পুরোনো সব বইয়ের কথা

বছর শেষে পুরোনো খাতাপত্র বা পত্রিকা কাগজের ফেরিওয়ালার কাছে কেজি দরে বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়টি অনেক বাসাতেই প্রচলিত আছে। আমাদের বাসাতেও ছিল। তখন স্কুলে পড়ি। এক সকালে আম্মু ফেরিওয়ালা ডেকেছেন, পুরোনো কাগজপত্র বিক্রি করে ঘর সাফ করাই তাঁর উদ্দেশ্য। ফেরিওয়ালা বিরস মুখে কাগজ মেপে ঝাঁকার মধ্যে রাখছেন। আমি নজরদারি করছি তাঁর মাপজোখ ঠিক হচ্ছে কি না। এমন সময় চোখ পড়ল তাঁর ঝাঁকার দিকে। ভালো করে তাকাতেই দেখি, সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস সমগ্র! নেহাত কেউ বই পড়ে না, তাই কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছে। মলাটটা হালকা ছেঁড়া। ভেতরে পোকাটোকাও নেই। পুরো বইটিকে নতুনই বলা যায়। সুযোগ বুঝে লোকটার কাছ থেকে পুরোনো বইটি কিনে নিতে চাইলাম। ফেরিওয়ালা তাঁর হিসাব অনুযায়ী বললেন, ‘এক কেজির মতো হইব, ১০ টাকা দেন।’ মাত্র ১০ টাকায় এমন একটা বই পেয়ে যাওয়া তো আর মুখের কথা নয়। আমি রাজ্য জয়ের হাসি দিলাম। ফেরিওয়ালা সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। নিশ্চয়ই তিনি ভাবছিলেন একটা পুরোনো বই পেয়ে এত খুশি হওয়ার কী হলো? পুরোনো বই কেনা সেই থেকে স্বভাব হয়ে গেল।

যারা বই পড়তে এবং সংগ্রহ করতে ভালোবাসো, তাদের হয় বিপত্তি। বিশেষত ছোটরা যদি বইপ্রেমী হয় তবে একটা মুশকিলও বটে! ধরো, সেদিনই তোমাকে একগাদা গল্পের বই কিনে দিয়েছে তোমার আম্মু। ওগুলো পড়া শেষ হতেই তুমি আরও বই কিনতে চাইলে। তখন অনেকেই হয়তো বকা দেবে, সেদিনই না কিনে দিলাম? এ তো গেল এক সমস্যা। বড়দের আরেক অভ্যাস হলো পড়ালেখার সঙ্গে গল্পের বইয়ের একটা বিপরীতমুখী সম্পর্ক খুঁজে বের করা। কোনো কারণে কিছু নম্বর কম পেয়েছ পরীক্ষায়। তখনই বাড়ির বড়রা অভিযোগ তুলবে, সারা দিন গল্পের বই পড়লে তো এমন হবেই! বড়রা তো সব সময় কিনেও দেন না। আর ঝকঝকে নতুন বইয়ের দামও তো কম নয়। পুরোনো বই এ ক্ষেত্রে চমৎকার সমাধান। হাতখরচ বাঁচিয়েই তুমি ইচ্ছেমতো বই কিনে ফেলতে পারো। ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকার মধ্যেই হরেক রকম বই পেয়ে যাবে। মিরপুর ১০ নম্বর ওভারব্রিজের নিচে, ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের পেছনে কিংবা নীলক্ষেত ছাড়াও ঢাকা শহরের অনেক স্থানেই পুরোনো বই কিনতে পাওয়া যায়।

পুরোনো বই শুধু যে সাশ্রয়ী তা কিন্তু নয়। পুরোনো বইয়ে দুই রকমের গল্প খুঁজে পাবে। একটা তো লেখক তাঁর কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখেছেন। এই কৃত্রিম গল্পের বাইরেও অনেক সময় সত্যিকারের কিছু সুন্দর মুহূর্ত, আবেগ আর ভালোবাসার খোঁজ পাওয়া যায় পুরোনো বইয়ে। বুঝিয়ে বলি।

একবার অনেকগুলো পুরোনো বই কিনে আনা হলো। ধুলাবালি ঝেড়ে এর মধ্যে একটা বই পড়তে নিলাম। লেখক গল্পে নায়কের কথা যতবারই লিখেছেন, প্রতিবারই তার হাসির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। এত সুন্দর বর্ণনা যে হাসির শব্দটা পর্যন্ত কানে বাজে! কিন্তু লেখকের গল্পকে ছাপিয়ে আগ্রহ তৈরি হলো অন্য বিষয়ে। নায়কের হাসির প্রতিটি বর্ণনায় কেউ একজন যত্ন করে সবুজ কালি দিয়ে লিখেছে, ‘সাগর, তুমি!’ পাতা ওল্টাতে গিয়ে আরও কয়েক জায়গায় চোখে পড়ল কমবেশি সবখানেই এ রকম মন্তব্য লেখা, ‘আমরা/ তুমি/ তাই না’? হয়তো, কেউ একজন তার খুব কাছের মানুষকে বইটি উপহার দিয়েছিল। পড়তে গিয়ে মিল খুঁজে পেয়ে সেখানে ছোট ছোট মন্তব্য লিখে রেখেছে। তাদের গল্পটা কোথায় গিয়ে থেমেছিল কে বলবে, বইসহ সেই গল্পটা এসে পৌঁছেছে আরেকজনের হাতে।

আরেকটি বইয়ে ছিল জড়ানো হাতের লেখা, ‘স্নেহা মামণিকে ক্লাসে প্রথম হওয়ার শুভেচ্ছাস্বরূপ! —বাবা’। এই ছোট বাক্য থেকেই স্নেহা আর তার বাবার গল্পটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল। মেয়েটা লাল ফ্রক পরা। বাবার কাছ থেকে বই উপহার পেয়ে বেণি দুলিয়ে দুলিয়ে বলছে, ‘বাবা, তুমিই সেরা!’

পুরোনো বইয়ের আরেকটি সুন্দর বিষয় হলো সময় পরিভ্রমণ। ধরো, ১৯৭০ সালের একটি বই তুমি এসে পড়ছ ২০১৮ সালে! এর মধ্যে কত কিছু বদলে গেছে। হয়তো সেই বইয়ের নতুন অনেকগুলো সংস্করণ বেরিয়েছে। প্রচ্ছদ, মূল্য সবই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তুমি সেই ১৯৭০ সালের সময়টিতে যেমন ছিলে, ঠিক তেমনই একটা বই পড়ছ। বিখ্যাত লেখকদের প্রথম সংস্করণের বই বাইরের দেশে অনেক মূল্যে বিক্রি হয়। আবার উপহার হিসেবে দেওয়ার রীতিও প্রচলিত আছে। কাজেই বই পুরোনো হলেই যে তার আবেদন কমে যায়, এমন কিন্তু না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বাড়ে।

লেখা শেষ করি এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা দিয়ে। বেশ কয়েক বছর আগের এক বইমেলায় বই কিনছি। হঠাৎ লক্ষ করে দেখি, এক স্টলের সামনে বিশাল জটলা! এত ভিড়ের কারণ কী? একটু পরই রহস্য উন্মোচিত হলো। হুমায়ূন আহমেদ এসেছেন। সবাই ছুটছে তাঁর অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। আমারও ইচ্ছে হলো অটোগ্রাফ নিই। কিন্তু অমন ভিড় সামলে অটোগ্রাফ নেওয়ার চেয়ে এভারেস্ট জয় করাই ঢের সহজ কাজ মনে হলো। তাই অটোগ্রাফ না পাওয়ার আফসোস নিয়েই বাড়ি ফিরলাম। এর কয়েক মাস পর কিছু পুরোনো বই কিনলাম। হুমায়ূন আহমেদের বইও ছিল সেখানে। বইয়ের প্রথম পাতা উল্টে চমকে উঠলাম। সেখানে তাড়াহুড়ো করে লেখা, ‘শুভেচ্ছা! হুমায়ূন আহমেদ’! কে বলবে হয়তো পুরোনো বইয়ের মধ্যে তুমিও এমন অনেক গল্প, সুন্দর মুহূর্তের সঙ্গে প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফও পেয়ে যেতে পারো। কবি তো আর এমনি এমনি বলেননি, ‘পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন!’