টাইটান নিয়ে যা জানা দরকার

ডুবে যাওয়া বিলাসবহুল জাহাজ টাইটানিক নিয়ে নতুন করে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয় ১৯৮৫ সালে। সে বছরই আবিষ্কৃত হয়েছিল টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ। ড. রবার্ট ব্যালার্ড ও তাঁর দল দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর টাইটানিকের অবস্থান খুঁজে বের করে। এরপর আশির দশকজুড়ে বিশ্বব্যাপী চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে টাইটানিক। চর্চার পালে হাওয়া লাগান বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরন। তিনি ১৯৯৭ সালে টাইটানিক চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছিলেন। সিনেমা বানানোর জন্য টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখতে ৩৩ বার আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে গিয়েছিলেন ক্যামেরন। ২৬৯ মিটার লম্বা যাত্রীবাহী জাহাজ টাইটানিক দেখতে যেতে ক্যামেরন ব্যবহার করেন সমুদ্রের গভীরে ডুব দেওয়া বিশেষ যান সাবমার্সিবল।

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে প্রায় ১২ হাজার ৫০০ ফুট বা ৩ হাজার ৮০০ মিটার গভীরে অবস্থিত। এটি নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূল থেকে প্রায় ৩৭০ নটিক্যাল মাইল (৬৯০ কিলোমিটার) দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত, জাহাজটি প্রায় দুই হাজার ৬০০ ফুট দূরে দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে আছে। এর চারপাশে ছড়িয়ে আছে ধ্বংসস্তূপ। ১৫ এপ্রিল ১৯১২ সালে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে আইসবার্গের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ডুবে যায় টাইটানিক। সেটিই ছিল জাহাজটির প্রথম সমুদ্রযাত্রা।

সাবমার্সিবল কী

সাবমেরিন পরিচিত হলেও সাবমার্সিবল তেমন পরিচিত নয়। সাবমেরিনকে বাংলায় আমরা ডুবোজাহাজ বলি। বিশ্বের বহু দেশের নৌবাহিনী নিরাপত্তা রক্ষার কাজে ডুবোজাহাজ ব্যবহার করে। পানির নিচে দীর্ঘ সময় ডুব দিয়ে থাকতে পারে, এমন জাহাজ হলো সাবমেরিন। একটি সাবমেরিন বন্দর থেকে ছেড়ে গিয়ে আবার নিজে থেকে বন্দরে ফিরে আসতে পারে। অন্যদিকে সাবমার্সিবল পরিচালনার জন্য একটি বহনকারী মূল নৌযানের প্রয়োজন হয়। এই জাহাজ সাবমার্সিবলকে পানিতে ছাড়ে, আবার কাজ শেষে ফিরে এলে উদ্ধার করে। স্কুবা ডাইভারের সঙ্গে এর মিল আছে। স্কুবা ডাইভারকে সমুদ্রের একটি নির্দিষ্ট স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ডাইভার কাজ শেষে জাহাজের কাছে ফিরে আসেন। জাহাজটি আবার ডাইভারকে বন্দরে নিয়ে আসে। সাবমার্সিবল যেহেতু পানিতে ডুব দেয়, তাই এটিও একটি ডুবোযান। তুমি একটি ছবি দেখেই সাবমার্সিবল চিনতে পারবে।

সাবমার্সিবলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কারণ, টাইটান নামের একটি সাবমার্সিবল গত মাসে পাঁচজন যাত্রী নিয়ে সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়েছিল। টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসস্তূপ দেখতে রওনা হয়েছিল এটি। যাত্রার ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের মাথায় টাইটানের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মাদার শিপ পোলার প্রিন্সের। যোগাযোগ হারিয়ে যাওয়ার পর বিশ্বজুড়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। টাইটানের পাঁচ যাত্রীকে জীবিত উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবক জাহাজ চালায় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান। টানা চার দিন মহাসাগরের ওপরে ও তলদেশে ব্যাপক তল্লাশি চালানো হয়। সাবমেরিনটিকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় কি না, আরোহীদের জীবিত উদ্ধার করা যায় কি না—এমন আশায় এই তল্লাশি অভিযানের দিকে নজর ছিল সারা বিশ্বের। দুনিয়ার মানুষের চেষ্টা ও প্রার্থনা সত্ত্বেও একসময় জানা যায়, বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেছে টাইটান। মারা গেছেন অভিযানে যাওয়া পাঁচজন যাত্রী।

সেই অভিযানের গল্প নিয়েই এই লেখা

টাইটান

শনি গ্রহের সবচেয়ে বড় চাঁদের নাম টাইটান। বহু বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে টাইটান নামটি পাওয়া যায়। তবে সাবমার্সিবল টাইটান মূলত টাইটানিকের নাম থেকে এসেছে। জলে ডোবা টাইটানিককে দেখার জন্য টাইটানকে বানিয়েছে ওশানগেট নামের একটি কোম্পানি। টাইটান তিনটি অভিযান সম্পন্ন করে। ওশানগেট বলেছে, বাহামার চারপাশের পানিতে টাইটানিকের মতো গভীরতায় টাইটান ৫০ বার পরীক্ষামূলক ডাইভ সম্পন্ন করেছে। এ ছাড়া একটি চাপ চেম্বারে টাইটানের সক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। পানির তলদেশে গবেষণা, অনুসন্ধান, এমনকি ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক—এমন লোকজনকে পানির নিচে নিয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি।

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ ঘুরিয়ে আনতে টাইটানের সময় লাগে প্রায় আট ঘণ্টা। ওশানগেটের তথ্য অনুসারে, টাইটানের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৭ মিটার। প্রস্থ ২ দশমিক ৮ মিটার এবং উচ্চতা ২ দশমিক ৫ মিটার। মোট ওজন ১০ হাজার ৪৩২ কেজি এবং ৬৮৫ কেজি পর্যন্ত ভার বইতে পারে। ১০ ইঞ্চি ব্যাসের একটি কাচের জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পান অভিযাত্রীরা। জানালার কাচ আট ইঞ্চি পুরু। এর চারটি ইনারস্পেস ইলেকট্রিক থ্রাস্টার পানির নিচে জাহাজটিকে সর্বোচ্চ ঘণ্টায় প্রায় ৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার গতিতে চলতে সাহায্য করে। সমুদ্রের চার হাজার মিটার পর্যন্ত গভীরে যেতে পারে টাইটান। এতে পাঁচজন আরোহী সর্বোচ্চ ৯৬ ঘণ্টা লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের সহায়তা পেতে পারেন। একটি শক্তিশালী লজিটেক গেম কন্ট্রোলার এবং টাচ স্ক্রিন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয় টাইটান। লজিটেক এফ৭১০ ওয়্যারলেস গেমপ্যাডটি ২০১১ সালে প্রথম বাজারে আসে। অ্যামাজনে এর দাম প্রায় ৪২ ইউরো। ব্লুটুথ কন্ট্রোলার ব্যবহার করা হয় বলে সবার হাতেই কন্ট্রোলার দেওয়া যায়। বিশেষ অবস্থার জন্য থাকে বাড়তি কন্ট্রোলারও। টাইটানের চালক মেসেজের মাধ্যমে পানির ওপরে থাকা মাদার শিপের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কোনো জিপিএস সিস্টেম নেই এই সাবমার্সিবলে।

ডুবে যাওয়া সাবমার্সিবল টাইটান

সাধারণ সাবমার্সিবলের তুলনায় টাইটানের নকশা করার সময় পুরোপুরি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। বাইরের দিকে কার্বন ফাইবার ও ভেতরে টাইটেনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছে এতে। টাইটানে চেপে পানির নিচে যেতে চাইলে প্রতি অভিযানে একজন যাত্রীকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার খরচ করতে হয়। বছরে একবার এই অভিযান পরিচালনা করে ওশানগেট। অভিযানে পর্যটকদের টাইটানিক জাহাজের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়।

টাইটানের যাত্রী কারা ছিলেন

টাইটানের যাত্রী ছিলেন ওশানগেটের প্রধান নির্বাহী এবং টাইটানের পাইলট স্টকটন রাশ। পাকিস্তানি ব্যবসায়ী পরিবারের দুই সদস্য—শাহজাদা দাউদ ও তাঁর ছেলে সুলেমান দাউদ। ব্রিটিশ অভিযাত্রী হামিশ হার্ডিং ও টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পল হেনরি নারজোলেত। শাহজাদা দাউদের ছেলে সুলেমান দাউদের বয়স মাত্র ১৯ বছর। পানির এত গভীরে যেতে ভয় পাচ্ছিল সে। মূলত যেতেই চায়নি সুলেমান। বাবা দিবসে বাবার সঙ্গে গেলে বাবা খুশি হবেন—এই ভেবে যেতে রাজি হয়েছিলেন।

৫৮ বছর বয়সী হ্যামিশ হার্ডিং একজন ব্রিটিশ অভিযাত্রী। তিনি মহাকাশে গেছেন। বেশ কয়েকবার দক্ষিণ মেরুতেও ভ্রমণ করেছেন। ৭৭ বছর বয়সী পল হেনরি নারজোলেত ফরাসি নৌবাহিনীর সাবেক ডুবুরি। ১৯৮৭ সালে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের এলাকায় যাওয়া প্রথম অভিযানকারী দলের সঙ্গে তিনি ছিলেন। বিশ্বব্যাপী মানুষ তাঁদের প্রতি সমবেদনা ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তাঁদের পরিবারের জন্য সমর্থন দিয়েছেন। কারণ, তাঁরা সত্যিকারের অভিযাত্রী ছিলেন। সাহসিকতার সঙ্গে বিশ্বের মহাসাগর অন্বেষণ করতেন। সমুদ্র সুরক্ষার জন্য গভীর আবেগ কাজ করত তাঁদের।

কী ঘটেছিল?

১৬ জুন পোলার প্রিন্স নামের একটি কানাডীয় জাহাজ বরফ ভেঙে পথ বের করে নিউফাউন্ডল্যান্ড থেকে টাইটানকে নিয়ে সমুদ্রে ছাড়ে। এর আগে চার সপ্তাহে খারাপ আবহাওয়ার কারণে অন্যান্য দলের তিনটি মিশন বাতিল করা হয়। ১৮ জুন রোববার সকালে শুরু হয় অভিযান। প্রস্তুতি নিয়ে ১০টা ৪৫ মিনিটে ডুব দেয় টাইটান। ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর পোলার প্রিন্সের সঙ্গে টাইটানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে টাইটানের ফিরে আসার সম্ভাব্য সময়ের তিন ঘণ্টা এবং শেষ যোগাযোগের প্রায় আট ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পোলার প্রিন্স ইউএস কোস্টগার্ডকে অবহিত করে, টাইটানের খোঁজ নেই। ৯টা ৩৮ মিনিটে কানাডীয় কোস্টগার্ডকে তথ্যটি জানানো হয়।

এরপর সোমবার টাইটান উদ্ধারে শুরু হয় সম্মিলিত অভিযান। পানির ওপর ও নিচে বিশাল এলাকাজুড়ে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। অনুসন্ধানকারী বিমান উড়ে উড়ে সোনার বা শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে টাইটানের খোঁজ করতে থাকে। ২০ জুন সমুদ্র গবেষণার একটি জাহাজ ওই এলাকায় আসে। সমুদ্রের নিচে চলাচল করা জাহাজ অনুসন্ধানে জাহাজটি ব্যবহার করা হয়। ২০ জুন বেলা ১টায় ইউএস কোস্টগার্ডের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, টাইটানের যাত্রীদের আর মাত্র ৪০ ঘণ্টা ব্যবহারের মতো অক্সিজেন রয়েছে।

২১ জুন বুধবার কোস্টগার্ড টুইট করে, সন্ধানকারী একটি বিমান টাইটানের সম্ভাব্য শব্দ ধরতে পেরেছে। টাইটানের ভেতরে কেউ দেয়ালে আঘাত করেছে বলে অনুমান করা হয়। হারিয়ে যাওয়ার চার দিন পর ২২ জুন ১১টা ৪৮ মিনিটে কোস্টগার্ড জানায়, তারা টাইটানের অবস্থান নির্ণয় করতে পেরেছে। একই দিন বেলা তিনটায় ওশানগেট বিবৃতি দেয় যে তাদের বিশ্বাস, পাঁচ যাত্রীর কেউ বেঁচে নেই।

টাইটানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারকারী রোবট

এরপর মার্কিন কোস্টগার্ডের একজন মুখপাত্র বলেন, টাইটান ‘বিপর্যয়কর বিস্ফোরণের’ শিকার হয়েছিল। বিস্ফোরণে পাঁচজন যাত্রীর সবাই মারা গেছেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মার্কিন নৌবাহিনী রোববার ‘বিস্ফোরণ বা বিস্ফোরণের মতো অবস্থা’ শনাক্ত করেছিল। যদিও নির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে তথ্যটি অনুসন্ধানকারীদের জানানো হয়। কর্মকর্তারা অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পাঁচজন যাত্রী বেঁচে আছেন ধরে নিয়ে তাঁদের জীবন বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। প্রচণ্ড পানির চাপের ফলে টাইটানের হুইল ভেঙে পড়ে বলে মনে করা হচ্ছে। সাবমার্সিবলটি এ ধরনের চাপ সহ্য করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা এখন খুঁজে বের করবেন, ঠিক কী ভুল হয়েছিল।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় টাইটান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ৫০০ মিটার নিচে ছিল বলে মনে করা হয়। এত গভীরে পানির চাপের পরিমাণ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় ৫ হাজার ৬০০ পাউন্ড। ভূপৃষ্ঠে মানুষ যে চাপ অনুভব করে, এই চাপ তার চেয়ে কয়েক শ গুণ বেশি। যদি কাঠামোতে ফাটল ধরে, তবে বাইরের চাপ ভেতরের চাপের চেয়ে অনেক বেশি হবে, যা সাবমেরিনকে মুহূর্তে সংকোচন করে ফেলবে। প্রশ্ন হলো, এর ফলে কি বিস্ফোরণ ঘটবে?

ডেভ কর্লি নামের একজন সাবেক মার্কিন পারমাণবিক সাবমেরিন অফিসার জানিয়েছেন, এত গভীরে সাবমেরিন ভেঙে পড়লে এটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ২ হাজার ৪১৪ কিলোমিটার বেগে ভেতরের দিকে দেবে যাবে, যা প্রতি সেকেন্ডে ৬৭১ মিটার হয়। এ ঘটনা ঘটার জন্য প্রয়োজনীয় সময় প্রায় ১ মিলিসেকেন্ড বা ১ সেকেন্ডের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগ। মানুষের মস্তিষ্ক প্রায় ২৫ মিলিসেকেন্ডে একটি উদ্দীপনায় সহজাতভাবে সাড়া দেয়। আর প্রতিক্রিয়া জানাতে ১৫০ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত সময় লাগে। সাবমেরিনের ভেতরের বাতাসে হাইড্রোকার্বন বাষ্পের মোটামুটি উচ্চ ঘনত্ব থাকে। যখন সাবমার্সিবল ভেঙে পড়ে, তখন বাতাস আপনা-আপনি জ্বলে ওঠে। এরপর খুব দ্রুত বিস্ফোরণ ঘটে। তখনই অভিযাত্রীদের জ্বালিয়ে দেয় এবং তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে ছাই ও ফ্ল্যাশে পরিণত হন।

টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ

টাইটান নিয়ে নিরাপত্তা উদ্বেগ

উত্তর আটলান্টিকের গভীরে টাইটানের সমুদ্রযাত্রার অবস্থান আন্তর্জাতিক জলসীমায় অবস্থিত। ঝুঁকি গ্রহণকারী উদ্যোক্তা ধনী পর্যটকদের স্বপ্নপূরণে সহায়তাকারীরা আইনের হাতকে এড়িয়ে যেতে পারেন। টাইটান আন্তর্জাতিক জলসীমায় থাকায় যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য দেশের বেশ কিছু আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। মার্কিন জাহাজ হিসেবে বা নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণকারী আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থার সঙ্গে নিবন্ধিত ছিল না টাইটান। নিরাপত্তাব্যবস্থা পরীক্ষা করে এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষাও করা হয়নি। স্টকটন রাশ, ওশানগেট অভিযানের সিইও এবং টাইটানের পাইলট ছিলেন। তিনি মারা গেছেন। তিনি আইনের মারপ্যাঁচে আবদ্ধ হতে চাইতেন না।

টাইটান আগের ডাইভেও সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল তখনই। ডেভিড পোগ নামের একজন রিপোর্টার ২০২২ সালে টাইটানে ছিলেন। তখন আড়াই ঘণ্টার জন্য মূল জাহাজের সঙ্গে টাইটানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তখনই গভীর সমুদ্র পর্যটনের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। রেকর্ড থেকে দেখা যায় ওশানগেটে বেশ কিছু যান্ত্রিক সমস্যা ছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মুখোমুখি হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ট্রিপগুলো বাতিল বা বিলম্বিত করতে বাধ্য হয়েছিল তারা।

ওশানগেটের দুজন পুরোনো কর্মী টাইটান নিয়ে নিরাপত্তা উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। তাঁরা কয়েক বছর আগে কোম্পানিতে যুক্ত ছিলেন। ওশানগেটের আইনি প্রতিনিধি ২০২১ সালে একটি আদালতে টাইটানের ‘অতুলনীয়’ নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য নিয়ে গর্ব করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, টাইটান ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যা ল্যাবরেটরির সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, ল্যাবটি টাইটানের নকশা, প্রকৌশল বা পরীক্ষা বিষয়ে কাজ করেনি।

টাইটান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর জেমস ক্যামেরন বলেছেন, আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে ‘টাইটান’ নিখোঁজের তথ্য জানার পরই তিনি সাবমেরিনটির পরিণতি বুঝতে পেরেছিলেন।

টাইটান দূর্ঘটনায় নিহত যাত্রীরা

খুঁজে পাওয়া গেল ধ্বংসাবশেষ

প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফুট গভীরে থাকা টাইটানিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষের পাশেই পাওয়া গেছে টাইটানের ধ্বংসাবশেষ। আর এ কাজে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে ফরাসি রোবট ‘ভিক্টর ৬০০০’। ফ্রান্সের সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘ইফ্রেমার’ এই রোবট ব্যবহার করে। দূর থেকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম রোবটটি সমুদ্রের ২০ হাজার ফুট বা ৬ হাজার মিটার গভীরে যেতে পারে। পানির গভীরে বাধা এড়িয়ে পথচলার জন্য রোবটটিতে দুটি হাত রয়েছে। এর ফলে নিয়ন্ত্রণকক্ষের নির্দেশমতো আশপাশে থাকা তার বা রশি কাটতে পারে রোবটটি। রোবটটিতে ছবি এবং ভিডিও ধারণের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি থাকায় আশপাশের দৃশ্য দূর থেকে নিখুঁতভাবে দেখা সম্ভব। টানা ৭২ ঘণ্টা পানির নিচে কাজ করতে সক্ষম ভিক্টর ৬০০০ রোবট নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্রান্সের লা আটলান্টা জাহাজে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ রয়েছে। এই কক্ষ থেকেই সমুদ্রের গভীরে থাকা রোবটটির বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন ২৫ জন কর্মী।

টাইটানের উদ্ধার হওয়া ধ্বংসাবশেষে নিহত পর্যটকদের দেহাবশেষ আছে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ড। স্থানীয় সময় বুধবার সকালে কানাডার সেন্ট জন’স পোতাশ্রয়ে দেশটির পতাকাবাহী একটি জাহাজ থেকে টাইটানের ধ্বংসাবশেষ ক্রেনের সাহায্যে ট্রাকে তুলতে দেখা গেছে। উদ্ধার হওয়া ধ্বংসাবশেষের মধ্যে টাইটানের ল্যান্ডিং ফ্রেম ও রিয়ার কভারও আছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ভিডিওতে ‘হরাইজন আর্কটিক’ জাহাজ থেকে ঝুলন্ত তারের সঙ্গে টাইটানের মূল কাঠামো ও যন্ত্রপাতির একটি ছিন্ন অংশও নামাতে দেখা গেছে। এর মধ্যে অভিযাত্রীদের শরীরের অংশ রয়েছে। বিধ্বস্ত ডুবো যানটির পাঁচটি অংশ উদ্ধার হয়েছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এখন কী হবে

টাইটানে যাত্রী ছিলেন পাঁচজন। টাইটানের ডুবে যাওয়ার সময়ে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীদের নিয়ে একটি মাছ ধরার ট্রলারও ডুবে যায়। যেখানে আরোহী ছিলেন ৭৫০ জন। যাঁদের অর্ধেকের বেশি পাকিস্তানি। বাকিরা সিরীয়, লিবীয় ও উত্তর আফ্রিকার। মানুষের কাছে টাইটান যতটুকু মনোযোগ পেয়েছে, নাম না জানা ট্রলারটি তার সিকি ভাগও পায়নি। তাঁদের উদ্ধারে তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। এ নিয়ে সমালোচনা আছে।

এখন কোস্টগার্ড অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে। টাইটানিকের কাছে ঠিক কী ঘটেছিল, সে সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করা হবে। অনুসন্ধান শেষ হওয়ার কোনো সময়সীমা নেই। অবশ্য এরই মধ্যে ওশানগেট ঘোষণা দিয়েছে, আগামী বছর জুনে তারা আবারও যাত্রী নিয়ে সমুদ্রের গভীরে ডুব দিতে যাচ্ছে! দুটি অভিযান পরিচালনা করবে তারা। এবার কে যাবে এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায়?

সূত্র: বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস ও প্রথম আলো