বীরসিংহের বীর ছেলেটা

আঁকা: মাসুক হেলাল

বীর বললেই কেমন যেন সুঠাম দেহ, চকচকে পোশাক, হাতে তলোয়ার, সঙ্গে ঘোড়া—এমন এক ছবি ভেসে ওঠে। আমরা যে বীরের কথা বলছি, তাঁর এসব কিচ্ছু নেই। কিন্তু আছে বীরের সাহস আর ঋজুতা। একেবারে সাদামাটা বাঙালি পোশাকে তিনি চলতেন, কারও সঙ্গে এগিয়ে এসে ঝগড়া করতেন না, কিন্তু নিজের কাজের জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেছেন এবং বাঙালিকে দিয়েছেন নতুন পথের সন্ধান। তিনি আর কেউ নন, আমাদের অতি চেনা নাম—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মজার ব্যাপার হলো, তিনি যে গ্রামে জন্মেছিলেন, তার নাম ছিল বীরসিংহ। পশ্চিম বাংলার হুগলি জেলার এই গ্রামের আলো–বাতাসেই ছেলেবেলা কেটেছে আমাদের এই বীরের।

ঈশ্বরচন্দ্র যখন মাতৃগর্ভে, তখন তাঁর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে সময়ের এক গ্রামীণ চিকিৎসক তাঁর মা ভগবতী দেবীকে বলেছিলেন, যে সন্তান আসছে, ঈশ্বরানুগৃহীত হয়ে সে জন্ম নেবে। তাই ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সন্তান জন্ম নিলে মা-বাবা দুজনেই তাঁর নাম রাখেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র’। মজার ব্যাপার, বিদ্যাসাগরের জন্মমুহূর্তে তাঁর বাবা ঠাকুরদাস দূরের হাটে গিয়েছিলেন। পিতামহ রামজয় নাতি হওয়ার সংবাদ পুত্র ঠাকুরদাসকে দেওয়ার জন্য হাটে ছুটে যান। গিয়ে তিনি পুত্রকে বলেন, বাড়িতে এঁড়ে বাছুর হয়েছে। ঠাকুরদাস ভেবেছেন, বাড়ির একটি গরুর বাছুর হওয়ার কথা, সেটাই বুঝি। তিনি বাড়িতে এসে সোজা ঢোকেন গোয়ালঘরে। বাড়ির সবাই হেসে ওঠেন। পরে তিনি জানলেন তাঁর পুত্রসন্তান হওয়ার সংবাদ। দাদু কৌতুক করে নাতিকে এভাবে ‘এঁড়ে বাছুর’ বললেও পরে কিন্তু দেখা গেছে, বিদ্যাসাগর বাঙালির স্বার্থে কাজ করার জন্য এঁড়ে বাছুরের মতোই ‘একগুঁয়ে’ হয়েছিলেন।

এই যে আমরা বারবার ‘বিদ্যাসাগর’ বলছি, তাঁর পদবি কি সত্যি ‘বিদ্যাসাগর’?

না।

তাঁর পদবি বিদ্যাসাগর নয়, বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি স্বাক্ষর করতেন ‘শর্ম্মণ’ লিখে।

তাহলে ‘বিদ্যাসাগর’ হলেন কীভাবে?

ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজে পড়ছিলেন, তখন সেই কলেজের অধ্যাপকদের দেওয়া প্রশংসাপত্রে তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু তারও আগে ১৮৩৯ সালে হিন্দু ল কমিটির পাসের সময় তিনি ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি পান। এরপর থেকে এই উপাধিই তাঁর নামের মূল পদবিকে বিদায় করে দেয় এবং সর্বজনে তাঁর নাম হয় ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’।

বিদ্যাসাগর নিয়ে নানা কিংবদন্তি ছড়িয়ে আছে। কিংবদন্তি কাকে নিয়ে হয়? যিনি সমাজে মানুষের চিত্ত অধিকার করতে পারেন, তাঁকে নিয়েই হয়। বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাস পুত্রের প্রতি মনোযোগী ছিলেন। তাই বিদ্যাসাগরকে ছেলেবেলাতেই তিনি গ্রাম থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। হেঁটে গ্রাম থেকে শহরে এতটা পথ অতিক্রম করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর মাইলস্টোন দেখে ইংরেজি, অঙ্কের সংখ্যা ওয়ান, টু, থ্রি শিখে ফেলেছিলেন। মা থাকতেন গ্রামের বাড়িতে। সেকালে আজকের মতো হোটেলও ছিল না। তাই কলকাতায় পিতার সঙ্গে থাকার সময় তাঁকে নিজেদের জন্য রান্নাও করতে হয়েছে। এরই মধ্যে লেখাপড়ায় বিঘ্ন হলে পিতা ঠাকুরদাস তাঁকে পিটুনিও দিতেন—বিদ্যাসাগর অবলীলায় আত্মজীবনীতে এসব কথা স্বীকার করেছেন। পিতা ঠাকুরদাস নিজের চাকরি সেরে রাত নয়টা নাগাদ বাসায় ফিরে যদি দেখতেন ঈশ্বরচন্দ্র ঘুমিয়ে পড়েছেন, তাহলে ঘুম থেকে ডেকে তুলে পড়তে বসাতেন। এমনকি শেষ রাতেও ঘুম থেকে তুলে পড়তে বসাতেন। পুত্রের প্রতি পিতার এই আগ্রহের ভালো ফল ফলেছিল।

বিদ্যাসাগরের পিতার ১০ সন্তান ছিল এবং তিনি খুব ধনী ছিলেন না। পিতার দারিদ্র্যের মধ্যেও বিদ্যাসাগর লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। অনেক সময়ই তিনি রাস্তায় দেওয়া সরকারি আলোতে (স্ট্রিটল্যাম্প) লেখাপড়া করেছেন।

ভাইয়ের বিয়েতে কলকাতায় কাজে ব্যস্ত থাকায় বিদ্যাসাগরের পক্ষে বীরসিংহ গ্রামে যাওয়া সম্ভবপর নয়। কিন্তু তাঁর মা চিঠি লিখেছেন, যেতেই হবে। মায়ের আহ্বান ফেলার নয়। বিলম্বে রওনা দেওয়ায় দামোদর নদে নৌকা পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি সাঁতরিয়ে দামোদর অতিক্রম করে মায়ের কথা রক্ষা করেন বলে কথিত আছে।

রেলস্টেশনে বড় ব্যাগ নিয়ে নেমে বিড়ম্বনায় পড়েছেন এক যুবক। কোনো কুলি নেই। একজন সাধারণ মানুষ সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন এবং গাড়ি অবধি ব্যাগ পৌঁছাতে সাহায্য করলেন। যুবকটি লোকটিকে কিছু টাকা দিতে চাইলে কোনোভাবেই তিনি তা নিলেন না। যুবকটি জানতে পারলেন, বিকেলে এক সভা হবে এবং সেখানে বিদ্যাসাগর মহাশয় অতিথি হিসেবে থাকবেন। বিদ্যাসাগরের বক্তৃতা শুনতে গিয়ে যুবকের চোখ তো ছানাবড়া! দুপুরের সাহায্যকারী ওই লোকই যে বিদ্যাসাগর, তিনি অতিথির আসনে বসে আছেন!

বিদ্যাসাগর যখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ, তখন কলেজের কাজে তিনি গেছেন কলেজ ইন্সপেক্টরের অফিসে। ইংরেজ ইন্সপেক্টর বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথা বলার সময় টেবিলে পা তুলে ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে অপমান করছিলেন। পরে সেই ইন্সপেক্টর কলেজ পরিদর্শনে আসেন সংস্কৃত কলেজে। অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকেই তো ইংরেজ ইন্সপেক্টরের চোখ চড়কগাছে! বিদ্যাসাগর টেবিলে খড়মসহ পা তুলে চেয়ারে বসে আছেন। ব্যাপার কী, জিজ্ঞেস করলে বিদ্যাসাগর উত্তর দেন: আমি ভেবেছিলাম, টেবিলে পা তুলে অভ্যর্থনা করা ইংরেজদের রীতি। আমি আপনাদের রীতিই অনুসরণ করেছিমাত্র। আচ্ছা করে জব্দ হয়েছিলেন সেই ইংরেজ ইন্সপেক্টর।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বিদ্যাসাগরের খুবই আন্তরিক বন্ধু। পিতা ত্যাজ্যপুত্র করায় বিদেশে অর্থের সংকটে পড়েন তিনি। এ সময় মধুসূদনকে অর্থ পাঠিয়েছেন বিদ্যাসাগর। ধর্মান্তরিত মধুসূদনকে অর্থ প্রদান করা দোষের, এ কথা কখনো তাঁর মনে হয়নি; বরং তিনি মনে করেছেন, মধুসূদনকে সাহায্য করার অর্থ হলো বাঙালির সন্তান ও বাংলা সাহিত্যকে প্রণোদনা দেওয়া।

সংস্কৃত কলেজে লেখাপড়ায় খুবই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু সেই কলেজে ইংরেজি ছিল না। কলেজ পাস করার পর বিদ্যাসাগর চাকরি পেয়ে যান ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। সেখানে ইংরেজি লাগে। কলেজ থেকে বলা হলো, ‘আপনি ইংরেজি ভাষাটি আরও একটু ভালো করে শিখুন।’ কোনো লজ্জা পেলেন না তিনি। রাতে গৃহশিক্ষক রেখে কলেজের শিক্ষক বিদ্যাসাগর ইংরেজিই শুধু শিখলেন না, হিন্দি ভাষাও শিখলেন। পরে এই দুই ভাষায় তিনি এতটাই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যে শেক্‌সপিয়ারের বই তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন, হিন্দি ভাষা থেকেও বই অনুবাদ করেন বাংলায়।

বিদ্যাসাগর দেখলেন, বাংলা শেখার বর্ণগুলো বেশ জটিল। ইংরেজ হ্যালহেড আর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের বর্ণগুলোকে তিনি সংস্কার করে বর্ণপরিচয় নামে বই লেখেন। এই বই পরে বাঙালির শিক্ষাবিস্তারের প্রাথমিক গ্রন্থে পরিণত হয়েছিল। আগে বাংলা গদ্যে যতিচিহ্ন ছিল না। বিদ্যাসাগর দেখলেন, বাংলা গদ্য খুবই অগোছানো। তিনি বাংলা গদ্যে যতিচিহ্ন সংযোজন ও আধুনিক করেন। নারীদের শিক্ষিত করার জন্য তাঁর চেষ্টার অন্ত ছিল না। তিনি বহু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিধবাদের আবার বিয়ে করার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নিজের একমাত্র ছেলে নারায়ণচন্দ্রকে বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন, বিধবা বিবাহ আন্দোলন তিনি লোকদেখানোর জন্য করেননি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সত্যি ছিলেন কর্মবীর। কীভাবে জীবন গড়ে তুলতে হয়, তিনি সে শিক্ষা রেখে গেছেন। সাহিত্য রচনা ও সমাজসংস্কারে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তার অনেকটাই ইতিহাস, কিছুটা কিংবদন্তি। এসব মিলেই বীরসিংহের বীর ছেলেটা—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাঙালির হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে আছেন।