ইবনে বতুতা: বিশ্বাসী এক পর্যটক

ধর্মপ্রাণ পর্যটক | ইবনে বতুতার (১৩০৪-১৩৬৮ খ্রি.) আসল নাম মুহম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে বতুতা। মরক্কোর তানজিয়ারে জন্ম নেয়া এই পর্যটক ২৮ বছর ধরে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি সে সময়ের এশিয়া ও আফ্রিকার সব মুসলিম দেশে গিয়েছিলেন। তার ভ্রমণের বেশিরভাগই ছিল  বণিকদের সঙ্গে।
শুরুর আগে... | ইসলামিক আইন, সাহিত্য আর ধর্ম নিয়ে নিজ দেশ মরক্কোতে পড়ালেখা শেষে ইবনে বতুতা মক্কায় হজ করার সিদ্ধান্ত নেন।  ১৩২৫ সালে তানজিয়ার থেকে মক্কার পথে রওনা হয়েছিলেন ইবনে বতুতা। কিছু সময়ের জন্য ত্রিপোলিতে (বর্তমানে লিবিয়ায়) থেমে বিয়ে করেছিলেন তিনি। এরপর মিসরে পৌঁছে পুরো বিশ্ব ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নেন।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন ইবনে বতুতা। দেখলেন, বিশাল এক পাখির পিঠে চড়ে এশিয়ার ওপর দিয়ে উড়ছেন। মিসরে এক বাড়ির ছাদে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে এ স্বপ্ন দেখেছিলেন ইবনে বতুতা। সেদিন ঘুম থেকে জেগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানোর কাজই বেছে নেবেন। কোনো পথ একবারের বেশি মাড়াবেন না বলেও শপথ নিলেন।

এরপর প্রথমেই হজযাত্রীদের সঙ্গে মক্কায় গিয়ে পবিত্র হজ সম্পন্ন করলেন ইবনে বতুতা। সব ধর্মীয় আচার-আচরণ শেষে অসংখ্য হাজির সঙ্গেই মক্কা ছাড়লেন তিনি। তখন তাঁর গায়েও অন্য হাজিদের মতোই ধবধবে সাদা পোশাক। ভিড়ের মধ্যে কাউকেই আর আলাদা করে চেনা যায় না। ধু ধু মরুভূমির মধ্য দিয়ে তাঁরা পথ চলছিলেন। দিনের প্রখর রোদ থেকে বাঁচতে তাঁদের দলটি সূর্য ডোবার পর সামনে এগোচ্ছিল। রাতের অন্ধকারে পথ খুঁজে পেতে লাঠির মাথায় আগুন জ্বেলে নিয়েছিলেন তাঁরা।

শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ঘুরে দেখার ইচ্ছা ছিল ইবনে বতুতার। তবে এক বছরের মাথায় তিনি মত পরিবর্তন করে মক্কায় পড়ালেখা করতে ফিরে আসেন।

চার বছর পর, ইবনে বতুতা আবারও যখন ভ্রমণ শুরু করলেন, তখন তিনি আর তরুণ হাজি নন, রীতিমতো এক মুসলিম পণ্ডিত। এবার শুধু কৌতূহলে ভর করে এদিক-সেদিক ভ্রমণ করতে চাইলেন না। তিনি শুনেছিলেন, ভারতের দিল্লির সুলতান মোহাম্মদ ইবনে তুঘলক মুসলিম পণ্ডিতদের ব্যাপারে উদারহস্ত। তাই ইবনে বতুতা ভাবলেন, একবার ভারতে পৌঁছাতে পারলে তিনিও হয়তো সুলতানের অনুগ্রহ পেতে পারেন। তাতে বেশ শান্তিতেই ধর্মকর্ম পালন করতে পারবেন তিনি।

এটি ভেবেই ১৩৩২ সালে ইবনে বতুতা ভারতের দিকে রওনা হলেন। ভারতের পাঞ্জাবে এসে তিনি মূল দলের লোকজনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। এরপর তাঁদের দলে আর মাত্র ২১ জন বাকি রইল। সে সময় ওই এলাকা ছিল ডাকাতদের জন্য কুখ্যাত। বালিয়ারির মধ্যে ডাকাতেরা খুব সহজেই ওত পেতে থাকতে পারত। আবার ডাকাতি শেষে শুকনো নদীর মধ্যে দিয়ে পালিয়ে যাওয়াও তাদের পক্ষে সহজ।

ওই যাত্রাপথে কয়েক দিন পরেই ডাকাতের খপ্পরে পড়লেন ইবনে বতুতা আর তাঁর দল। দুই ঘোড়সওয়ারের নেতৃত্বে ৮০ জন ডাকাত ধারালো তলোয়ার আর তির-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করে বসল। তবে কাফেলার লোকজন পালিয়ে না গিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করলেন ডাকাত দলের সঙ্গে। এমনকি তাঁদের হাতে ১৩ আক্রমণকারী মারা পড়ল। সবকিছু শান্ত হলে তাঁরা খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন, ইবনে বতুতা আর তাঁর ঘোড়া তিরবিদ্ধ হয়েছে। সেদিন মধ্যরাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে পাশেই এক দুর্গে বিশ্রাম নিতে আশ্রয় নিলেন ভীষণ ক্লান্ত আর অবসন্ন যাত্রীরা। পরদিন ভোরের সূর্যের আলোয় তাঁরা ভয়াবহ সেই যুদ্ধক্ষেত্রে ১৩ ডাকাতের মুণ্ডু দেখতে পেলেন।

এসব কারণে দিল্লিতে পৌঁছাতে প্রায় দুই বছর লেগে গেল ইবনে বতুতার। তবে রাজপ্রাসাদে পৌঁছাতেই প্রথমে সুলতানের নিষ্ঠুর চরিত্রের এক দিক চোখে পড়ল তাঁর। প্রাসাদের সব দিকের দরজায় সুলতানের নির্দেশ পালনের জন্য জল্লাদ বসে। তাদের কাছে জানা গেল, সুলতান কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিলে (সেটি নাকি তিনি মাঝেমধ্যেই করেন) সেটি সঙ্গে সঙ্গেই পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর অপরাধীর লাশ প্রাসাদের দরজার পাশেই ফেলে রাখা হয়।

মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার জন্য প্রাসাদের বিশাল দরজা খুলে দেওয়া হলো। তিনি বিশালদেহী প্রহরী আর ময়ূরের পালক লাগানো পোশাক পরা সুলতানের কর্মকর্তাদের পেরিয়ে আস্তে আস্তে সুলতানের দরবারে হাজির হলেন।

চমৎকারভাবে অলংকৃত বাঁকানো ছাদ থেকে  হাজারো পিলার নেমে এসেছে সুলতানের দরবারে। দরবারের চারদিকের দেয়ালের কাছে অন্তত ৫০টি বিশাল হাতি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি। হাতির সামনে ৬০টি ঘোড়া। এদের সামনে আবার সুলতানের সেনাবাহিনীর যোদ্ধারা। এরপর সুলতানের চাকর আর কর্মকর্তাদের ভিড়। দরবারের ঠিক মাঝখানে বসেছিলেন সুলতান।

ইবনে বতুতা শিগগিরই বুঝতে পারলেন, সুলতান সম্পর্কে তিনি যা শুনেছিলেন, তা সত্যি। সুলতান আসলেই উদার মনের মানুষ। তাই ইবনে বতুতাকে হতাশ হতে হলো না। তাঁকে দিল্লির কাজি নিযুক্ত করলেন সুলতান। এ ছাড়া তাঁর জন্য বিশাল অঙ্কের পেনশনও মঞ্জুর করলেন, যাতে তিনি আরাম-আয়েশে থাকতে পারেন।

অবিশ্বাস্য ভ্রমণ | প্রথমবার ভ্রমণে (১৩২৫-৩৪) ইবনে বতুতা উত্তর আফ্রিকা- আরবে গিয়েছিলেন। পারস্য (ইরান) হয়ে দক্ষিণে সবচেয়ে দূরের মঙ্গোলিয়ার কাছে গোল্ডেন হর্ডে (বর্তমানে রাশিয়ার অন্তর্গত) এবং ভারতেও গিয়েছিলেন সেবার। অন্যান্য ভ্রমণে তিনি মালদ্বীপ, সিলন (শ্রীলঙ্কা), সুমাত্রা, চীন, স্পেন, সাহারা মরুভূমি ও পশ্চিম আফ্রিকায় গিয়েছিলেন। সব   মিলিয়ে তিনি এক লাখ কিলোমিটার (৬২ হাজার মাইল) পথ পাড়ি দিয়েছিলেন।

কিন্তু অত বড় রাজকীয় পদ পেয়েও ইবনে বতুতা মোটেও নিরাপদ বোধ করছিলেন না। কারণ, সুলতানের মন আবহাওয়ার মতোই পরিবর্তনশীল আর খেয়ালি। তাঁর মেজাজও কিংবদন্তিতুল্য। একবার কোনো এক কারণে ভীষণ অপমানিত বোধ করায় এই সুলতান দিল্লি থেকে সবাইকে তাড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীকে। এ ধরনের আরও কয়েকটি ঘটনার কারণে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ শব্দবন্ধটি স্থান পেয়েছে বাংলা প্রবাদে।

একদিন ইবনে বতুতাও সুলতানের নেক নজর থেকে বঞ্চিত হলেন। বতুতাকে দরবারে ডেকে পাঠালেন তিনি। সুলতানের চার চাকরের পাহারায় দরবারে গেলেন ইবনে বতুতা। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে তিনি ধর্মকর্মে মন দিলেন। রোজা রাখলেন, কোরআন পড়লেন।

এতে সুলতানের মন দ্রবীভূত হলো। ইবনে বতুতাকে পুরস্কৃত করে রাজদূত হিসেবে চীনে পাঠালেন সুলতান।

তাই ১৩৪২ সালে ইবনে বতুতা আবারও ভ্রমণ শুরু করলেন। দিল্লিতে পৌঁছার প্রায় আট বছর পর তিনি চীনের পথে রওনা হয়েছিলেন। তবে সেবার দিল্লি ছাড়ার তিন দিনের মাথায় ডাকাতের আক্রমণের শিকার হলেন তিনি।

ঘোড়ায় চড়ে পালানোর চেষ্টা করলেন ইবনে বতুতা। কিন্তু এবার তাঁর ভাগ্য সহায় হলো না। তাঁর সঙ্গীরাও বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়লেন। ৪০ ডাকাত তাঁকে ঘিরে ফেলায় পালানোর কোনো পথই রইল না। ঘোড়া থেকে নেমে আত্মসমর্পণ করলেন ইবনে বতুতা।

ডাকাতেরা তাঁর সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাঁকে বন্দী করল। কয়েক ঘণ্টা পরই ইবনে বতুতা বুঝতে পারলেন, তাঁকে হত্যা করা হবে। তবে কিছুক্ষণ পরই ডাকাত দলের একজন তাঁর প্রতি করুণা করে তাঁকে ছেড়ে দিল।

ইবনে বতুতা মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেলেও বৈরী আর শত্রুভাবাপন্ন দেশে একা হয়ে গেলেন। অনেকটা পলাতক    হিসেবে দিন যাপন করতে লাগলেন। প্রায় এক সপ্তাহ পরে বন্ধুদের দেখা পেলেন। তবে তাঁরা কেউই তাঁকে চিনতে পারলেন না। নিজের ঘোড়া আর চমৎকার পোশাক হারিয়েছেন। তাঁর হাত-পা কাঁটার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। ভ্রমণের শুরুতেই এ রকম খারাপ একটা ঘটনার জন্য তাঁর বন্ধুরা তাঁকে দিল্লিতে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু ইবনে বতুতা নাছোড়বান্দা। তিনি দিল্লিতে না ফিরে চীনের পথেই চলতে লাগলেন।

এর পর...

ইবনে বতুতা দীর্ঘদিন বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি দুবার জাহাজডুবির কবলে পড়েছেন, সিরিয়ায় একবার ভয়াবহ প্লেগ রোগ থেকে বেঁচে ফিরেছেন, চলার পথে সাহারা মরুভূমিতে প্রচণ্ড তুষারঝড়ের সঙ্গেও মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। ৬৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তিনি সারা জীবনে যে পরিমাণ পথ পাড়ি দিয়েছেন, তা পৃথিবীকে তিনবার ঘুরে আসার সমান।