কালো কাকের কার্যকারিতা

স্কুলের বইয়ে ‘কাক’ রচনার শুরুটাও বেশ গৎবাঁধা। ‘কাকের রং কালো। প্রতিদিন সকালে ‘‘কা কা” রবে ডেকে আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে কাক। এটি ময়লা-আবর্জনা খেয়ে আমাদের পরিবেশ পরিষ্কার রাখে।’ আহা! কাক বেচারা যদি তাকে নিয়ে আমাদের লেখা এমন প্রশংসাময় রচনা পড়তে পারত, কে জানে, হয়তো কেঁদেই ফেলত আবেগে।

ভয় নেই। তোমাদের রচনা ওই কাকগুলো মোটেই পড়তে যাচ্ছে না। তবে রচনার কথাগুলো আরও একটু বাস্তবে রূপ দিতেই করা হচ্ছে কাককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা।

(বাঁ থেকে) বব স্পাইকম্যান, রুবেন ভ্যান ডের ভ্লেউতেন ও জশুয়া ক্লেইন

নেদারল্যান্ডসের দুজন ইঞ্জিনিয়ার রুবেন ভ্যান ডের ভ্লেউতেন ও বব স্পাইকম্যান লক্ষ করলেন, শহরের রাস্তায় সিগারেটের ফিল্টারের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটে আরেকটু ঘেঁটে তাঁরা জানতে পারলেন, গোটা বিশ্বে প্রতিবছর জমা হচ্ছে প্রায় ৪ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন সিগারেটের ফিল্টার। একেকটি ফিল্টার পুরোপুরি পচে পরিবেশে মিশে যেতে সময় লাগে প্রায় ১২ বছরেরও বেশি। এ ছাড়া এই বিপুল পরিমাণ ফিল্টার পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ বিষাক্ত করছে, নষ্ট করছে জীববৈচিত্র্য। সামান্য সিগারেট ফিল্টারের পেছনে এত ভয়াবহ ক্ষতির কথা জানতে পেরে তাঁরা দুজনেই খুঁজছিলেন এমন একটা সমাধান, যাতে সহজেই পরিবেশ থেকে সরিয়ে ফেলা যায় এগুলো। আর এই কাজ করতে হবে পরিবেশসম্মত কোনো পদ্ধতিতে। তাঁরা সারা শহরেই খুঁজতে থাকেন নানা রকম সমাধান।

ক্রাউডেড সিটিজের বানানো পরীক্ষামূলক ক্রো-বার

এরই মাঝে তাঁদের চোখে পড়ে সব ব্যস্ত শহরের এক অনবদ্য প্রাণী কাক। কালো রঙের এই কর্কশকণ্ঠী পাখিটির মস্তিষ্ক মানুষের বৃদ্ধাঙ্গুলির চেয়ে ছোট হলেও পায়রার থেকেও বেশি বুদ্ধিমান এরা। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা যায়, খাবারের বিনিময়ে কাক আট ধাপের নানা রকম পাজল সমাধান করতে সক্ষম। এ ছাড়া বিভিন্ন আকৃতিভিত্তিক পাজলেও কাক প্রাণিজগতের অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় বেশ এগিয়ে। তাই এবার শহর থেকে সিগারেট ফিল্টার সরাতে সেরা সমাধান হলো এই কাককেই একটু বুঝিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া আরকি।

যেই কথা সেই কাজ। দুই বন্ধু মিলে শুরু করেন ক্রাউডেড সিটিস নামের একটি প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন স্থানে বসানো হবে বিশেষভাবে বানানো এক কনটেইনার। তাঁরা এটির নাম দেন ক্রো-বার। ক্রো-বারের নিচের অংশে কোনো কাক যদি একটি সিগারেটের ফিল্টার ফেলে, তাহলে সেই বরাবর বসানো একটি স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরায় উপাদানটি সিগারেট ফিল্টার কি না, সেটি নিশ্চিত করা হয়। এরপরই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাটি যদি সিগারেটের ফিল্টারকে চিহ্নিত করতে পারে, তাহলে ক্রো-বারের ওপরের অংশে কাকটির জন্য উপহার হিসেবে ছোট খাবারের টুকরো জমা হবে। সিগারেটের ফিল্টারের পরিমাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে খাবারের টুকরোর পরিমাণ বাড়বে বা কমবে। ক্রাউডেড সিটিস প্রকল্প পরিচালকদের ধারণা, এভাবে খাবার উপহার দিলে ব্যস্ত শহরের কাকগুলো নিজেদের উদ্যোগেই চারপাশের সিগারেট ফিল্টারগুলো এনে জড়ো করবে এই ক্রো-বারের ভেতর। কাকের বুদ্ধিমত্তার ওপর ভরসা করে ধারণা করা হয়, অচিরেই একটি কাক তার চারপাশের সব কাককেই জানিয়ে দেবে এই ক্রো-বারের ব্যবহার। তাতে কম সময়েই যেকোনো শহরের সিগারেট ফিল্টার সংগ্রহ করে একটি সুন্দর প্রকৃতি গড়ে তুলতে পারে এই কাকেরা।

চিত্র ১: কাক একটি সিগারেট ফিল্টার ক্রো-বারে ফেললে একটি স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা সেটি সিগারেট ফিল্টার কি না তা নিশ্চিত করে।
চিত্র ২: স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরাটি সিগারেটের ফিল্টারের উপস্থিতি নিশ্চিত করলে ক্রো-বারের ওপরের অংশে কিছু খাবার জমা হয়।
চিত্র ৩: কাকটি খাবারের টুকরা নিয়ে চলে যায়। সে এটি অন্য কাকদের জানিয়ে দেয় নাকি বিষয়টি গোপন রাখে তা কিন্তু আমরা জানিনা!

তবে রাস্তার ধারে এখনো ক্রো-বার বসানো হয়ে ওঠেনি ক্রাউডেড সিটিসের সদস্যদের। কারণ, নেদারল্যান্ডসের প্রাণী নিরাপত্তা অধিদপ্তর এটাও নিশ্চিত করতে চায় যে সিগারেটের ফিল্টারের সংস্পর্শে এসে কাকদের আবার যেন ভয়াবহ রোগ না হয়ে যায়।

কাকদের দিয়ে এমন সংগ্রহের ধারণা কিন্তু পুরোটাই নতুন নয়। ২০০৮ সাল নাগাদ মার্কিন্ল্ল্ল উদ্ভাবক জশুয়া ক্লেইন প্রথম এই ধরনের আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি ‘টুমোরোস ল্যাব’ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে আরডুইনো সিস্টেম ব্যবহার করে ‘দ্য ক্রো বক্স’ নামে একটি বিশেষ ধরনের বাক্স বানান। এই বাক্সে কাক কয়েন জমা দিলে বাক্সটি কাককে উপহার হিসেবে বাদাম দিত। জশুয়ার বক্তব্য অনুসারে, পথচারীদের হারিয়ে যাওয়া মুদ্রা কিংবা ময়লার সঙ্গে হারানো মুদ্রাকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তোলার জন্য তাঁর এই উদ্ভাবন বিশেষভাবে উপযোগী। ‘দ্য ক্রো বক্স’-এর নকশা, আরডুইনো বোর্ডের নকশা ও আরডুইনো সফটওয়্যারটিও বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে এই ঠিকানায়: www.thecrowbox.com

কয়েন সংগ্রহের জন্য বানানো ‘দ্য ক্রো-বক্স’

সবকিছু ঠিক থাকলে সামান্য কিছু আর্থিক সহায়তা পেলেই ক্রো-বার ব্যবহার শুরু করবেন ক্রাউডেড সিটিস প্রকল্প পরিচালকেরা। তাই এবার থেকে কাক নিয়ে রচনা লিখতে গেলে একটু ঠিকঠাক প্রশংসাই করো ওদের। বলা তো যায় না, বুদ্ধি বেড়ে গিয়ে কবে আসলেই ওরা তোমার রচনা পড়ে খুশি হবে।

(কিশোর আলোর এপ্রিল ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত)