বয়সের ভারে বুদ্ধি কি বাড়ে
‘তিন মাথা যার, বুদ্ধি নেবে তার’—তোমরা কি এই লোকজ প্রবাদটির কথা শুনেছ? যারা শোনোনি তারা নিশ্চয়ই ভাবছ, তিন মাথা আবার কার হয়? আসলে এখানে তিন মাথা বলতে এমন মানুষকে বোঝানো হয়েছে, যিনি বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। মেরুদণ্ড সোজা করে আর দাঁড়াতে পারেন না। বসলে দুই হাঁটু আর মাথা সমান্তরালে চলে আসে। আর তখন মনে হয়, অতি বৃদ্ধ এই মানুষটিই যেন একজন তিন মাথার মানুষ। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় তাঁর ঝুলি পরিপূর্ণ থাকে বলে অন্যারা মনে করেন, তাঁর কথা বা পরামর্শ হবে সঠিক, নির্ভুল। কিন্তু আসলে কি তাই? বয়সের ভারে বুদ্ধি কি বাড়ে?
সাইন্সডিরেক্ট জার্নালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধ থেকে জানা যায় যে মানুষের জ্ঞানের বেশ কিছু দিক বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, তখন মস্তিষ্কের ফ্লুইড ইন্টিলিজেন্স বা তরল বুদ্ধিমত্তা হ্রাস পায়। তাহলে প্রথমেই আমাদের জানা দরকার, কী এই ফ্লুইড ইন্টিলিজেন্স বা তরল বুদ্ধিমত্তা এবং এর কাজইবা কী?
ফ্লুইড ইন্টিলিজেন্স বলতে সাধারণত দ্রুত চিন্তা করার সামর্থ, গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা, যুক্তি এবং নিত্যনতুন সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাকে বোঝায়। মানুষ নিজের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক নানামুখী কাজে ও সমস্যা সমাধানে এটা ব্যবহার করে। এই ফ্লুইড ইন্টিলিজেন্সে একটি মানুষের ৫০ বছর বয়স হবার আগ থেকেই হ্রাস পেতে শুরু হয়, আর ৫০ এর পর এটা দ্রুত কমতে থাকে। অপর দিকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লুইড ইন্টিলিজেন্স কমলেও ক্রিস্টাল ইন্টিলিজেন্স বাড়তে থাকে। আর এই ক্রিস্টাল ইন্টিলিজেন্স হলো একজন মানুষের অভিজ্ঞতা, শব্দ ভান্ডার ও জ্ঞান। যেমন একজন ডাক্তারের উচ্চমাত্রার ক্রিস্টাল ইন্টিলিজেন্স রয়েছে, তাঁরা প্রচুর পরিমাণ শব্দ মুখস্ত রাখতে, মনে রাখতে ও তথ্য বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। ফলে আমরা দেখি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মানেই যেন বয়োবৃদ্ধ ডাক্তার।
১৮ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে শিশুর মস্তিস্ক দ্রুত শিখতে শুরু করে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে ১০ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত দ্রুত ও বহুমুখী পরিবর্তন আসে বুদ্ধিমত্তায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ২০ বছর বয়সে মস্তিষ্ক পরিপক্বতা লাভ করে। কিন্তু বয়স যখন পৌছে চল্লিশের কোঠায়, তখন কোন পরিবর্তনে মস্তিস্কের সাড়া দেবার ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। ফলে ঘরের চাবি রাখার জায়গাটা পরিবর্তন হলেও তা মনে করতে সময় লাগে কারও কারও। বয়স যত বাড়তে থাকে, এই সমস্যাগুলো আরও প্রকট আকার ধারণ করে।
বয়স পয়ষট্টির পর থেকে মস্তিস্কের আকার সংকোচিত হয়। বুদ্ধিমত্তা কমতে থাকে। এসময় মানুষের নতুন কিছু শেখা ও পুরানো শিক্ষা পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পায় এবং সংবেদনশীল মেমোরি হয়ে পড়ে স্থিতিশীল।
কিন্তু এর ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। স্টিফেন হকিং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পৃথিবীকে দিয়ে গেছেন নতুন কিছু। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জীবনের শেষ প্রান্তে, বৃদ্ধ বয়সে মানুষের কর্মচাঞ্চল্য থাকে না। বুদ্ধির দীপ্তি কমে যায়। আবার বহু মানুষের ক্ষেত্রে প্রকৃতির এই নিয়ম মেনে নেয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। বয়সের সঙ্গে বুদ্ধির এই রসায়ন নিয়ে বিশ্বজুড়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাও কম হচ্ছে না। তবুও স্থান, কাল, ঘটনা ভেদে এই প্রশ্ন বারবার চলে আসে—বয়সের ভারে বুদ্ধি কি বাড়ে?