বিলুপ্তি থেকে কীভাবে ফিরে এল ডায়ার নেকড়ে

এই ছানাগুলোর মধ্যে দুটি ছেলে জন্ম নেয় ২০২৪ সালের ১ অক্টোবরছবি: ক্লসোল বায়োসায়েন্সেস

কিছু গবেষণায় বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হবে ৩০ শতাংশ প্রাণী। এই প্রাণীকে রক্ষা করতে আমাদেরকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রাণীর বিলুপ্তি ঠেকাতে বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে একটি হলো বিলুপ্ত প্রাণীকে প্রকৃতিতে ফিরিয়ে আনা। এই গবেষণায় সম্প্রতি দারুণ সাফল্য পাওয়া গেছে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক প্রজাতির নেকড়ে ফিরে এসেছে পৃথিবীতে। এই দুঃসাধ্য কাজটি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লসোল বায়োসায়েন্স নামে একটি বায়োটেক প্রতিষ্ঠান।

প্রাণীটি হলো ভয়ংকর প্রজাতির একটি নেকড়ে। যেটিকে বলা হচ্ছে ডায়ার নেকড়ে। প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বছর আগে এটি ছিল এক ধরনের বিশাল ও ভয়ংকর নেকড়ে। গত সাড়ে বারো হাজার বছর এই পৃথিবীতে এরা ছিল না। বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বহু বছর গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছেন এই প্রাণীকে ফিরিয়ে আনতে। এটিই বিশ্বের প্রথম সফল ডি-এক্সটিংকশন—অর্থাৎ, একবার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীকে আবার ফিরিয়ে আনার ঘটনা। এ সাফল্যের ঘোষণাটি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে অবস্থিত ক্লসোল বায়োসায়েন্সেস থেকে।

বিজ্ঞানীরা ডায়ার নেকড়ের প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ জিনোম তৈরি করেছেন। এরপর ধূসর নেকড়ের কোষে ২০টি জিন পরিবর্তন করে সেগুলো থেকে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এই ভ্রূণ বড় আকারের গৃহপালিত কুকুরের শরীরে স্থাপন করা হয়, যারা সারোগেট মা হিসেবে কাজ করেছে।

এই সাফল্য সম্ভব হয়েছে প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ, ক্লোনিং এবং জিন সম্পাদনার মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা ধূসর নেকড়ের জিনে ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করেছেন ডায়ার নেকড়ের মতো দেখতে ছানা। ধূসর নেকড়ে ডায়ার নেকড়ের জিনের সঙ্গে বেশি মিল থাকায় ধূসড় নেকড়ে বেছে নেওয়া হয়েছে। ফলে তৈরি হয়েছে এক ধরনের হাইব্রিড প্রজাতি, যা দেখতে এবং আচরণে অনেকটাই বিলুপ্ত প্রাণীটির মতো।

আরও পড়ুন

ডায়ার নেকড়ের একসময় উত্তর আমেরিকার শীতল প্রকৃতিতে ঘুরে বেড়াত। এরা ছিল কি-স্টোন প্রজাতি। মানে এরা এমন শিকারি প্রাণী, যারা সব শিকারির মধ্যে শীর্ষে। এরা এমন শিকারি, এদেরকে শিকার করার মতো কোনো প্রাণী একই বাস্তুতন্ত্রে নেই। যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের কি-স্টোন স্পেসিস। এটিকে অন্য কোনো প্রাণী শিকার করে না। ডায়ার নেকড়েকে ফিরিয়ে আনার পেছনে আছে জনপ্রিয় টিভি সিরিজ গেম অব থ্রোনস-এর সেই বিখ্যাত সাদা পশমওয়ালা নেকড়ে।

‘আমরা ক্রিসপার প্রযুক্তি দিয়ে ধূসর নেকড়ের জিন বাদ দিয়ে ডায়ার নেকড়ের বৈশিষ্ট্য বসিয়েছি। যদিও এই ছানাগুলোর জেনেটিক গঠন পুরোপুরি ডায়ার নেকড়ের মতো নয়, তবে তাদের চেহারা, গঠন এবং আচরণ অনেকটাই সেই বিলুপ্ত প্রজাতির কাছাকাছি।’
ক্লসোলের উপদেষ্টা ও জিন বিশেষজ্ঞ লাভ ডালেন

ক্লসোল বলেছে, ডায়ার নেকড়ে দেখতে ধূসর নেকড়ের চেয়ে বড়, মাথা চওড়া, পশম ঘন ও লম্বা এবং চোয়াল শক্তিশালী। ২০২১ সাল থেকে ক্লসোল ম্যামথ, ডোডো ও তাসমানিয়ান টাইগারকে ফিরিয়ে আনার প্রকল্পেও কাজ করছে। তবে ডায়ার নেকড়ে নিয়ে তাদের কাজ এতদিন গোপন ছিল।

ক্লসোলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী বেন ল্যাম জানিয়েছেন, তারা প্রায় ১৩ হাজার বছর পুরোনো একটি দাঁত ও ৭২ হাজার বছর পুরোনো একটি খুলি থেকে ডায়ার নেকড়ের ডিএনএ সংগ্রহ করেছেন। এই ডিএনএ ব্যবহার করে সুস্থ তিনটি ডায়ার নেকড়ের ছানা জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

আরও পড়ুন

এই তিনটি ছানা এখন একটি গোপন জায়গায় রাখা হয়েছে। জায়গাটি নিরাপদ রাখতে চারদিকে ১০ ফুট উঁচু দেয়াল তোলা হয়েছে। সেখানে সারাক্ষণ ড্রোন, ক্যামেরা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা নজরদারি করছেন। এই প্রকল্পটি যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরে নিবন্ধিত এবং আমেরিকান হিওউম্যান সোসাইটির স্বীকৃতি পেয়েছে।

বিজ্ঞানীরা ডায়ার নেকড়ের প্রাচীন ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ জিনোম তৈরি করেছেন। এরপর ধূসর নেকড়ের কোষে ২০টি জিন পরিবর্তন করে সেগুলো থেকে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এই ভ্রূণ বড় আকারের গৃহপালিত কুকুরের শরীরে স্থাপন করা হয়, যারা সারোগেট মা হিসেবে কাজ করেছে। এভাবেই জন্ম নেয় তিনটি ডায়ার নেকড়ের ছানা।

৫ মাস বয়সী ডায়ার নেকড়ে
ছবি: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস

এই ছানাগুলোর মধ্যে দুটি ছেলে জন্ম নেয় ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর এবং একটি মেয়ে জন্মায় ২০২৫ সালের ৩০ জানুয়ারি। ক্লসোলের উপদেষ্টা ও জিন বিশেষজ্ঞ লাভ ডালেন বলেন, ‘আমরা ক্রিসপার প্রযুক্তি দিয়ে ধূসর নেকড়ের জিন বাদ দিয়ে ডায়ার নেকড়ের বৈশিষ্ট্য বসিয়েছি। যদিও এই ছানাগুলোর জেনেটিক গঠন পুরোপুরি ডায়ার নেকড়ের মতো নয়, তবে তাদের চেহারা, গঠন এবং আচরণ অনেকটাই সেই বিলুপ্ত প্রজাতির কাছাকাছি।’

এই প্রকল্পের জন্য ক্লসোল এখন পর্যন্ত ৪৩৫ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে। তারা উলি ম্যামথ ফিরিয়ে আনার কাজও করছে, তবে সেটা কিছুটা ধীরে এগোচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২৮ সালের মধ্যে প্রথম উলি ম্যামথ জন্ম নেবে। ক্লসোলের একদল বিজ্ঞানী উলি ম্যামথ (Mammuthus primigenius) ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। উলি ম্যামথ বরফযুগে বাস করত। দেখতে লোমশ হাতির মতো এই ম্যামথ সর্বশেষ প্রায় চার হাজার বছর আগে মারা গেছে।

এখন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, কীভাবে ডায়ার নেকড়ে প্রকৃতিতে ফিরে আসে, তা দেখার জন্য। ক্লসোলের নেকড়ে ফিরিয়ে আনার ঘটনা প্রাণীর বিলুপ্তি ঠেকানোর সর্বশেষ পদক্ষেপ।

আরও পড়ুন