প্রশান্ত মহাসাগর এত বড় কেন
পৃথিবীতে অনেক সাগর ও মহাসাগর আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় জলরাশি প্রশান্ত মহাসাগর। এটি এত বড় যে চাঁদের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি চওড়া। প্রায় ১৬ কোটি ৩০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই মহাসাগর পৃথিবীর মোট পৃষ্ঠের ৩০ শতাংশের বেশি জায়গা দখল করে আছে। আরও মজার বিষয় হলো, পৃথিবীর সব কটি মহাদেশ একসঙ্গে মিলেও প্রশান্ত মহাসাগরের চেয়ে ছোট হবে। কিন্তু কেন এই মহাসাগর এত বিশাল?
আজকের প্রশান্ত মহাসাগরের জন্ম হয়েছে একটি প্রাচীন সুপার-মহাসাগর থেকে। এর নাম ছিল প্যান্থালাসা। কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে একটামাত্র মহাদেশ ছিল। সেই মহাদেশের নাম প্যানজিয়া। এই বিশাল মহাদেশের চারপাশে ছিল একটাই মহাসাগর—প্যান্থালাসা। বর্তমানে আমরা যে প্রশান্ত মহাসাগর দেখি, সেটি সেই আদি প্যান্থালাসারই অবশিষ্টাংশ।
তোমরা হয়তো জানো, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ কয়েকটি বিশাল শিলাখণ্ড দিয়ে তৈরি। এগুলোকে বলা হয় টেকটনিক প্লেট। এই প্লেটগুলো সারাক্ষণ নড়াচড়া করে। মাঝেমধ্যে একটি অন্যটির সঙ্গে ধাক্কা খায়। অনেক সময় এই ধাক্কার ফলে টেকটনিক প্লেট আলাদা হয়ে যায়। প্রায় ২৩ কোটি বছর আগে এমনই নড়াচড়ার কারণে প্যানজিয়া ভাঙতে শুরু করে। ফলে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, অ্যান্টার্কটিকা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আলাদা হতে শুরু করে আমেরিকা ও ইউরেশিয়া। এই মহাদেশগুলো যখন আলাদা হলো, তখন মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় জন্ম নিল আরেকটি মহাসাগর। সেটির নাম আটলান্টিক মহাসাগর। এই মহাসাগরটি প্রতিবছর প্রায় দুই থেকে তিন সেন্টিমিটার করে বড় হচ্ছে। শুনতে কম মনে হলেও লাখ লাখ বছর ধরে এভাবে বড় হলে অনেক বড় পরিবর্তন আসে। মানে লাখ লাখ বছরে এটি অনেক বড় হয়ে যায়।
এদিকে প্যানজিয়া মহাদেশ যতই আলাদা হচ্ছিল, প্যান্থালাসা ততই সংকুচিত হচ্ছিল। কিন্তু ২০ কোটি বছর আগে ঘটে এক বিশেষ ঘটনা। ফারালন, ফিনিক্স ও ইজানাগি নামে তিনটি টেকটনিক প্লেট একসঙ্গে মিলিত হওয়ার ফলে সেখানে জন্ম নেয় প্যাসিফিক প্লেট। এই নতুন প্লেট ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে এবং পুরোনো প্লেট তিনটিকে সরিয়ে দেয়। প্যাসিফিক প্লেট বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইজানাগি প্লেট চলে যায় এশিয়ার নিচে। ফারালন প্লেটের প্রায় পুরোটাই উত্তর আমেরিকার নিচে ঢুকে যায়। যদিও এর কিছু অংশ এখনো উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে রয়ে গেছে। আর ফিনিক্স প্লেট এখন শুধু দক্ষিণ আমেরিকা ও অ্যান্টার্কটিকার মাঝখানের ছোট্ট এক টুকরা হয়ে রয়ে গেছে।
প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশে দেখা যায় অসংখ্য আগ্নেয়গিরি আর ভূমিকম্প। এগুলো মিলে তৈরি করেছে ‘রিং অব ফায়ার’ বা ‘আগুনের বলয়’। যেসব জায়গায় মহাদেশীয় প্লেট সমুদ্রের প্লেটের নিচে ঢুকে যায়, সেখানেই এই ঘটনাগুলো ঘটে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় সাবডাকশন। প্যানজিয়া মহাদেশ যখন প্যান্থালাসার ওপর চাপ দিতে শুরু করল, তখনই তৈরি হলো এই আগুনের বলয়।
বর্তমানে প্রশান্ত মহাসাগর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাসাগর হলেও এটি ধীরে ধীরে ছোট হচ্ছে। আটলান্টিক মহাসাগর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগর হচ্ছে সংকুচিত। তবে এখনো আটলান্টিক মহাসাগর প্রশান্তের চেয়ে অনেক ছোট। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আরও দুই কোটি বছর পর আটলান্টিক আবার সংকুচিত হতে শুরু করবে।
প্রশান্ত মহাসাগর শুধু আকারেই বিশাল নয়। এটি পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি পানি ধারণ করে আছে। এর গভীরতাও সবচেয়ে বেশি। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের চ্যালেঞ্জার ডিপ নামে জায়গায় এর গভীরতা ১১ হাজার মিটারের বেশি।
আসলে প্রশান্ত মহাসাগর এক অনন্য সৃষ্টি। এর আকার, ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস আর জটিলতা মিলে এটি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক সমুদ্র অববাহিকা। প্রশান্ত মহাসাগরের বিশালতার পেছনে রয়েছে পৃথিবীর কোটি কোটি বছরের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস। প্রাচীন প্যান্থালাসার অবশিষ্টাংশ হিসেবে টিকে থাকা এই মহাসাগর আজও আমাদের গ্রহের জলবায়ু ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর বিশালতা কেবল একটি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং পৃথিবীর গতিশীল প্রকৃতির এক জীবন্ত প্রমাণ।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স