নেদারল্যান্ডস না হল্যান্ড, সঠিক নাম কোনটি

বাংলাদেশের মানুষকে বলি বাংলাদেশি। ফ্রান্সের মানুষকে ফরাসি, ভারতের মানুষ ভারতীয়। দেশের নাম দিয়ে মানুষ বোঝানো হয়। তবে সব সময় না। কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন নেদারল্যান্ডসের বাসিন্দাদের নেদারল্যান্ডসিয়ান ডাকা হয় না। বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ তাদের বলে ‘ডাচ’। এই নামের পেছনে কিছু ঐতিহাসিক কারণ আছে। আবার নেদারল্যান্ডসকে আমাদের দেশসহ বিশ্বজুড়ে অনেক দেশেই লোকে ডাকে ‘হল্যান্ড’। পুরোনো বইপত্রে এই নাম পাওয়া যায়। পুরোনো দিনের মানুষ নেদারল্যান্ডসকে হল্যান্ড বলত। দেশের নাম নেদারল্যান্ডস, ডাকা হয় হল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসে বাস করা লোককে বলা হয় ডাচ, এমন ভিন্নতা কেন?

নেদারল্যান্ডস বা নিচু ভূমির দেশ

‘নেদারল্যান্ডস’ মানে নিচু ভূখণ্ড বা দেশ। নামটি অনেক পুরোনো হলেও অঞ্চলটি সব সময় নেদারল্যান্ডস নামে পরিচিত ছিল না। নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়াম দেশ দুটি নিয়ে গঠিত অঞ্চলকে একসময় ‘নিচু দেশ’ না নেদারল্যান্ডস বলা হতো। ইতিহাসে বহুবার এই নামের পরিবর্তন হয়েছে। তবে নামকরণ এসেছে নিচু ভূমি থেকেই। এই নামের পেছনে একটিই রহস্য, এই ভূমি চারপাশের তুলনায় নিচু।

খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে যখন এই অঞ্চল রোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল, তখন একে বলা হতো ‘জার্মানিয়া ইনফেরিয়র’। ওপরের অংশটির নাম ছিল ‘জার্মানিয়া সুপিরিয়র’। দশম শতকে যখন জার্মানির রাজ্য অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণে নেয়, তখন এর নাম হয় ‘লোয়ার লরিন’।

নেদারল্যান্ডস শব্দটি ইতিহাসে প্রথম দেখা যায় ১৫ শতকে। তখন এই শব্দ দিয়ে এই অঞ্চলের ভাষাকে বোঝানো হতো। একই সঙ্গে অঞ্চলটির মানুষের জন্য ‘ডাচ’ শব্দটিও প্রচলিত ছিল।

আরও কয়েক শতাব্দী পরে নেদারল্যান্ডস শব্দটি দিয়ে ধীরে ধীরে অঞ্চলটির নাম বোঝানো শুরু হয়। ভাষার নাম হয়ে যায় ডাচ। ১৯ শতকে দেশটি বেলজিয়াম থেকে আলাদা হয়ে যায়। এর পর থেকেই নেদারল্যান্ডস নামটি দেশের নাম হিসেবে প্রচলিত হতে শুরু করে। একসময় দেশটির অফিসিয়াল নাম হয় ‘দ্য নেদারল্যান্ডস’।

ডাচ বা পুরোনো শব্দের আধুনিক রূপ

‘ডাচ’ শব্দটি এসেছে একটি প্রাচীন জার্মান শব্দ থেকে, যার মানে ‘জনগণের’ বা ‘মানুষের’। শব্দটির সম্পর্ক আছে জার্মান ভাষার ‘ডাচ’–এর সঙ্গে। জার্মানরা নিজেদের দেশকে বলে ডয়চেল্যান্ড।

ডাচ ভাষা ও জার্মান ভাষা একই পরিবারভুক্ত। যেমন বাংলা, উড়িয়া, অহমিয়া একই গোষ্ঠী, মানে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা। তাই ডাচ আর জার্মানের মধ্যে সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। একসময় নেদারল্যান্ডসকে যেমন বলা হতো ‘নেদারডাচ’, মানে ছিল ‘নিচু অঞ্চলের মানুষ’।

পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ নেদারল্যান্ডসের ভাষাকে ডাচ বলে জানে। শুধু ইংরেজি ভাষায় নেদারল্যান্ডসের ভাষা বোঝাতে ডাচ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। ডাচরা নিজেদের ভাষাকে বলে ‘নেদারল্যান্ডস’। অন্যান্য ভাষায়ও এর কাছাকাছি নাম প্রচলিত।

এই দেশে বছরে প্রায় দুই কোটি পর্যটক ভ্রমণ করেন যাঁদের অধিকাংশই কেবল আমস্টারডামে ঘোরাফেরা করেন। নেদারল্যান্ডস সরকার ‘হল্যান্ড’ নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেয়, যেন পর্যটকেরা আমস্টারডামের হল্যান্ড অঞ্চলের বাইরেও ভ্রমণে উৎসাহিত হন

ইংরেজিতে ডাচ শব্দটি বহু বছর ধরে নানা ধরনের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি উদাহরণ হলো ‘পেনসিলভানিয়ান ডাচ’। এটি আসলে জার্মান ভাষার একটি শাখা, এই ভাষা গড়ে উঠেছে উত্তর আমেরিকায়। তাই নেদারল্যান্ডসকে ঘিরে নামের এই প্যাঁচ এসেছে ইংরেজি ভাষা থেকে। আর আমরা যেহেতু প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি, তাই আমাদের মধ্যেও এই তিন নাম নিয়ে আলোচনা চলছে।

হল্যান্ড: একটি অঞ্চল

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

অপর দিকে নেদারল্যান্ডসকে শুধু ইংরেজিভাষীরাই হল্যান্ড নামে ডাকে না। অন্য ভাষার মানুষও নেদারল্যান্ডসকে হল্যান্ড বলে। শব্দটি এসেছে পুরোনো ডাচ ‘হট ল্যান্ড’ থেকে। এর মানে ‘বনের জমি’ বা ‘কাঠের দেশ’। এটি মূলত নেদারল্যান্ডসের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে বোঝায়।

নেদারল্যান্ডসকে হল্যান্ড বলা অনেকটা শুধু ইংল্যান্ডকে পুরো ইউনাইটেড কিংডম বা যুক্তরাজ্য বলার মতো। নেদারল্যান্ডসের অনেকেই হয়তো কিছু না বলেই কথাটা মেনে নেয়। কিন্তু নামটা পুরোপুরি সঠিক নয়।

তবে ইতিহাসে একবার এমন হয়েছিল, যখন পুরো নেদারল্যান্ডসের নাম ছিল হল্যান্ড। ১৮০৬ থেকে ১৮১০ সাল পর্যন্ত। তখন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁর ভাইকে সেখানকার শাসক বানিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। যদিও এখন মানুষ নেদারল্যান্ডসকে যে কারণে হল্যান্ড বলে, সেটা ওই সময়ের কারণে নয়।

আসলে ইতিহাসে হল্যান্ড অঞ্চলটি দীর্ঘ সময় ধরে স্বায়ত্তশাসিত ছিল। তাই অনেক সময় সেটিকেই পুরো দেশের নাম মনে করা হতো। তার ওপর হল্যান্ডের গ্রামীণ দৃশ্য, গরু, টিউলিপ, উইন্ডমিল ইত্যাদির দৃশ্য এখন ডাচ সংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।

একসময় হল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস, দুটি নামই প্রায় একইভাবে ব্যবহার করা হতো। তবে ২০২০ সালে নেদারল্যান্ডস সরকার সরকারি পরিচিতি থেকে ‘হল্যান্ড’ শব্দটি বাদ দিয়ে দিয়েছে। কিংডম অব নেদারল্যান্ডস গঠিত হয়েছিল ১৮১৫ সালে। এই দেশের ১২টি প্রদেশের মধ্যে নর্ড হল্যান্ড (উত্তর হল্যান্ড) এবং জিড হল্যান্ড (দক্ষিণ হল্যান্ড) ছিল কেবল দুটি। নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে বড় শহর আমস্টারডাম অবস্থিত নর্ড হল্যান্ডে। এই অঞ্চলই দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে। ফলে অনেক সময়ই পুরো দেশকে বোঝাতে হল্যান্ড শব্দটি ব্যবহৃত হতে শুরু করেছিল।

এই নাম বাদ দেওয়ার কারণ, এই দেশে বছরে প্রায় দুই কোটি পর্যটক ভ্রমণ করেন যাঁদের অধিকাংশই কেবল আমস্টারডামে ঘোরাফেরা করেন। নেদারল্যান্ডস সরকার ‘হল্যান্ড’ নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে বাদ দেয়, যেন পর্যটকেরা আমস্টারডামের হল্যান্ড অঞ্চলের বাইরেও ভ্রমণে উৎসাহিত হন এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের পরিচিতি যেন আরও সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়।

সরকারি দলিলপত্র থেকে হল্যান্ড শব্দটি মুছে ফেলার পাশাপাশি দেশের পর্যটন বোর্ড নতুনভাবে লোগো তৈরি করেছে। আগের লোগোতে একটি কমলা টিউলিপের পাশে ছিল হল্যান্ড শব্দটি, নতুন লোগোতে এর বদলে ‘এনএল’ অক্ষরের মধ্যে টিউলিপ।

ভুল–বোঝাবুঝি এড়াতে এবং সম্মান দেখাতে দেশটিকে সঠিক নাম তথা ‘নেদারল্যান্ডস’ বলাই ভালো

আরও পড়ুন