পাইলটের জীবন বাঁচাতে ইজেকশন পদ্ধতি
তুমি যখন বাসে করে কোথাও যাও, সেই বাসের গতি কত থাকে? সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার। বাসে চলতে থেকে কখনো হাত জানালা দিয়ে বের করে দেখেছ? বের করো আর না করো, সাবধান। পাশ দিয়ে গাড়ি যায়। জানালার বাইরে হাত বের করা খুব একটা নিরাপদ নয়। হাত বের করলে দেখবে বাতাসের চাপ তোমার হাত পেছনে নিয়ে যাচ্ছে। এবার চিন্তা করো ফাইটার জেটের কথা। একটা ফাইটার জেট যখন ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার বেগে চলছে, তখন যদি একজন পাইলট সেকেন্ডের মধ্যে, চোখের পলকে বেরিয়ে যান ফাইটার জেট থেকে, কতটা চাপ লাগবে?
সিটসহ এভাবে বেরিয়ে আসাকে বলে ইজেকশন। যখন আর কোনো উপায় থাকে না বিমান আর নিজের জীবন রক্ষা করার, শুধু তখনই একজন পাইলট সিদ্ধান্ত নেন, তিনি বিমানটিকে পরিত্যক্ত করে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য বেরিয়ে যাবেন। বিমানটি ক্র্যাশ করবে বা ধ্বংস হয়ে যাবে। পাইলট আহত হলেও অন্তত জীবন রক্ষা করতে পারবেন।
এ ব্যবস্থা বেশ দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। এখন পর্যন্ত প্রায় সাত হাজার পাইলটের জীবন বাঁচিয়েছে ইজেকশন আসন। ফাইটার বিমান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ইজেকশন আসন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল ১৯১০ সালে। এরপর ১৯২০ সালের শুরুর দিকে প্রথম ইজেকশন পদ্ধতি বিমানে ব্যবহার হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেখা যায়, আকাশপথে ব্যাপক যুদ্ধ হচ্ছে। বিমান নিয়ে উড়ে গিয়ে পাইলটরা বিমান হামলা করে আসছেন। আকাশপথে বিমানে বিমানে যুদ্ধ হচ্ছে। বোমার আঘাত বা মেশিনগানের গুলি, নানা কারণেই বিমান ধ্বংসের মুখে পড়ছিল। বিমানের সঙ্গে মারা যাওয়ার হার বাড়ছিল। তখন পাইলটের জীবন রক্ষার জন্য প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু জার্মান কোম্পানি।
প্রথমে বিমান থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্যবহার হতো বারুদ এবং কার্তুজ। যেগুলো শটগান দিয়ে গুলি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। যেটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ভেবে দেখো, তোমার চেয়ারের নিচে বাঁধা আছে কিছু গোলাবারুদ। এরপর নতুন প্রযুক্তি এল। আকাশে রকেট পাঠানোর জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয়। জ্বালানি পুড়িয়ে প্রচুর গ্যাস বের করা হয়। এর থ্রাস্ট বা ধাক্কায় সিট ওপরের দিকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। রকেটের এই পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৫৮ সালে। দিন দিন এই প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে।
শখ করে কখনো পাইলট এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না। এটি বিমান দুর্ঘটনায় একজন পাইলটের একদম শেষ কার্যকরী পদক্ষেপ। ইজেকশন ব্যবহার হলে ধরে নিতে হবে বিমান ধ্বংস হয়ে গেছে। পাইলটের হাতে আর বিকল্প নেই। পাইলটরা সাধারণত নিজেদের বিমান এবং জীবন বাঁচাতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করেন।
বিমান থেকে ইজেকশন আসনের মাধ্যমে বের হয়ে এলে সেটা কিন্তু বেশ খরুচে ব্যাপার। বিমানের দাম তো আছেই। আবার ইজেকশন সিটের দামও কম নয়। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল এয়ার ফোর্সের এফ-৩৫ লাইটনিং জেটের প্রতিটির দাম প্রায় ১১৮ মিলিয়ন ডলার। বিমান রক্ষা করা সম্ভব না হলেই শুধু ইজেকশন করা হয়। তা–ও নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে। যেমন শত্রুর আক্রমণে বিমানে আগুন ধরে গেছে। প্রশিক্ষণের সময় প্রযুক্তিগত এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, যেটা থেকে ফেরার পথ জানা নেই। মারা যেতে পারেন। একেক পরিস্থিতিতে একেক রকম ইজেকশন প্রযুক্তির দরকার হয়। যুদ্ধের মধ্যে একরকম। প্রশিক্ষণের সময় অন্য রকম। আবার একেক উচ্চতা ও গতির জন্য একেক রকম। কীভাবে ইজেকশন করা হবে, সেটি ঠিক করে বিমানের সফটওয়্যার। আসনের সেন্সর নির্ধারণ করে, বিমানটি কী অবস্থায় কত উচ্চতায় আছে।
পাইলটের বেঁচে থাকার টুলে কী থাকে, সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় টিকে থাকার টুল, পানিতে ভাসার ভেলা, ফ্লেয়ার, খাবার পানি ইত্যাদি থাকে। আবার যুদ্ধের মধ্যে থাকতে পারে ছদ্মবেশ ধারণের উপকরণও।
মে মাসের ৯ তারিখ বৃহস্পতিবার সকালে আমাদের দেশের দুজন পাইলট প্রশিক্ষণ বিমানে ইজেকশন পদ্ধতি ব্যবহার করেন। এ সময় চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীতে একটি বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় আহত দুই পাইলটের একজন নিহত হন। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, প্রশিক্ষণ বিমানে আগুন লাগার পর দুজন পাইলট ইজেকশন পদ্ধতিতে প্যারাস্যুট দিয়ে নেমে আসেন। এ সময় কর্ণফুলী নদী থেকে তাঁদের উদ্ধার করে বিএনএস পতেঙ্গা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর ১২টার দিকে স্কোয়াড্রন লিডার আসিম জাওয়াদের মৃত্যু হয়। তবে আহত উইং কমান্ডার সুহান জহুরুল হক ঘাঁটির মেডিকেল স্কোয়াড্রনে চিকিৎসাধীন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিমানবাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে। এ সময় বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে পাইলট ও কো-পাইলট প্যারাসুট দিয়ে নেমে আসেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ‘ওয়াইএকে ১৩০’ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এই দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে।
ধরো, একটি বিমানের গতি ঘণ্টায় ২৮৮ মাইলের কম। এটি ৪ হাজার ৫৭৫ মিটারের কম উচ্চতায় উড়ছে। তখন এই কম গতি ও নিম্ন উচ্চতার জন্য ইজেকশন পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। এই পদ্ধতি তুলনামূলক সহজ। এই সময় পাইলটের মাথার ওপরের ছাদ খুলে যাবে এবং ইজেকশন সিট সরে এসে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসবে। এর জন্য সিটের ভেতরে রাখা ছোট ড্রগ প্যারাস্যুট খোলার প্রয়োজন নেই। ছোট এই প্যারাস্যুট বেরিয়ে আসার প্রয়োজন নেই।
দ্বিতীয় পদ্ধতি হবে যদি বিমানের গতি ঘণ্টায় ২৮৮ মাইলের বেশি থাকে এবং উচ্চতা ৪ হাজার ৫৭৫ মিটারের কম থাকে, তবে এই উচ্চ গতি ও কম উচ্চতায় পাইলটকে রক্ষা করতে ছোট প্যারাস্যুট ব্যবহার করতে হবে। সিটের মধ্যে থাকা প্রতিরক্ষামূলক আসনব্যবস্থা সেন্সর নিজে নিজে ব্যবহার করবে।
আরেকটি পদ্ধতি আছে। এটিই সবচেয়ে ভয়ানক পদ্ধতি। এ সময় যেকোনো গতি থাকতে পারে বিমানের। উচ্চতা ৪ হাজার ৫৭৫ মিটারের বেশি হবে। এই অতি উচ্চতায় একটি স্বয়ংক্রিয় প্যারাস্যুট খুলে যাবে। সারভাইভাল কিট থাকবে সিটের মধ্যে। বেঁচে থাকার উপকরণের মধ্যে থাকবে লাইফ জ্যাকেট, ওষুধসহ খুঁটিনাটি প্রয়োজনীয় জিনিস। চট্টগ্রামের মতো পাইলট যদি নদীতে ল্যান্ড করেন, তবে তাঁর জন্য এই সিটের মধ্যে রাখা থাকবে পানিতে জীবন রক্ষাকারী ভেলা, লাইফ জ্যাকেট, সিটের মধ্যে থাকবে ছোট প্যারাস্যুট, মেরুদণ্ড বাঁচাতে থাকবে প্রতিরক্ষামূলক আসনব্যবস্থা।
পাইলট বিপদ বুঝতে পারলে প্রথমে একটি লিভার টেনে মাথার ওপরের ছাদ খুলে ফেলেন। এই লিভার সিস্টেমকে চালু করে। একবার ছাদ খুলে গেলে রেলের পাত দিয়ে আসন সরে গিয়ে রকেট ফায়ার করে। আসনের নিচে থাকে রেললাইনের পাতের মতো ব্যবস্থা। এটি সিট মুক্ত করতে সাহায্য করে। এ সময় পাইলট জরুরি অক্সিজেন ব্যবহার করেন। এরপর পাইলটের দুই হাঁটুর মাঝখানে থাকা লিভার টানেন তিনি। সিটের নিচে থাকা রকেট পাইলটকে খুব দ্রুত প্লেন থেকে বের করে দেয়।
ইজেকশন সিট পাইলটকে কমপক্ষে বাতাসে ৩০ মিটার উচ্চতায় ছুড়ে দেয়। কখনো কখনো ১০০ মিটার পর্যন্ত ছুড়ে দিতে পারে। একবার পাইলট প্লেন থেকে মুক্ত হয়ে গেলে ইজেকশন সিটটি দূরে ছিটকে পড়ে। এর কাজ তখনই শেষ হয়ে যায়। ওয়ান টাইম ইউজ আরকি। একটি প্যারাস্যুট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যায়। কখনো কখনো এটি খোলে যখন পাইলট একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় নেমে আসেন। নিরাপদ অবতরণে ইজেকশন সিটে প্যারাস্যুট ব্যবহার করা হয়। মাটি বা সমুদ্র, যা–ই হোক না কেন, ভেতরে রাখা জীবন রক্ষাকারী ভেলা এখানে কাজ করে।
শুনতে যা–ই মনে হোক, ইজেকশন সিট একটি ভয়ংকর বা মারাত্মক পদ্ধতি। পদার্থবিদ্যা দিয়ে বিষয়টি বোঝা যায়। এই আসন ২৫০ বা এর বেশি গতিতে ৩০ থেকে ১০০ মিটার দূরে সেকেন্ডের কম সময়ে ছুড়ে দেয়। বিমান এ সময় ঘণ্টায় ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার গতিতে উড়তে থাকে। এই প্রচণ্ড গতি মানুষের শরীরের ওপরে চাপ দেয়। পাইলটরা সাধারণত পৃথিবী আমাদের যে আকর্ষণে টানে, তার থেকে ১৪ গুণ বেশি চাপ অনুভব করেন। এর মানে একজন ৮০ কেজি ওজনের ব্যক্তি শরীরে ১ হাজার ৬৩২ কেজি সমান চাপ অনুভব করবেন। এমন অবস্থায় শরীরে আঘাত লাগতে পারে। ইজেকশন করা পাইলটদের বিভিন্ন অঙ্গ ভেঙে যাওয়ার কথা শোনা যায়। তাঁদের হাত–পা ভেঙে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কখনো কখনো মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। কখনো মারাও যান। কিছু পুরোনো প্রযুক্তির ইজেকশনে পাইলটরা ২০ গুণ চাপও অনুভব করেন। মানুষ এর বেশি সহ্য করতে পারে না।
একটি আধুনিক ইজেকশন সিটের দাম হতে পারে ১ লাখ ৪০ হাজার থেকে ৪ লাখ ডলার পর্যন্ত। এটি নির্ভর করে কী কী সুবিধা এতে আছে। এত দামের একটা চেয়ার তো জীবন বাঁচাতে ব্যবহার করা যায়ই। তা–ই নয়? তবে মনে রাখা দরকার, ইজেকশন সিট বিস্ফোরক এবং রকেটের পদ্ধতি ব্যবহার করে। তাই খুব সতর্কতার প্রয়োজন হয়।