‘তারা- একটি দুটি তিনটি করে এলো
তখন- বৃষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া বইছে এলোমেলো’
আহসান হাবীবের এই কবিতার মতই একটি–দুটি করে জোনাকিরা ছুটে আসে আলোর বন্যা নিয়ে। গ্রীষ্মের প্রাণ হাঁসফাঁস করা গরমে এমন আলোর খেলায় মেতে ওঠে জোনাকিরা। শহর থেকে একটু দূরে যেতেই রাতের অন্ধকারে দেখা যায় এই জোনাকিদের ছোটাছুটি। কিন্তু জোনাকিদের এমন রহস্যময় আলোর রহস্য কী? ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে জোনাকির দেহের ভেতরে চলতে থাকা রাসায়নিক পরিবর্তনই এই আলোর উৎস। জোনাকির এই রহস্যময় আলোর পেছনের বিজ্ঞানটা জেনে নিই চলো।
কীভাবে আলো দেয় জোনাকি
প্রথম ধাপ: গ্রীষ্মের সপ্তাহ দুয়েক আগেই শুরু হয় জোনাকিদের প্রজননকাল। এ সময় স্ত্রী জোনাকিগুলো সন্ধ্যা হতেই তাদের পুরুষ সঙ্গীর জন্য ঝোপঝাড়–ঘাসের ওপর অপেক্ষা করে।
দ্বিতীয় ধাপ: পুরুষ জোনাকিগুলোর পেটের নিচের ট্রাকিয়া (ক) অংশের টিউবের মতো সরু অঞ্চল দিয়ে অক্সিজেন প্রবেশ করে। অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে বহিঃকঙ্কালের পৃষ্ঠে থাকা বিশেষ আলোক সৃষ্টিকারী কোষ ফটোসাইটগুলো জ্বলে ওঠে।
তৃতীয় ধাপ: ফটোসাইট কোষের ভেতরে লুসিফেরাস এনজাইম আলো উৎপাদনকারী লুসিফেরিন অণুর (খ) সঙ্গে মিলিত হয়। অক্সিজেন আর এটিপির (এডেনাইন ট্রাই ফসফেট) প্রভাবে এই মিলন ঘটে। ফলে অক্সিলুসেফিরিন নামের এক বিশেষ যৌগ তৈরি হয়। যার থেকে শক্তি হিসেবে আলো উৎপন্ন হয়। জোনাকির পেটের নিম্নভাগে এই আলো দেখা যায়।
চতুর্থ ধাপ: পুরুষ জোনাকির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে আলো জ্বলে প্রতি ৫.৫ সেকেন্ড পরপর। এ রকম অবস্থায় কোনো স্ত্রী জোনাকি তার পুরুষ সঙ্গীকে মুগ্ধ করতে পুরুষ সঙ্গীর ২ সেকেন্ড পরপর নিজেও আলো জ্বালায়। আলো জ্বলার জন্য স্ত্রী জোনাকির ক্ষেত্রেও একই রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে।
পঞ্চম ধাপ: স্ত্রী জোনাকির আলোর জ্বলা–নেভাকে অনুসরণ করে পুরুষ জোনাকি। এভাবে তাদের প্রজনন সম্পন্ন হয়। কিছুদিন পরই স্ত্রী জোনাকি ভেজা মাটিতে ডিম পাড়ে। সেগুলো থেকেই দেখতে দেখতে দুই থেকে চার সপ্তাহের মাথায় জন্ম নেয় নতুন জোনাকি। এত সব চমৎকার ঘটনা ঘটে শুধু জোনাকির রংবেরঙের আলোকনৃত্যকে ঘিরে।
জোনাকি ছাড়া আরও যারা আলো দিতে পারে
Gaussia princeps
সমুদ্রের তলদেশে ভাসমান এই অণুজীবগুলো শিকারি মাছগুলোকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে লুসিফেরোমেন হরমোন নিঃসরণ করে। ফলে বিস্তৃত অঞ্চল আলোকিত হলেও তাদের খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন।
Lophiiformes
এই মাছগুলোকে অ্যাঙ্গলার মাছও বলা হয়। এদের মুখের ওপরের অংশে লম্বা টিউবে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া থাকে। যারা বায়োলুমিনেন্স হিসেবে আলো তৈরি করে। ফলে ছোট ছোট সামুদ্রিক অণুজীব আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অ্যাঙ্গলার মাছের চোয়ালে আটকে যায়।
Galiteuthis glacialis
বিশেষ প্রজাতির এই স্কুইড মাছগুলো তাদের নিচের অংশে আলো তৈরি করে যেন তাদের নিচে থাকা ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো ছায়া দেখে তার উপস্থিতি না বুঝতে পারে।