একটি ক্যাম্প ডায়েরি

ছবি: সৈয়দ আমীর হায়দার

২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

স্কাউটদের উপস্থিতিতে মুখরিত বাহাদুরপুর রোভার পল্লি। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ স্কাউটস আয়োজিত ‘১৪তম আঞ্চলিক স্কাউট সমাবেশ’ চলবে এখানে। আজ একটি বিশেষ দিন। ১৬১ বছর আগে এই দিনে জন্ম নেন স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ব্যাডেন পাওয়েল।

ক্যাম্পকে বলা যায় স্কাউটদের জন্য একটা পরীক্ষাগার। স্কাউটিং করা, ট্রুপ মিটিং (স্কাউট ক্লাস) পরিচালনাসহ কার কেমন দক্ষতা তার পরীক্ষা হয় ক্যাম্পে। তবে অন্যান্য ‘পরীক্ষা’র মতো বিরক্তিকর নয় এটা। বরং সারা বছরের একঘেয়েমি কাটতে জুড়ি নেই ক্যাম্পের।

অন্য সদস্যদের আগেই ক্যাম্পে আসতে হয় সার্ভিসদের (স্বেচ্ছাসেবক)। ক্যাম্প এলাকা পর্যবেক্ষণ, তাঁবু বসানো, হাই রুট তৈরি করার কাজগুলো করতে হয় তাঁদেরই।

আর ক্যাম্প চলাকালে সার্ভিসদের কাজ হলো বিভিন্ন ইভেন্টে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা, স্কাউট হাসপাতালের কর্মী কিংবা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা। রাত জেগে তাঁবু এলাকা পাহারা দেওয়া, কারও কোনো সমস্যা হলো কি না, সেদিকে নজর রাখা।

সার্ভিসরা এই ক্যাম্পের নাম দিয়েছেন ‘ফাটাফাটি’। সব সময়ই ছোটাছুটি করতে হয় সাইট অপারেশনের সার্ভিসদের। কোথাও লাইট ফেটে যায় তো কোথাও পানির ট্যাপ। দিনে কম করে হলেও ১৫ থেকে ১৬টি লাইট, পানির ট্যাপ ফাটে বলেই এই নাম—ফাটাফাটি ক্যাম্প। আসলে ক্যাম্পে আসা নতুন স্কাউটদের হাতে পড়ে প্রায়ই সমস্যা তৈরি করত অস্থায়ীভাবে বসানো এসব জিনিস।

শুরুতে সব স্কাউট দল রিপোর্ট করে যার যার তাঁবুতে চলে যায়। প্রথম দিন সবার কাজ হলো নিজ তাঁবু এলাকাটি সুন্দরমতো গোছানো। পরবর্তী পাঁচ-ছয় দিন তো এই তাঁবুই তাদের ঠিকানা।

আটজনের একেকটা দল—কেউ ব্যস্ত চুলা তৈরিতে, কারও দায়িত্ব রান্নাবান্নার। কেউ বসে পড়ল তাঁবু ঠিক করতে।

বিকেলে উদ্বোধন। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, ক্যাম্প চিফের মতো সম্মানিত ব্যক্তিরা ক্যাম্পের উপকারিতা, স্কাউটিংয়ের লক্ষ্য নিয়ে কথা বলেন।

প্রথম দিনের কাজ এ পর্যন্তই। রাতে নিজেদের রান্না করা খাবার খায় সবাই। এ সময়টা যে কী আনন্দের, পিকনিকও হার মানে। সারা দিনের পরিশ্রমের পর খাওয়া—খারাপ হলেও লাগে অমৃতের মতো।

রাত ১০টায় সবার ঘুমানোর কথা। কিন্তু তাঁবু গোছানোর কাজ শেষ করতে করতে রাত তিনটা বা চারটা বেজে যায়। অনেকে না ঘুমিয়ে পরের দিনের কাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে নেন।

পুরো ক্যাম্পটাকে আটটি সাব ক্যাম্পে ভাগ করা হয়। একেকটা সাব ক্যাম্পের একেকরকম চ্যালেঞ্জ। তবে সকালের প্রথম দুটো চ্যালেঞ্জ এবং শেষ চ্যালেঞ্জ সবার একসঙ্গে শুরু হয়।

এরোবিক্স—এই ইভেন্ট শুরু হয় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। স্কাউটরা মাঠে জড়ো হয়ে পিটি করেন বাদ্যের তালে তালে।

এরোবিক্স শেষে সকালের নাশতা। এরপরই শুরু তাঁবু এলাকা পর্যবেক্ষণ। এই চ্যালেঞ্জের নাম ‘তাঁবুকলা’। একজন পর্যবেক্ষক এসে তাঁবু এলাকা প্রদক্ষিণ করেন। যাঁর তাঁবু এলাকা যত সুন্দর, তিনি পাবেন বেশি নম্বর। স্কাউটদের প্যারেডের দক্ষতার ওপরও নম্বর থাকে।

এরপর শুরু হবে ওই দিনের উদ্বোধন। যেখানে তাঁবুকলার বিজয়ীদের দেওয়া হয় বিজয় পতাকা।

এরপর যার যার সাব ক্যাম্প অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ শুরু হয়। বাকি চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সাধারণ জ্ঞান, পাইওনিয়ারিং, ফার্স্টএইড, ট্রুপ মিটিং, অনুমান, কোড অ্যান্ড সাইফার, হাইকিং, অবস্ট্যাকল, ফানি ম্যাচ, ক্যাম্প ফায়ার ইত্যাদি।

সবচেয়ে মজার চ্যালেঞ্জ হলো হাইকিং। কম্পাস আর ফিল্ড বুকের সাহায্যে নিজেদের গন্তব্যস্থান খুঁজে বের করতে হয় স্কাউটদের। কী যে আনন্দ! ক্যাম্পে হাইকিং ছিল ১৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে অনুমান আর কোড অ্যান্ড সাইফার চ্যালেঞ্জগুলোও হয়ে যায়। আর কম্পাস দিয়ে রাস্তা খোঁজার সময় একেকটা রোমাঞ্চকর স্থান অতিক্রম করা তো আরও আনন্দের!

অবস্ট্যাকলটাও কম মজার নয়। কমান্ডো ব্রিজ, স্পাইডার ব্রিজ, টারজান রোপের মতো নানা রকম শারীরিক কসরত করতে হয় এখানে।

আর ফানি ম্যাচের নাম শুনেই তো বোঝা যায় এটা কত ‘ফানি’। পানিতে ভিজে, রং মেখে একেকজনের যা অবস্থা হয়, হাসি চেপে রাখা অসম্ভব।

সেই সঙ্গে আছে ক্যাম্প ফায়ার। সারা দিনের খাটাখাটনির পর এই চ্যালেঞ্জটা সব সাব ক্যাম্পে একসঙ্গে হয়। সেখান থেকে নাচ, গান, নাটক ইত্যাদির জন্য সদস্য বাছাই করা হয় গ্র্যান্ড ক্যাম্প ফায়ারের জন্য।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। ক্যাম্পের চতুর্থ দিন। আকাশে গুড়গুড় মেঘের গর্জন। বৃষ্টি আসবে নিশ্চিত।

২৬ ফেব্রুয়ারি গ্র্যান্ড ক্যাম্প ফায়ার। ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে কবে ছাড়া হবে, এ নিয়ে সাইট অপারেশনের কিছু সার্ভিস কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসল। সাধারণত দলগুলোকে ছাড়া হয় গ্র্যান্ড ক্যাম্প ফায়ারের পরের দিন সকালে। কিছুক্ষণ পর আকাশের অবস্থা ভালো দেখে সবাই মোটামুটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।

কিন্তু বিপত্তি ঘটে রাত ১১টায়। সব সিকিউরিটি সার্ভিস এবং সাইট অপারেশনের সার্ভিস ক্যাম্পের বাজারে। এমন সময় পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। নিস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো এলাকা। বাহাদুরপুরের ওই এলাকাটা সন্ধ্যার পর জনশূন্য হয়ে যায়। সেখানে কিছু ভৌতিক ঘটনাও ঘটেছে বলে গুজব আছে। ফলে ভয় পেয়ে যান সবাই।

ছবি: সৈয়দ আমীর হায়দার

ঘুটঘুটে অন্ধকারে সার্ভিসরা তখনো বুঝতে পারেননি যে কী হচ্ছে। খানিক বাদে শুরু হলো ঝোড়ো হাওয়া। আশপাশের সব তাঁবুর স্কাউটরা বিচলিত হয়ে পড়েন। সব সার্ভিস ওয়াকিটকির মাধ্যমে অন্যান্য স্থানে অবস্থানরত সার্ভিসদের জানিয়ে দিলেন সব তাঁবুতে গিয়ে দলগুলোকে সতর্ক করে দিতে। যেন সবাই নিজেদের তাঁবু ঠিক রাখতে পারেন।

বৃষ্টি তখনো শুরু হয়নি। শোনা গেল, বাতাসে আটটি তাঁবু উড়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সার্ভিসরা দেরি না করে চলে যান তাঁবু ঠিক করতে। হঠাৎ শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। কিন্তু স্কাউটরা তো দমে থাকার নয়। বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের সব সার্ভিস দায়িত্ব ভালোভাবে সম্পন্ন করেন।

বৃষ্টি চলে সকাল ছয়টা পর্যন্ত। এই ছয়টা পর্যন্ত সার্ভিসরা পুরো ক্যাম্প এলাকা টহল দেন যাতে করে কারও বিপদ হলে এগিয়ে যেতে পারেন। পরে আরও চারটি তাঁবুর করুণ অবস্থা হয়, যা সার্ভিসরা খুব দক্ষতার সঙ্গে ঠিক করে দেন।

বলতে গেলে ভয়ংকর এবং রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির মধ্যে পার হয় একটি রাত।

২৬ ফেব্রুয়ারি ঝড়-বৃষ্টি প্রতিরোধের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

রাতে গ্র্যান্ড ক্যাম্প ফায়ার, সমাপনী অনুষ্ঠান। কিন্তু আবার ঝড়-বৃষ্টি। পণ্ড হয়ে যায় ক্যাম্প ফায়ার। তবে এবারের বৃষ্টি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তখন থেকেই ক্যাম্পে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্যাম্প এলাকা ছাড়তে বলা হয়। যদিও ক্যাম্প এলাকা ছাড়ার কথা পরের দিন অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে। তবে পরিবেশ প্রতিকূলে দেখে আগেই অনুমতি পেয়ে যায় দলগুলো।

সারারাত থেকে পরের দিন বিকেল পর্যন্ত সময় লাগে দলগুলোর তাঁবু এলাকা ছাড়তে।

এরপর বাকি থাকে তাঁবু গোছানোর কাজ। তার জন্য সাইট অপারেশনের সার্ভিসরা ক্যাম্প শেষ হওয়া সত্ত্বেও বাড়ি ফিরতে পারেন না। দুই থেকে তিন দিন পর তাঁরা বাড়ি ফেরেন। অথচ এই সার্ভিসরাই ক্যাম্পে আসেন সবার আগে। প্রায় এক মাস পর বাড়ি ফিরতে পেরে নিশ্চয়ই তাঁদের খুব আনন্দ হয়!

তবু ক্যাম্পের দিনগুলোর জন্যও মন কেঁদে ওঠে। কত স্মৃতি আর কতজনের সঙ্গে পরিচয়। কিন্তু এই ক্যাম্পই শেষ নয়। অজানা কিছু নিয়েই অপেক্ষা করছে আরও অনেক ক্যাম্প।

(কিশোর আলোর মে ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত)