বিমান উধাও

২০১৪ সালের ৮ মার্চ। রাত ১২টা ৪১ মিনিট। মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট-৩৭০-এ চেপে বসেন ২৩৯ জন যাত্রী। গন্তব্য কুয়ালালামপুর থেকে চীন। রানওয়ে পেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছে বোয়িং ৭৭৭-২০০ইআর উড়োজাহাজটি। সকালের অপেক্ষায় সবাই সিটবেল্ট বেঁধে নেন ঠিকঠাক। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় বেইজিংয়ে অবতরণ করলেই এই ওড়ার যাত্রায় যাত্রীদের ছুটি।

রাত ১টা ১৯ মিনিট। বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ থেকে ‘সবকিছু ঠিক আছে’ বোঝাতে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারে পাঠানো নিয়মিত বার্তায় বলা হয়, ‘শুভরাত্রি মালয়েশিয়ান থ্রি সেভেন জিরো।’ এর পরেই এয়ারক্রাফ্ট কমিউনিকেশনস অ্যাড্রেসিং অ্যান্ড রিপোর্টিং সিস্টেম বা এসিএআরএস বন্ধ হয়ে যায়। ভিয়েতনামের দক্ষিণে জলসীমায় যাওয়ার পর রহস্যজনকভাবে বোয়িং ৭৭৭-২০০ইআর উড়োজাহাজটি নিখোঁজ হয়। আন্তর্জাতিকভাবে অনুসন্ধান চালিয়েও বিমানটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। বিমানটি সর্বশেষ দক্ষিণ ভিয়েতনামের কামাও প্রদেশের আকাশসীমা থেকে হো চি মিন সিটির বিমান নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর আর কোনো সাড়া মেলেনি।

মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, উড়োজাহাজে ১৫টি দেশের নাগরিক ছিলেন।

রাডার ফাঁকি

উড়োজাহাজটি নিখোঁজের ১০ দিন পর জানানো হয়, যাত্রীবাহী বিমানটি নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হওয়ার পর অন্তত আট ঘণ্টা আকাশে অবস্থান করছিল। দীর্ঘ এই সময়ে বাণিজ্যিক রাডারগুলো ফাঁকি দিতে অস্বাভাবিক নিচু দিয়ে উড়ছিল এটি। নিখোঁজ বিমানটি থেকে সর্বশেষ পাওয়া বার্তা ‘অল রাইট, গুড নাইট’, অর্থাৎ সব ঠিক আছে, শুভরাত্রি—এটি কার কথা, তা নিয়েও সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশা। বিমানের ক্যাপ্টেন, তাঁর প্রথম সহকারী, নাকি ককপিটে তাঁদের সঙ্গে থাকা অন্য কেউ এ কথাগুলো বলেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। মালয়েশীয় কর্মকর্তারা আগে বলেছিলেন, শেষ কথাটি কার, তা তাঁরা জানেন না। পরে তাঁরা বলেছেন, তাঁদের ধারণা, এটি সহ-পাইলট ফারিক আবদুল হামিদের। সে সময় টেলিগ্রাফ জানিয়েছিল, বোয়িং ৭৭৭-২০০ইআর রাডার ফাঁকি দিতে স্বাভাবিক উচ্চতা থেকে অনেক নিচে নেমে আসে। আরেকটি সূত্র বলেছে, উড়োজাহাজটি রাডার ফাঁকি দিয়ে তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকা আফগান সীমান্তের দিকে উড়ে থাকতে পারে।

সামনে এসেছিল যেসব প্রশ্ন

নিখোঁজ হওয়ার পর মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটি নিয়ে পাওয়া নতুন কিছু তথ্য রহস্যের ধূম্রজাল না ছিঁড়ে বরং জন্ম দিয়েছে নতুন প্রশ্নের। জানা গেছে, ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে ওই বিমানে ওঠা দুই সন্দেহভাজন ব্যক্তি ইরানের নাগরিক। তবে দৃশ্যত সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগসূত্র নেই।

মালয়েশিয়ার পুলিশ ও আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল দুই জাল পাসপোর্টধারীকে ইরানি হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে তাঁরা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য নন।

মালয়েশিয়ার সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, রাডারের পর্দা থেকে মিলিয়ে যাওয়ার আগে উড়োজাহাজটি দিক পরিবর্তন করে পশ্চিম দিকে মোড় নিয়েছিল। সর্বশেষ এটি মালাক্কা প্রণালির ওপর দিয়ে উড়ছিল। এর আগে বলা হয়েছিল, বিমানটি নিখোঁজ হয় আরও বেশ খানিকটা পূর্ব দিকে, ভিয়েতনামের দক্ষিণ উপকূলের অদূরে।

ব্যর্থ অনুসন্ধান এবং চীনের ১০ স্যাটেলাইট

নিখোঁজ হওয়ার চার দিনের মাথায় উড়োজাহাজের সন্ধানে চীন ১০টি স্যাটেলাইট মোতায়েন করে, যেগুলো সাগরে সম্ভাব্য ধ্বংসাবশেষ অনুসন্ধানে সাহায্য করে। কিন্তু এতে কোনো তথ্য মেলেনি। পরে ২২টি বিমান ও ৪০টি বিভিন্ন ধরনের নৌযান তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে নিখোঁজ উড়োজাহাজটিকে। কিন্তু সাগরে তেলের স্তর ভাসতে দেখা ছাড়া এর ধ্বংসাবশেষের আর কোনো আলামত মেলেনি। ওই তেল বিমানটির কি না, সে বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পরে ২৬টি দেশের সমন্বয়ে চলা অনুসন্ধান অভিযানে বেশ কয়েকটি বিমান ও জাহাজ অংশ নেয়। অভিযানে চষে ফেলা হয়েছে ৪৫ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা। অনুসন্ধান চলেছে পানির তলদেশে চলায় সক্ষম ড্রোন বা চালকবিহীন বিমান দিয়েও। এর কিছুই ফল বয়ে আনেনি।

আশার আলো নাকি মরীচিকা!

অনুসন্ধানে গিয়ে থাইল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলে একটি উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। সেটি মালয়েশিয়ার নিখোঁজ হওয়া এমএইচ৩৭০ বিমানের হতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার পরিবহন মন্ত্রণালয় জানায়, সরকার ও মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের একটি বিশেষজ্ঞ দল থাইল্যান্ডের ওই ধ্বংসাবশেষগুলো পরীক্ষা করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ধ্বংসাবশেষগুলো ওই বিমানের নয়।

২০১৫ সালের ২৯ জুলাই ভারত মহাসাগরে ফ্রান্সের মালিকানাধীন রিইউনিয়ন দ্বীপের সৈকতে খুঁজে পাওয়া আরেকটি ধ্বংসাবশেষকে বোয়িং বিমান ৭৭৭-এর অংশ বলে মনে করা হলেও এ নিয়েও আর তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

উড়োজাহাজ হারানোর রহস্য

১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর ফ্লোরিডা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল পাঁচটি প্রশিক্ষণ বিমান। উড্ডয়নের দেড় ঘণ্টা পরে পাইলটরা জানান যে তাঁরা বিভ্রান্তি বোধ করছেন এবং নিচের কিছুই চিনতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত বিমানগুলো সাগরে বিধ্বস্ত হয়। ফ্লাইট ১৯ নামে পরিচিত এ ঘটনায় পাঁচটি প্রশিক্ষণ বিমান হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলা ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’ কাহিনির জন্ম দেয়। যে রহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি।

আরেকটি রহস্যময় ঘটনার নায়িকা মার্কিন কৃতী নারী বৈমানিক অ্যামিলিয়া ইয়ারহার্ট। বিশ্ব প্রদক্ষিণ করতে বেরিয়ে ১৯৩৭ সালের ২ জুলাই মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে হারিয়ে যান ইয়ারহার্ট। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়। বেশির ভাগ গবেষকই মনে করেন, জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় তাঁর বিমান সাগরে বিধ্বস্ত হয়। তবে মার্কিন গুপ্তচর সন্দেহে জাপানিদের হাতে আটক হওয়া থেকে শুরু করে ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের হাতে বন্দী হওয়ার মতো বহু চমকপ্রদ গল্প চালু আছে ইয়ারহার্টকে নিয়ে।

এ রকম মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ৩৭০-এর পরিণতি নিয়েও কয়েকটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। সেগুলো হলো

চালকের আত্মহত্যা তত্ত্ব

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলে শেষ বার্তাটি ক্যাপ্টেন জাহারি আহমাদ শাহ নাকি ফার্স্ট অফিসার ফারিক আবদুল হামিদ পাঠিয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। মালয়েশিয়ার তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, জাহারিই বার্তাটি পাঠিয়েছিলেন। এ রকম একটি তত্ত্ব রয়েছে যে একজন চালক অন্য চালককে নিষ্ক্রিয় করে উড়োজাহাজটি ভূপাতিত করে সব যাত্রী নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের প্রধান নির্বাহী আহমাদ জাহারি এ ধারণা নাকচ করে দিয়েছেন।

ককপিটে অতিথি তত্ত্ব

বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতা থাকা আমেরিকান এয়ারলাইনসের সাবেক পাইলট মার্ক উইসের ধারণা, বিমানটি বিপন্ন হওয়ার পর পর ভেতরে একটি ধস্তাধস্তি বা সংঘাত হয়েছিল। হয়তো কোনো একজন পাইলট এমন কিছু করেন, যা উড়োজাহাজটি ধ্বংস হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ওই ফ্লাইটের সহযোগী চালক আবদুল হামিদ ২০১১ সালে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া পথে একবার ককপিটে এক নারী ও তাঁর বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানান। উইসের মতে, এ ধরনের ঘটনা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দেয়। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেছেন, এমএইচ-৩৭০-এর ককপিটে কোনো তৃতীয় পক্ষ থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

ছিনতাই তত্ত্ব

গোপন কোনো উদ্দেশ্যে উড়োজাহাজটি ছিনতাই হয়েছে বলেও একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তবে এই ধারণা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কেননা, ঘটনার পর কোনো দল বা সন্ত্রাসী সংগঠন দায় স্বীকার করেনি।

কাজাখস্তান তত্ত্ব

এই তত্ত্ব অনুযায়ী, রুশ কোনো ব্যক্তি চীন, পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্তঘেঁষা কাজাখস্তানের এক ক্ষুদ্র বিমানবন্দরে নিয়ে গেছেন উড়োজাহাজটি। ওই বন্দরটি রাশিয়ার কাছে লিজ দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানবিষয়ক সাংবাদিক ও বিমানচালক জেফ ওয়াইজ এই তত্ত্ব দিয়েছেন।

যান্ত্রিক গোলযোগ তত্ত্ব

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, উড়োজাহাজটি যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে। বৈদ্যুতিক কোনো কারণে বা বড় ধরনের আগুন লাগার কারণে চালক যোগাযোগ করতে পারেননি। আমেরিকান এয়ারলাইনসের সাবেক চালক জিম টিলমন বলেন, একসঙ্গে পুরো বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা কারণ হতে পারে। তবে এটার সম্ভাবনা খুব কম। কেননা, উড়োজাহাজের বিভিন্ন স্থানে থাকা জেনারেটর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়ে থাকে। একটিতে ত্রুটি হলে অন্যটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়।

২৩৯ জন আরোহী নিয়ে উড়োজাহাজটি কোথায় গেল বা এর ভাগ্যে কী ঘটেছে, তার কোনো সূত্র পাননি অনুসন্ধানকারীরা। নিখোঁজ হওয়ার তিন বছর পর ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি ফ্লাইট এমএইচ৩৭০-এর খোঁজে তল্লাশি স্থগিত করা হয়। এভাবে বিমানটির আকস্মিক হারিয়ে যাওয়া পুরোটাই রহস্যের জালে ঘেরা। এটা কি কোনো সন্ত্রাসী হামলা? নাকি যান্ত্রিক গোলযোগে বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা? বিমানটি কি মাটি বা পানিতে আছড়ে পড়েছে? আরোহীদের কেউ কি আদৌ বেঁচে আছেন? এ রকম নানা প্রশ্নের উত্তর আজ অজানা। এত সব অজানা নিয়েই স্থগিত করা হয় তল্লাশি কার্যক্রম। তাই এমএইচ৩৭০ রয়ে গেল সেই গভীর রহস্যেই আবৃত।

এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি অনলাইন ও টেলিগ্রাফ অবলম্বনে