ফ্রিজ আবিষ্কারের আগে আইসক্রিম এল কেমন করে

লেমন ও অরেঞ্জ ললি আইসক্রিমছবি: খালেদ সরকার

শীতকালে খুব একটা আইসক্রিম খাওয়া হয় না। এমনিতেই আবহাওয়া ঠান্ডা। তার ওপর ঠান্ডা আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে আইসক্রিম নিয়ে মাথায় এক প্রশ্ন এল। যখন ফ্রিজ তৈরি হয়নি, তখন কি আইসক্রিম ছিল? যদি থাকেই, তাহলে আইসক্রিম বানাত কেমন করে? জমাট করে ঠান্ডা করার পদ্ধতি আবিষ্কারের আগেই কি আইসক্রিম বানানো সম্ভব? শীতে আইসক্রিম খেতে না পারলেও আইসক্রিম নিয়ে জানতে তো অসুবিধা নেই। তাই এই লেখা।

মনে করা হয়, আইসক্রিম বানানোর ধারণা সবার প্রথমে এসেছে চীনে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ শতাব্দীতে কনফুসিয়াসের সময় বরফ বিক্রি হতো। বলা হয়, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পাহাড় থেকে তুষার ও বরফ নামানোর জন্য ক্রীতদাসেদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। নিশ্চিতভাবেই বরফ ও তুষার থেকে আইসক্রিমের ধারণা এসেছে।

আইসক্রিম বানানোর পদ্ধতি ছিল সময়সাপেক্ষ আর ব্যয়বহুল। পুরোনো দিনে আইসক্রিম বানানোর মূল উপাদান দুধ ও ক্রিমের দ্রবণ একটি পাতলা ড্রামে ঢালা হতো। পরে ড্রামটি একটি বড় পাত্রে ডুবিয়ে রাখা হতো, যে পাত্রে থাকত বরফ আর লবণের মিশ্রণ।

বাসাবাড়িতে প্রতিদিন কাজে লাগে ফ্রিজ
কৃতজ্ঞতা: প্রাসকোভিয়ার

আমরা তো জানি শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি জমে বরফ হয়ে যায়। তবে দুধ আর ক্রিম কিন্তু এই তাপমাত্রায় জমে না। ২০ ডিগ্রি ফারেনহাট বা মাইনাস ৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হয় এদের জমাতে। বরফ আর লবণের মিশ্রণ পাত্রে রাখার কারণ হলো, লবণ বরফকে গলিয়ে মাইনাস ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা তৈরি করে। ঠিক ফ্রিজের মতো। দুধ আর ক্রিম এই তাপমাত্রায় জমে যায়।

আইসক্রিমের এই রেসিপি ১২৯২ সালে পরিব্রাজক মার্কো পোলো চীন থেকে ভেনিসে নিয়ে আসেন। ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অনেক রকম জমাটের মিশ্রণকৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলোর জন্য তুষার বা বরফের প্রয়োজন ছিল না। এ সময় সাল অ্যামোনিয়াক, নাইটার আর পানির মিশ্রণ ব্যবহার করা হতো। সাল অ্যামোনিয়াক, নাইটার বিরল খনিজ পদার্থ। প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। সাল অ্যামোনিয়াক তৈরি হয় নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ও ক্লোরিন দিয়ে। আর নাইটার পটাসিয়াম নাইট্রেটের খনিজ রূপ। পটাশিয়াম, নাইট্রোজেন আর অক্সিজেন ব্যবহার করে এই খনিজ তৈরি হয়। এই মিশ্রণ লিথাল বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে পারে এসব মিশ্রণ। সাল অ্যামোনিয়াক ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থেকে কমিয়ে মাইনাস ১২ দশমিক ২ ডিগ্রিতে নামিয়ে আনতে পারে। নাইটার ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ দশমিক ৫৬ পর্যন্ত নামিয়ে আনতে পারে।

আইসক্রিম বানাতে বরফ বা তুষারের প্রয়োজন ছিল

প্রথম দিকের ভিক্টোরিয়ান পরিবারে (কুইন ভিক্টোরিয়ার সময়কাল, ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ সাল) আইসক্রিম পরিবেশন করার ব্যবস্থা ছিল। ১৮৫৬ সালের রেসিপিতে দেখা যায়, ‘বরফ টুকরো টুকরো করে চার পাউন্ড লবণ যোগ করুন। ভালোভাবে মেশান; একটি খালি পাত্রে মিশ্রণ ঠান্ডা করার পাত্র রাখুন এবং এটিকে বরফে ঘিরে রাখুন; পুডিং… (যা যা দিয়ে আইসক্রিম বানাতে চান) পাত্রের মধ্যে রাখুন এবং বুড়ো আঙুল দিয়ে খুব দ্রুত ঘুরিয়ে দিন; যখন পুডিং পাত্রের পাশে লেগে থাকে, তখন চামচ দিয়ে ছাড়িয়ে নিন। পুডিং শক্ত হয়ে গেলে এটিকে ছাঁচে রাখুন। ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন। এর মধ্যে দুইটি কাগজ রেখে দিন; বরফের মধ্যে ছাঁচ ঢেকে রাখুন। জমাট হয়ে গেলে ঠান্ডা পানির বেসিনে লবণ ধুয়ে ফেলুন। ঢাকনাটি খুলে ফেলে থালায় পরিবেশন করুন।’

উচ্চবিত্ত ভিক্টোরিয়ান পরিবারে বরফের সরবরাহ ছিল বলে ধরা হয়। যাদের সামর্থ্য ছিল, তারা বরফ রাখার জন্য মাটির নিচে বরফ রাখার ঘর তৈরি করত। যেখানে বরফ রাখা হতো খড়, নল, তুষ বা পাতলা কাঠের স্তূপ দিয়ে বায়ু নিরোধ করে। এভাবে বরফ টিকে থাকত বহুদিন। অভিজাত মানুষেরা এই বরফের সাহায্যে পেতেন আইসক্রিম।

কার্যকর ফ্রিজ আবিষ্কার হতে সময় লেগেছে ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত। ঘরে ব্যবহারযোগ্য ফ্রিজ এসেছে ১৮৯৯ সালে। ঘরে ঘরে ফ্রিজ পৌঁছুতে সময় লেগেছে আরও অনেক বছর। তত দিন কি আইসক্রিম খাওয়া বন্ধ ছিল? না, মানুষ আইসক্রিম খেত। এ কথাই এতক্ষণ হলো।