মিসরীয় যে মমির সঙ্গী ছিল বই

আনির হৃদয় একটি সূক্ষ্ম পাখির পালকের থেকেও হালকা হবে

হাজার বছর ধরে সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে মিসরীয় এক বণিক আনির মৃতদেহ। আনির সমাধিতে মমির সঙ্গে ছিল একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। এই পাণ্ডুলিপি পরে ‘মৃতদের বই’ বা ‘বুক অব দ্য ডেড’ নামে পরিচিত হয়। আরও কিছু প্রাচীন মিসরীয় সমাধি থেকে এমন কিছু পুঁথি উদ্ধার করা হয়েছে। আনির সমাধি থেকে উদ্ধার করা পুঁথি ইংরেজিতে অনুবাদও করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সমাধিস্থ করা হয়েছিল এই পুঁথি?

মৃত্যুর কথা স্মরণ করলে অনেকের মনে ভয় জাগে। কারও হয়তো অনুতাপ হয়। মৃত্যু মানুষের মনে যেমন ভীতি জাগায়, তেমনি কৌতূহল সৃষ্টি করে। যুগ যুগ ধরে মানুষের মৃত্যুকে ঘিরে অনেক বিশ্বাস আর ‘মিথ’ গড়ে উঠেছে। ইতিহাসের কিছু চমকপ্রদ পৌরাণিক তত্ত্বের হদিস পাওয়া যায় প্রাচীন মিসরে। ‘বুক অব দ্য ডেড’ তেমনই হাজার বছর পুরোনো মানুষের কল্পনা কিংবা বিশ্বাসের এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত। ব্যবসায়ী আনির সমাধি থেকে পাওয়া পুঁথি থেকে জানা যায়, মৃত্যু–পরবর্তী কাল্পনিক যাত্রা সম্পর্কে।

কেমন করে তৈরি হলো আনির মমি

মিসরীয় পুরোহিতদের প্রায় দুই মাস সময় লেগে গিয়েছিল আনির মৃতদেহকে মমি করতে। মমি করার প্রক্রিয়াতে মৃতদেহের ভেতর থেকে সব অঙ্গ বের করে আনা হলেও হৃৎপিণ্ড অক্ষত রাখা হয়। মিসরীয়দের বিশ্বাস ছিল, হৃৎপিণ্ড মৃত্যু–পরবর্তী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হৃৎপিণ্ডকে একধরনের পবিত্র তাবিজ দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হতো। জাদুমন্ত্র পড়ে লিনেন কাপড়ে আনির মৃতদেহ সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রথম দিকে শুধু ‘ফারাও’ মানে রাজাদের মৃতদেহ মমি করা হলেও সময়ের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন

মমি হওয়ার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল, পরপারে গিয়ে অমরত্ব লাভ করার আকাঙ্ক্ষা। মমি করা দেহে আত্মা ফিরে আসতে সক্ষম বলেই বিশ্বাস ছিল মিসরীয়দের। কিন্তু মমিকৃত হলেই অমরত্ব লাভ করা যায় না! কাঙ্ক্ষিত অমরত্বের দেখা পেতে হলে মুখোমুখি হতে হবে হরেক রকম বাধাবিপত্তির। সাপরূপী দেবতা আপেপ, ভয়ংকর কুমির আর আগুনের নদী আনির আত্মা গিলে ফেলার অপেক্ষায় আছে। এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য আনি নিজের মমির সঙ্গে বিশেষ এক পুঁথি রাখার বন্দোবস্ত করে গিয়েছিলেন। এই বিশেষ পুঁথি হলো ‘বুক অব দ্য ডেড’। সেই পুঁথিতেই রয়েছে প্রয়োজনীয় জাদুমন্ত্র। যেসব মন্ত্র দিয়ে নিজেকে রক্ষা করবেন আনি।

মমির সঙ্গে দেওয়া হলো পুঁথি

তখনকার দিনে কিছু বিত্তবানের কপালেই জুটত এই বিশেষ পুঁথি। বিশেষ পুঁথির জোরে আগুনের নদী পেরিয়ে, দেবতা আপেপকে টপকে আনি পৌঁছে যাবেন দেবী মা’আতের সামনে। এমনই ভাবা হতো। দেবী মা’আত আনির পরীক্ষা নেওয়ার জন্য ৪২ জন দেবতাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। আনিকে প্রত্যেক দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের নাম উচ্চারণ করতে হবে। এরপর প্রত্যেক দেবতার কাছে একটি করে পাপ উল্লেখ করতে হবে, যা থেকে সে বিরত ছিল। আনি নিজেকে পাপমুক্ত দাবি করলেও তিনি পাপমুক্ত নন। আর এখানেই কাজ করবে তাবিজ। সেই তাবিজে লেখা ছিল, ‘আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকো’। এরপর আনির হৃৎপিণ্ড একটি দাঁড়িপাল্লায় বসানো হবে।

আরও পড়ুন

যদি আনির হৃৎপিণ্ড একটি পাখির পালক থেকে ভারী হয়, তবে আনির আত্মাকে এক অদ্ভুত প্রাণী গিলে খাবে। আনির আর অমরত্ব লাভ করা হবে না। কিন্তু আনির কপাল ভালো হলে নিজের হৃদয়ের পবিত্রতা প্রমাণ করতে পারবেন। আনির হৃদয় একটি সূক্ষ্ম পাখির পালকের থেকেও হালকা হবে! এরপর সূর্যদেবতা আনিকে নিয়ে হাজির করবেন দেবতা ওসাইরাসের সামনে। ওসাইরাসের অনুমতি পেলে আনি নিজের পিতা–মাতার আবার দেখা পাবেন। এরপর স্বর্গে পৌঁছাবেন আনি। পৃথিবীতেও আনিকে অন্যদের মতো এক বিঘা জমিতে ফসল ফলাতে হবে। আনিকে সাহায্য করবে সমাধিতে থাকা এক পুতুল।

মমি হওয়া আনির মতো প্রাচীন মিসরের পৌরাণিক বিশ্বাস ছিল এমনই। মমি থেকে পাওয়া পুঁথি তাই ঐতিহাসিক।