আমের নাম ল্যাংড়া কেন

বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। তবে ‘প্রিয় ফল কোনটা,’ এ নিয়ে যদি ভোট হয়, নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে থাকবে আম। আমের গুণের শেষ নেই। রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদে আম অনন্য। জাতীয় ফলের মর্যাদা পাওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত আছে। প্রথম শর্ত হলো, সারা দেশের মানুষের কাছে ফলটি পরিচিত কি না, সাধারণ মানুষ এই ফলকে কি পছন্দ করে? এর উত্তর হ্যাঁ বলেই ধরে নেওয়া যায়। দ্বিতীয় শর্ত হলো, আশপাশের কোনো দেশ এই ফলকে জাতীয় ফল হিসেবে আগেই ঘোষণা করে বসে আছে কি না? প্রথম শর্তে আম পাস করলেও দ্বিতীয় শর্তে উতরে যেতে পারেনি।

ভারতের জাতীয় ফল আম। ১৯৫০ সালে আমকে জাতীয় ফলের মর্যাদা দিয়েছে ভারত। এ কারণেই বাংলাদেশের জাতীয় ফল কী হবে, এটা ঠিক করার সময় আম নিয়ে আলাপই করা হয়নি।

আম বাংলাদেশের জাতীয় ফল না হওয়ায় কোনো অসুবিধা হয়নি। ক্রমাগত আমের চাষ বেড়েছে। বেড়েছে ফলন। প্রতিবছর আমের নতুন জাতের উদ্ভাবন হচ্ছে। কী বাহারি সব জাত! কোনোটা দেখতে সুন্দর, কোনোটার ঘ্রাণে চারপাশ ম–ম করে, কোনোটা এমন হলুদ, চোখে পড়ে দূর থেকে।

নামকরণের দিক থেকে আম সর্বসেরা। আমগুলোর কত বাহারি নাম! কোনোটা ফুলের নাম বলে মনে হবে। কোনোটা আবার মিষ্টি সন্দেশ মনে হবে। খেলে হয়তো বোঝা যাবে আসলেই খুব মিষ্টি। আবার কোনটার সঙ্গে যুক্ত আছে ইংরেজের নাম। যেমন ধরা যাক ফজলি আম। এর নামকরণের পেছনে আছেন একজন ভারতীয় নারী এবং এক ইংরেজ।

সময়টা ১৮০০ সালের আশপাশে। মালদহের কালেক্টর র‌্যাভেন সাহেব ঘোড়া ছুটিয়ে গৌড়ের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে খুব পানির পিপাসা পেল। পিপাসায় প্রাণ যায় যায়। এমন সময় গ্রামের এক নারীর সঙ্গে দেখা। পিপাসায় কাতর হয়ে ওই নারীর কাছে পানি চান তিনি। পানির বদলে বাড়ির আঙ্গিনার গাছ থেকে আম পেড়ে কালেক্টরকে খেতে দেন সেই নারী। তাঁর নাম ফজলু বিবি। র‌্যাভেন সন্তুষ্ট হয়ে ফজলু বিবির নামে আমের নাম রেখে দেন। তখন থেকে এই আমের নাম হয়ে যায় ফজলি।

আমের মধ্যে বাহারি নাম হলো তোতাপারি, কেশর, রাতাউল, সিন্দুরা, কুয়াপাহাড়ি, চিনি মিছরি, জগৎমোহিনী, রাঙাগুড়ি, তোতাপুরি, মিশ্রিকান্ত, জালিবান্ধা, পাহাড়িয়া, গোলাপখাস, কাকাতুয়া, দাদভোগ, সূর্যপুরি, কাঁচামিঠা, কলামোচা, গোলাপবাস, কিষাণভোগ, বান্দিগুড়ি, রাংগোয়াই, ভাদুরিগুটি, ক্ষীরমন, দুধসর, রংভিলা, পারিজা, বেগমবাহার, পূজারিভোগ, পলকপুরি, রাজলক্ষ্মী, দুধকুমারী, শ্যামলতা, খাট্টাশে, জাওনা, দমমিছরি, মিছরিবসন্ত, মেসোভুলানি, ফুনিয়া, গোলাপবাস, বাতাসাভোগ, মোহনবাঁশি, পরানভোগ, বিড়া, কালিগুটি, পাকচারা, কালিয়াভোগ, দুধসর, কোহিতুর, কালিগুলি, বালিশা।

প্রতিটা আমের ধরনে পার্থক্য আছে। নামের ধরনে সবচেয়ে আলাদা ল্যাংড়া। আমের তো পা নেই। পায়ে সমস্যা থাকার তো প্রশ্নই আসে না। আর ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটারও তো উপায় নেই। এত পরিচিত, এত সুস্বাদু, দেখতে এত সুন্দর, তবু নাম ল্যাংড়া! কেমন করে এল ল্যাংড়া নাম?

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগের ঘটনা। শোনা যায়, ভারতের বিহারের এক ফকিরের বাড়ি থেকে সংগৃহিত চারাগাছ থেকে এই আমের সন্ধান পাওয়া যায়। ফকিরের বাড়ি ও এর চারপাশে প্রচুর আমগাছ ছিল। সেই ফকিরের পায়ে কিছু সমস্যা ছিল, যে কারণে তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। তাই নাম হয়ে যায় ল্যাংড়া। ল্যাংড়া আমের উৎপত্তি উত্তর প্রদেশের বারানসি থেকে। ল্যাংড়া আম যাঁর বাড়ি থেকে পাওয়া গেল, তিনি কি লালনের মতো ভাবগত ফকির ছিলেন? নাকি ফকির বলতে এখন যেমন বোঝায়, পেশাগতভাবে অন্যের দানের ওপর জীবন ধারণ করতেন সেই ব্যক্তি? যদি শুধু দান গ্রহণ করা পেশা হয়, তবে তাঁর বাড়ির চারপাশে এত আম ছিল কেন? তিনি বাগানই–বা করলেন কেন? এর উত্তর এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন।

তবে ল্যাংড়া খুব পরিচিত আম। পেকে গেলে ল্যাংড়া আমের রং থাকে উজ্জ্বল সবুজ। পাওয়া যায় জুন থেকে আগস্ট মাসে। খেতে খুব মিষ্টি। একসময় ভারতীয় উপমহাদেশের গবেষকেরা আমের প্রায় ১ হাজার ৬৫০টি জাতের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন। এখনো হাজার রকমের আম পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যে ৩০০ আমের জাত প্রচলিত। উপমহাদেশে প্রায় ১০০ জাতের আম ব্যাপকভাবে চাষ হয়। ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানে আমের চাষ বেশি।

ল্যাংড়া আম ভারতের বেনারসে উদ্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে সব জেলাতেই ল্যাংড়া আম জন্মে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ আর নাটোরে বেশি পাওয়া যায়। সাতক্ষীরার ল্যাংড়া আম স্বাদে ও মানে সেরা।

আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতের দক্ষিণ অংশ, মিয়ানমার ও আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রথম আমের চাষ শুরু হয়। প্রাচীনকালে সুস্বাদু ফলটি কতটা সুস্বাদু ছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদেরা লিখেছেন। ভারতীয় কবি কালিদাস আমের প্রশংসা করেছেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক দাবি করেছেন, বীর আলেকজান্ডার এবং বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ভারতে এসে আমের স্বাদ নেন। মনে করা হয়, ৬৩০ সালের কোনো এক সময় তিনি ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। সেকালে ভারতে রাজত্ব করতেন হর্ষবর্ধন। এ ছাড়া বিখ্যাত মোগল সম্রাট আকবর আমের বড় সমঝদার ছিলেন। ভারতের বিহারে দারভাঙ্গার লক্ষ্মীবাগে তিনি নাকি ১০ লাখ আমগাছ লাগিয়েছিলেন।

আমে নামে যত ইতিহাসই থাক, এর স্বাদ পেলে কোনো কিছুই আর মনে থাকে না। তবে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, আমে আছে ভিটামিন এ, সি ও ডি। আমের মৌসুম চলছে, ইচ্ছেমতো আম খেয়ে মুখ রঙিন করে ফেলুন। মজা তো পাবেনই, সঙ্গে পাবেন পুষ্টিও।