জন্মদিনে কেক কাটা হয় কেন?

ধরো, আগামীকাল তোমার জন্মদিন। বাসায় কেক কেটে জন্মদিন উদ্‌যাপন করা হবে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের দাওয়াত দিয়েছ। সবাই একত্র হবে। নতুন পোশাক পরবে। কেক কাটবে। সারা দিন বাড়িতে থাকবে উৎসবের আবহ। এমন পরিস্থিতিতে আজকে রাতে নিশ্চয়ই তোমার ঘুম আসবে না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে চিন্তা করবে, রাতটা কখন শেষ হবে? সকালে ঘুম থেকে উঠে কী করবে—এ রকম নানা প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিতে দিতে তুমি আসলেই ঘুমিয়ে পড়বে। হয়তো স্বপ্নে কেটে ফেলবে একটা কেক!

জন্মদিনে মনের অবস্থা এ রকম হতেই পারে। একটা কথা হয়তো প্রায়ই মাথায় আসে তোমার। জন্মদিনে আমরা কেক কেন কাটি? কেকের ওপর মোমবাতিই–বা কেন জ্বালাই? অথবা কেক কাটার সময় কেন সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠি, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ? কখন থেকেই–বা এই জন্মদিন পালনের নিয়ম শুরু হলো? নিশ্চই এতগুলো প্রশ্ন তোমার মাথায় একসঙ্গে আসেনি। চলো, আজ এসব প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করি।

জন্মদিনে কেক কাটার প্রচলন করে প্রাচীন রোমানরা। তারা যে শুধু জন্মদিনেই কেক কাটত, বিষয়টা এ রকম না। যেকোনো উৎসবেই কেক কাটত তারা। যেমন বিয়ে বা অতিথি আপ্যায়নের জন্যও কাটা হতো কেক। তবে সেই কেক আবার এখনকার মতো শুধু আটা বা ময়দা দিয়ে তৈরি হতো না। কেকের মধ্যে দেওয়া হতো মধু, বাদাম ও নানা ধরনের ফল। অবশ্য রোমানদের পাশাপাশি গ্রিক ও প্রাচীন ভারতীয়রাও কেক কাটার প্রচলন শুরু করেছিলেন। ভারতীয়রা জন্মদিন উপলক্ষে পায়সাম, ক্ষীর, জামুন ও ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মিষ্টি তৈরি করত। তখন শুধু রাজা-মহারাজারা উদ্‌যাপন করতেন নিজেদের জন্মদিন। জন্মদিন উদ্‌যাপনের একটি উদ্দেশ্যও ছিল। তাঁরা মনে করতেন, জন্মদিন উদ্‌যাপন করলে খারাপ আত্মারা তাঁদের থেকে দূরে সরে যাবে।

পনেরো শতাব্দীতে জার্মানরা প্রথমবারের মতো বাজারে নিয়ে আসে এক স্তরবিশিষ্ট কেক। কেক কেটে জন্মদিন উদ্‌যাপনের এই রীতিকে তাঁরা নাম দিয়েছিলেন ‘কিন্ডার ফেস্ট’। অর্থাৎ, বাচ্চাদের উৎসব। আমরা এখন যে কেক কেটে জন্মদিন উদ্‌যাপন করি, এ রকম আধুনিক কেক প্রথম বাজারে আসে সতরো শতকে। সে সময় এ ধরনের কেক কাটার সৌভাগ্য হতো শুধু সমাজের ধনী ব্যক্তিদের। ওই কেক সর্বসাধারণের পর্যায়ে নামতে সময় লাগে ২০০ বছর। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সাধারণ মানুষও নিজেদের জন্মদিনে কেক কাটা শুরু করে।

এবার বলি জন্মদিনের কেকের ওপর কেন মোমবাতি বসানো হয়। মূলত, প্রাচীনকালে কেক বানানো হতো চাঁদের মতো গোল করে। কারণ, গ্রিকরা চাঁদের দেবী হিসেবে মানত আর্টেমিসকে। তাঁকে খুশি করার জন্যই কাটা হতো কেক। যাতে সব খারাপ আত্মাকে দেবী দূরে সরিয়ে রাখেন। যা–ই হোক, কেকের ওপর মোমবাতি বসিয়ে তা জ্বালালে কেকটাকে চাঁদের মতো উজ্জ্বল দেখাত। গ্রিকরা ভাবত, এই দৃশ্য আর্টেমিস ওপর থেকে দেখছেন। এরপর সবাই মিলে একসঙ্গে দেবীর উদ্দেশে প্রার্থনা করতেন। প্রার্থনা শেষে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফেলতেন মোমবাতি। তাঁদের বিশ্বাসমতে, নেভানো মোমবাতির ধোঁয়া সব অপশক্তিকে নিয়ে পৌঁছে যেত দেবী আর্টেমিসের কাছে। এই মোমবাতি নেভানো নিয়েও একটি মিথ প্রচলিত ছিল। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, একবারে ফুঁ দিয়ে সব মোমবাতি নেভাতে পারলে তাঁর মনের সুপ্ত ইচ্ছাটি পূর্ণতা পাবে। সুপ্ত বলছি কারণ, নিয়ম ছিল তাঁদের ইচ্ছার কথা কাউকে জানানো যাবে না। প্রচলিত ছিল, মনের ইচ্ছা প্রকাশ করে দিলে তা পূরণ হবে না।

এ ছাড়া যার জন্মদিন, তার বয়সের সঙ্গে মিল রেখে কেকের ওপর মোমবাতি জ্বালানো হতো। যত বছর বয়স তার থেকে একটি মোমবাতি বেশি থাকত কেকের ওপর। বোঝানো হতো, ওই মোমবাতিটাই নতুন বছরের সূচনা। ওই মোমবাতিটি থাকত অন্য মোমবাতির তুলনায় একটু বড়। আমাদের দেশে এখনো এই রীতি পালন করা হয়। বয়স মেপে গুনে গুনে বসানো হয় মোমবাতি।

এবার আসা যাক গানের কথায়। কবে থেকে চালু হলো জন্মদিনের এই গান? আসলে, ‌‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ মোটেও জন্মদিনের গান ছিল না। গানটি ছিল ‘গুড মর্নিং টু অল’। এটি লিখেছিলেন কেনটাকি স্কুলের দুই শিক্ষক প্যাটি হিল ও মিল্ড্রেড জেন হিল। দুই বোনের লেখা এই গান প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৩ সালে, তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলের একটি গানের বইয়ে। ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন সকালে ক্লাসরুমে বসে গাইত এই গান। গানটির প্রথম লাইনগুলো বাংলায় অনুবাদ করলে এমন হয়: তোমাকে শুভ সকাল। তোমাকে শুভ সকাল। শুভ সকাল প্রিয় শিশুরা। সবাইকে শুভ সকাল।

এই গানের কথাই সামান্য পরিবর্তন করে ১৯২৪ সালে প্রকাশ করেন রবার্ট কোলম্যান। তিনিই আগের গানটি সামান্য পরিবর্তন করেন। ‘গুড মর্নিং টু অল’–এর পরিবর্তে লেখেন ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৩৫ সালে এই গানটিকে কপিরাইটের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯৮৮ সালে আড়াই কোটি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে গানটির স্বত্ব কিনে নেয় ওয়ার্নার চ্যাপেল মিউজিক কোম্পানি। ২০৩০ সাল পর্যন্ত থাকবে এই কপিরাইটের আইন। ইতিহাসের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী একক গান হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’। এখনো বছরে প্রায় ২০ লাখ মার্কিন ডলার আয় করছে গানটি। সেই আয়ের একটি অংশ পায় দুই বোনের পরিবার।