কতক্ষণ তুমি স্ক্রিনের সামনে থাকবে

অলংকরণ: আরাফাত করিম

তাঁকে বলা হয় সেলফোনের জনক। মানে সহজ ভাষায় বলতে পারি, মোবাইল ফোনের আবিষ্কারক। নাম তাঁর মার্টিন কুপার। মোবাইল ফোনের জনক বলেছেন, বেশি বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করা উচিত নয়। বিবিসির সঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন একটা অনুষ্ঠানে। তাঁকে প্রশ্নকর্তা বললেন, ‘আমি তো দিনে পাঁচ ঘণ্টা স্মার্টফোনে থাকি।’ শুনে মার্টিন কুপার বললেন, ‘যাহ, সত্যি নাকি!’ হাসিতে ফেটে পড়লেন কুপার। বললেন, ‘সত্যি আপনি পাঁচ ঘণ্টা ফোন নিয়ে থাকেন? আপনাকে আমি বলব, জীবনে ফিরে আসুন।’

মার্টিন কুপার নিজে এক ঘণ্টার বেশি মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না।

মার্টিন কুপারের জন্ম ১৯২৮ সালে, আমেরিকার শিকাগোর ইলিনয়ে। তিনি ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি প্রথম সবার সামনে নিজের তৈরি মুঠোফোন ব্যবহার করে দেখান।

এখন মার্টিন কুপারের বয়স ৯৩। তিনি উপদেশ দিচ্ছেন, আমাদের স্মার্টফোন কম কম ব্যবহার করা উচিত। বেশি মগ্ন থাকা উচিত জীবন নিয়ে। জীবনকে উপভোগ করা উচিত। (সূত্র: নিউইয়র্ক পোস্ট ডট কম, ১ জুলাই ২০২২)

বিল গেটস ও স্টিভ জবস তাঁদের সন্তানদের হাতে যন্ত্র তুলে দেননি

বিল গেটস বলেছেন, তিনি তাঁর সন্তানদের বয়স ১৪ হওয়ার আগে তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেননি। আর এরপর তারা কতক্ষণ ডিভাইস বা যন্ত্র ব্যবহার করতে পারবে, তার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে মিরর পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিল গেটস এ কথা বলেন।

স্টিভ জবস ২০১১ সালে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি তাঁর সন্তানদের আইপ্যাড ব্যবহার করতে দিতেন না। অথচ স্টিভ জবস আইপ্যাড আবিষ্কার করেছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নেশার মতো

আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করলে মস্তিষ্কে যে হরমোন নিঃসৃত হয়, ঠিক একই হরমোন একইভাবে নিঃসরিত হয় মাদক নিলে। ধরো, আমি ফেসবুকে বা ইনস্টাগ্রামে একটা ছবি পোস্ট করলাম। একটু পরে দেখলাম, তাতে অনেক লাইক পড়েছে। তাতে আমার ব্রেন উত্তেজিত হয়। এটা যেভাবে কাজ করে, নেশার খুবই ক্ষতিকর জিনিসগুলোও মস্তিষ্কে ঠিক একইভাবে কাজ করে। এ কারণে ফেসবুক আসক্তি, ইন্টারনেট আসক্তি, স্মার্টফোন আসক্তিও আসলে একধরনের নেশা। আমেরিকায় বা ব্রিটেনে এ ধরনের আসক্তদের নিরাময়কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা দেওয়াও হয়। যাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে শিশু–কিশোরও আছে।

কতক্ষণ শিশু-কিশোরদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা উচিত

তোমরা কতক্ষণ মোবাইল ফোন ব্যবহার করবে? কতক্ষণ ইন্টারনেটে থাকবে? কতক্ষণ ভিডিও গেমস খেলবে? কত বছর বয়সের আগে তোমাদের হাতে ফোন দেওয়া উচিত নয়? কত বছর বয়স না হলে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি ব্যবহার করা উচিত নয়?

শিশুরা কতক্ষণ স্ক্রিনের সামনে থাকতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়ার জন্য আমেরিকায় একাডেমি আছে। আগে তারা কতগুলো কঠোর নিয়মকানুন দিয়েছিল। এবার তারা সেই গাইডলাইন নতুন করে তৈরি করেছে।

এর আগে তোমাদের একটা কৌতুক শোনাই। একটা পাঁচ বছরের ছাত্র তার স্কুলের শিক্ষককে বলছে, মিস, আগে তো স্কুলে ব্যাগ চেক করতেন। কেউ মোবাইল ফোন এনেছে কি না। মোবাইল ফোন নিয়ে ক্লাসে ঢোকা নিষেধ ছিল। এখন যে সমস্ত ক্লাসটাই মোবাইল ফোনে ঢুকিয়ে দিলেন?

কোভিড পরিস্থিতির কারণে আমাদের বহু কিছু নতুন করে করতে হয়েছে। যেমন স্কুলের ক্লাস হয়েছে অনলাইনে। ভিডিও কলের মাধ্যমে তোমরাও ক্লাস করে থাকবে।

এখন তো শিশুদের বলা যাচ্ছে না, স্মার্টফোন ব্যবহার করবে না।

কাজেই আমেরিকার সেই একাডেমিটা অভিভাবকদের কতগুলো কাজ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। সেখান থেকে আমি তোমাদের উদ্দেশে কিছু কথা বলি।

১. যেকোনো জিনিসের ভালো দিক আছে, খারাপ দিক আছে। যেকোনো জিনিস অতিরিক্ত করা খারাপ। ইন্টারনেটের ভালো দিক আছে, খারাপ দিক আছে। তোমাদের ভালোটা নিতে হবে, খারাপটা বর্জন করতে হবে।

২. ১৩ বছর বয়স হওয়ার আগে কেউ ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবে না। মনে রেখো, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা অপরাধ।

৩. তোমার ইন্টারনেট ব্যবহার বা ফেসবুক ব্যবহার হতে হবে অভিভাবকদের চোখের সামনে। তাঁরা ঠিক করে দেবেন, কী তোমরা ব্যবহার করতে পারবে। কী পারবে না। এ জন্য অভিভাবকেরা তোমাদের যন্ত্রে কিডস বা শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করে নেবেন। ইউটিউব কিডস তোমরা ব্যবহার করতে পারবে।

৪. সারাক্ষণ ইন্টারনেট বা ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকা চলবে না। সারাক্ষণ ভিডিও গেমস খেলা চলবে না। তোমাদের অভিভাবকেরা বলে দেবেন, তুমি দিনে কতক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে। কতক্ষণ স্ক্রিনের সামনে থাকতে পারবে।

তাঁরা কতগুলো নিয়ম করে দিতে পারেন। যেমন খাওয়ার সময় ইন্টারনেট নয়। আমি তোমাদের কতগুলো পরামর্শ দিতে পারি।

ক. রাতে ঘুমানোর সময় মোবাইল ফোন অন্য ঘরে রাখতে হবে। ফোন পাশে নিয়ে শোয়া যাবে না।

খ. কোথাও বেড়াতে গেলে, একসঙ্গে খেতে বসলে, বাড়িতে অতিথি এলে তাদের সামনে ফোনের দিকে তাকানো যাবে না।

গ. তোমার মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার তোমাদের অভিভাবকেরা যেন দেখতে পারেন, এইভাবে ব্যবহার করতে হবে। একা ঘরে দরজা বন্ধ করে শিশু-কিশোরেরা স্মার্টফোন ব্যবহার করবে না।

ঘ. অপরিচিত লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে না। কথা বলবে না। যোগাযোগ রাখবে না।

ঙ. সব কথা অভিভাবকদের জানাবে। ইন্টারনেটে খারাপ কিছু দেখে থাকলে, সন্দেহজনক কোনো বার্তা পেলে সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের জানাবে। মনে রাখবে, তোমার বাবা, মা, ভাইবোন তোমার ভালো চান। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করা উচিত তাঁরা তোমাদের বোঝাবেন। দরকার হলে, তাঁরা সাইবার সিকিউরিটি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নেবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা নেবেন।

চ. ইন্টারনেটে এমন কিছু করবে না, এমন কিছু বলবে না, এমন কোনো ছবি রাখবে না, যা তুমি তোমার বাবা-মাকে দেখাতে পারবে না। জানাতে পারবে না। এটাই সবচেয়ে বড় কথা। এই একটা সূত্র যদি মেনে চলো, যা আমি বাবা-মাকে জানাতে পারব না, তা আমি করব না, তাহলেই দেখবে আর কোনো বিপদ হবে না।

সব শেষে বলব

ইন্টারনেটে বা স্মার্টফোনে কম থাকো। বেশি করে বই পড়ো। বেশি করে খেলাধুলা করো। ছোটাছুটি করো। গাছে পানি দাও। ফুল ফোটাও। বাবা-মাকে তাদের কাজে সাহায্য করো। গান করো। নাচ শেখো। বিজ্ঞান ক্লাব করো। কবিতা আবৃত্তি করো। সাঁতার শেখো। সাইকেল চালাও।

তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাবে। ভোরে উঠবে। খবরদার, সারা রাত জেগে থাকবে না।

তোমরা জানো, একজন নোবেল পেয়েছেন দেহঘড়ি বা বডিক্লকের বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করে। রাতের বেলা আমাদের শরীর, মন, মস্তিষ্ক ঘুম চায়। দিনের আলো ফুটলে শরীর জেগে ওঠে। মন আর মাথা জেগে ওঠে। প্রকৃতির এই নিয়ম আমাদের ভাঙা উচিত নয়। আমরা রাতে ঘুমাব। দিনে জেগে থাকব।

তুমি নিজেই নিয়ম করো। মার্টিন কুপার দিনে এক ঘণ্টার কম ফোনে থাকেন। মানে ইন্টারনেটে কম সময় থাকেন। তোমরাও সারা দিনে ৩০–৪০ মিনিটের বেশি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকো না। তবে যদি স্কুলের ক্লাস অনলাইনে করতে হয়, তখন তো বেশি সময় পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকতেই হবে। তার মানে হলো, ভালো কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য একটু বেশি সময় থাকতে পারো পর্দার সামনে।

আবার সেই পুরোনো কথা। সবকিছুর ভালো দিক আছে। সবকিছুর খারাপ দিক আছে। আমরা খারাপটা এড়িয়ে চলব।

অতিরিক্ত সবকিছু খারাপ। আমরা কোনো কিছুই অতিরিক্ত করব না।

আর ইন্টারনেট বা ফেসবুক বা টিকটক বা ইনস্টাগ্রামকে নেশা বানিয়ে ফেলব না।

যতটা পারি, ততটাই কম সময় ইন্টারনেটের সামনে বা স্ক্রিনের সামনে থাকব। বাকি সময় থাকব বাস্তব জীবনে। মনে রাখব, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি রিয়েলিটি নয়। আমার মাকে জড়িয়ে ধরলে আমি যে শান্তি পাব, ফেসবুকে মা আমি তোমাকে ভালোবাসি বললে আমি সে শান্তি পাব না।