১৭ বছরের কিশোরী সমাধান করল ৪০ বছর পুরোনো গাণিতিক রহস্য

গণিতবিদ হানা কাইরোছবি: কোয়ান্টা ম্যাগাজিন

একটি গাণিতিক রহস্য সমাধান করে চারদিকে রীতিমতো হইচই পড়ে গেছে। সবাই অবাক, আবার দারুণ খুশিও। কারণ, হানা কাইরো নামের এক কিশোরী মাত্র ১৭ বছর বয়সে গণিতের এক অদ্ভুত রহস্য সমাধান করে ফেলেছে। গণিতবিদেরা এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে ৪০ বছর ধরে, কিন্তু কেউ সফল হতে পারেনি। সেই সমস্যা সমাধান করল এমন একজন, যে কিনা এখনো স্কুলের গণ্ডিই পেরোয়নি। কী সেই সমস্যা? কীভাবে তা সমাধান করল হানা? সেটাও যেন এক রহস্য। তাই একদম প্রথম থেকেই শুরু করা যাক।

হানার কাইরোর গল্প শুরু বাহামাসের নাসাউ শহরে। কাজের জন্য তার বাবা-মা সেখানে চলে গিয়েছিলেন। হানা এবং তার দুই ভাই হোমস্কুলিং বা ঘরে বসেই পড়াশোনা করত। তাদের স্কুলে যেতে হতো না।

আরও পড়ুন

ছোটবেলা থেকেই হানা ছিল একটু অন্যরকম। সে খান একাডেমির অনলাইন ক্লাস দেখে গণিত শিখতে শুরু করল। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, হানা এতটাই দ্রুত শিখতে পারত যে মাত্র ১১ বছর বয়সেই ক্যালকুলাস শেষ করে ফেলল। ক্যালকুলাস গণিতের একটা শাখা যা সাধারণত কলেজে গিয়ে শিখতে হয়। ধরো, কোনো গাড়ির গতিবেগ যদি স্থির থাকে, তাহলে তার অতিক্রান্ত দূরত্ব বের করা সহজ। মানে একটা গাড়ি যদি প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার যায়, তাহলে ২ ঘণ্টায় কত কিলোমিটার গেছে, তা তুমি সহজে হিসেব করতে পারবে। কিন্তু গাড়ির গতিবেগ যদি বদলে যায়, মানে একবার ঘন্টায় ৭০ কিলোমিটার, আবার ৫০ কিলোমিটার হয়, তাহলে তা সহজে হিসাব করা যায় না। আর গাড়ি কিন্তু সবসময় একই গতিতে চলতে পারে না। নানা করণে গাড়ির গতি কমাতে বাড়াতে হয়। গতি যদি বাড়তে কমতে থাকে, তাহলে তা হিসাব করার জন্য প্রয়োজন হয় ক্যালকুলাস। আপাতত এটুকুই জেনে রাখো যে এই গণিত কলেজে না ওঠা পর্যন্ত করতে হয় না। কিন্তু হানা তা মাত্র ১১ বছর বয়সে করা শুরু করে।

হানার এই চেষ্টা দেখে তাঁর বাবা-মা বুঝতে পারলেন, তাদের মেয়ে সাধারণ বাচ্চাদের মতো নয়। তাঁরা কলেজের প্রফেসরদের দিয়ে হানাকে গণিত পড়াতে শুরু করলেন। কিন্তু হানা এত দ্রুত শিখত যে শিক্ষকরাই অবাক হয়ে যেতেন।

তবে শুধু বাসায় থেকে পড়াশোনা করার একটা সমস্যা ছিল। হানা খুব একা অনুভব করত। প্রতিদিন একই ঘরে, একই জায়গায় থাকতে থাকতে তার মন খারাপ লাগত। স্কুলে না যাওয়ার কারণে তার কোনো বন্ধু ছিল না। তবে বাসার মধ্যেই সে গণিতকে বন্ধু বানিয়ে নিল। গণিত হয়ে উঠল তার আলাদা জগৎ। যখন চারপাশের জীবন একঘেয়ে লাগত, তখন গণিতের রহস্যময় পৃথিবীতে সে ঢুকে পড়ত। হানা নিজেই বলেছে, ‘গণিত ছিল আমার আরেকটা পৃথিবী, যেখানে আমি যেকোনো সময় ভেবে চিন্তে পৌঁছে যেতে পারতাম।’

আরও পড়ুন

এরপর হানার জন্য দুজন শিক্ষক রাখা হলো। কিন্তু হানা নিজে পড়ে নিজেই শিখত এবং গণিতের সমস্যা সমাধান করত। হানা কিন্তু গণিতকে ক্লাসের কঠিন সাবজেক্ট হিসেবে দেখত না। সে গণিতকে ভালোবাসত। হানার একজন শিক্ষক তো কিছুদিন পড়ে তার বাবাকে জানালো, সে আর হানাকে পড়িয়ে টাকা নিতে চান না। কারণ, হানাকে তাঁর শেখানোর মতো কিছু নেই। হানা নিজেই প্রতিনিয়ত শিখছে।

২০২১ সালে করোনার সময় হানার জীবনে একটা বড় পরিবর্তন এল। তখন তার পরিবার শিকাগোতে দাদা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। করোনার কারণে সেখানেই আটকে পড়ল। তাই সেখানে হানা ‘ম্যাথ সার্কেল অব শিকাগো’ নামে একটা গ্রুপে যোগ দেয়। এই গ্রুপে শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীরা একসঙ্গে কঠিন গণিতের সমস্যা সমাধান করত।

এই প্রথম হানা অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গণিত নিয়ে কাজ করার সুযোগ পেল। এরপর সে বার্কলে ম্যাথ সার্কেলের একটা প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানকার শিক্ষকরা দেখলেন, হানা মাত্র ১৪ বছর বয়সেই কলেজের উন্নত গণিত জানে।

২০২৩ সালে হানার সামনে একটা বড় সুযোগ এল। তখনো তার স্কুলের পড়ালেখা শেষ হয়নি। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিস তাকে সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। এদিকে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা তাকে পরামর্শ দিলেন অন্য কিছু করতে। শিক্ষিকা হানাকে সরাসরি মাস্টার্স লেভেলে ভর্তি হতে বললেন। তাঁর কথা শুনে হানার পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

হানা সপ্তাহে দুদিন বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস করত। পরে তা বেড়ে পাঁচদিন হয়ে যায়। জীবনে প্রথমবার হানার মনে হলো, সে সত্যিকারের স্বাধীনতা পাচ্ছে।

২০২৪ সালে হানা একটা কঠিন ক্লাসে ভর্তি হলো। এই ক্লাসের নাম ছিল ‘ফুরিয়ার রেস্ট্রিকশন থিওরি’। নামটার মতোই বিষয়টাও অনেক কঠিন। তোমাদের সহজে বোঝার জন্য একটা উদাহরণ দেই। ধরো, তোমার কাছে একটি ম্যাজিক লাইট আছে। এই লাইটের বিশেষত্ব হলো, এটি শুধু বিভিন্ন রঙের আলো তৈরি করতে পারে। কিন্তু ওটার একটি নিয়ম আছে। তুমি একসঙ্গে সব রঙের আলো জ্বালাতে পারবেন না। একসঙ্গে শুধু একটা আলো জ্বালাতে পারবে। ‘ফুরিয়ার রেস্ট্রিকশন থিওরি’ সেরকম একটা নিয়ম। এই নিয়ম আমাদের বলে, কোনো সিগনালের ক্ষুদ্র অংশগুলোর মধ্যে একটি সীমিত সম্পর্ক আছে। সে কারণেই সিগনালের বড় অংশগুলোকে আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো স্বাধীনভাবে পরিবর্তন করতে পারি না। আসলে মূল বিষয়টি আরও অনেক জটিল। তাই এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে হানার গল্পে যাই।

হানার এই নতুন ক্লাসে রুইজিয়াং ঝাং নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি একজন বিখ্যাত গণিতবিদ। হানা তাকে ইমেইল করে ক্লাসে ভর্তি হওয়ার অনুমতি চাইল। শিক্ষক দেখলেন হানা সত্যিই গণিত নিয়ে আগ্রহী, তাই তাকে ক্লাস করার সুযোগ দিলেন। কয়েক সপ্তাহ পরেই হানার সামনে হোমওয়ার্ক হিসেবে একটা গাণিতিক সমস্যা এল। এই সমস্যার নাম ‘মিজোহাতা-তাকেউচি কনজেকচার’। কনজেকচার হলো এমন একটি ধারণা বা অনুমান, যা গণিতবিদরা সত্যি বলে মনে করেন, কিন্তু তা প্রমাণিত নয়। গণিতবিদেরা এই মিজোহাতা-তাকেউচি কনজেকচার প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন ৪০ বছর ধরে। কিন্তু কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। অবশেষে হানার হাত ধরে এল সেই সমাধান।

আরও পড়ুন

হানা জানত, এই সমস্যার সমাধান নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীরা একে প্রমাণ করা যাবে না ভেবে ওটা নিয়ে আর ভাবে না। কিন্তু আগেই বলেছি, হানা অন্যরকম মেয়ে। তাই সে সহজে হার মানল না। হোমওয়ার্কটা নিয়ে ভাবতে লাগল। হানার বাকিটা গল্পটা বলার আগে বুঝতে হবে, এই সমস্যাটা কি। এটাও গণিতের একটি জটিল কনজেকচার। কিন্তু তোমাদের সহজ একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি।

ধরো, তুমি একটা ঘরে গান বাজাচ্ছো। সেই ঘরটা গোলও না, আবার চার কোনাও না। ঘরটা একটু অদ্ভুত ধরনের। মানে নির্দিষ্ট কোনো আকৃতি নেই। এমন একটা ঘরে গান বাজালে ঘরের কিছু জায়গায় গান খুব জোরে শোনা যাবে, আবার কিছু জায়গায় একেবারে কম। এতদিন ধারণা ছিল, তুমি ঘরের যেখানে যে গানই বাজাও না কেন, প্রতিবার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গান জোরে শোনা যাবে। ধরো, দরজার কাছে গান জোরে শোনা যায়, আর জানলার কাছে কম। এখন তুমি যদি ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে গান বাজাও, তাতেও দরজার কাছে সবসময় গানটা জোরেই শোনাবে। আবার এক কোনা থেকে বাজালেও দরজার কাছে গান জোরে শোনাবে এবং জানালার কাছে কম। কিন্তু এটা একটা ধারণা। এর কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ নেই বলেই এটা কনজেকচার।

কিন্তু হানা প্রমাণ করে দেখাল, এই অনুমান ঠিক নয়। মানে সবসময় দরজার কাছেই গান জোরে শোনা যাবে না। মাঝেমধ্যে জানালার কাছেও জোরে শোনাবে। মানে ঘরের কোথায় গান জোরে শোনা যাবে, তার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। অর্থাৎ, আগে থেকে অনুমান করে বলা সম্ভব নয়, কোথায় গান জোরে শোনাবে আর কোথায় কম।

আরও পড়ুন

এই হলো মূল ব্যাপার। এই প্রমাণটা গত ৪০ বছরে কেউ করতে পারেনি। কিন্তু হানা এটা কীভাবে প্রমাণ করল?

হানা প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো অনুমানটা সত্যি। সে সত্যি ভেবেই তা প্রমাণ করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হলো। প্রতিবার শিক্ষককে গিয়ে দেখাত, আর ভুল হতো। তাতেই হানা হাল ছাড়েনি। সে আরও চেষ্টা চালিয়ে গেল। একসময় তার মাথায় একটা অদ্ভুত আইডিয়া এল। সে ভাবল, এটাকে মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা করে দেখি। হয়তো এটা সত্যি নয়। সে একটা জটিল ফাংশন তৈরি করল। সেই ফাংশন অনুসারে, মিজোহাতা-তাকেউচি কনজেকচার সত্যি নয়। কিন্তু প্রথমে তার কাছে মনে হয়েছিল, আবার হয়তো ভুল করেছে। কারণ, আগেও অনেকবার তার ভুল হয়েছিল। কিন্তু এবার শিক্ষক রুইজিয়াং ঝাং বলল, হানার সমাধান সঠিক। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হানা তার গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। তাতে পুরো গণিত জগৎ তোলপাড় হয়ে গেল। যারা ৪০ বছর ধরে এই সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলেন, তারাও অবাক হয়ে গেলেন।

হানার এই আবিষ্কার শুধু একটা পুরনো সমস্যার সমাধান নয়। এটা গণিতের জগতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এখন গণিতবিদেরা নতুন নতুন সমস্যার সমাধানে হানার পদ্ধতি ব্যবহার করবেন।

হানার গল্প অনেক অভিভাবককেও নতুন করতে ভাবাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েই যে শুধু পড়ালেখা শিখতে হবে, ব্যাপারটা এখন আর তেমন নেই। হানা তার প্রমাণ। আর বয়স? ওটা একটা সংখ্যা মাত্র!

সূত্র:

১. হানা কাইরো, আ কাউন্টারএক্সাম্পেল টু দ্য মিজোহাতা-তাকেউচি কনজেকচার (আর্কাইভ ডটঅর্গ)

২. কোয়ান্টা ম্যাগাজিন

৩. ম্যাথ স্টেকএকচেঞ্জ

আরও পড়ুন