের আবাসভূমি।

এ ছাড়া ভারত ও মিয়ানমার থেকে আগত হাতিদের কারণে সীমান্ত অঞ্চলে মানুষ-হাতি সংঘাত বেড়েছে।

২০১৮ সালে সরকার নিয়েছিল ১০ বছর মেয়াদি 'এলিফ্যান্ট কসারভেশন অ্যাকশন প্ল্যান'। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে যেন হাতি সংরক্ষণের নানা পদক্ষেপ নির্ধারণ করা যায়। এর মধ্যে এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) গঠনের উদ্যোগও রয়েছে, যারা স্থানীয় মানুষকে সচেতন করে এবং হাতি ও মানুষের সংঘাত কমাতে কাজ করে।

মানুষ-হাতি সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জন্য ২০১০ সাল থেকে সরকার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও চালু করেছে।

সূত্র: মংগাবে এশিয়ায় প্রকাশিত আবু সিদ্দিকের প্রতিবেদন অবলম্বনে

আরও পড়ুন